ফুটপাতেই শুরু, এই শিল্পীর পরিচয় এখন পটুয়া টাইগার নাজির
ফুটপাতের দেয়ালে ঝুলছে পটচিত্র। নিচে বসে আপনমনে এঁকে যাচ্ছেন এক আত্মভোলা আঁকিয়ে। কখনো টুকরো কাঠের ওপর আঁকছেন বিখ্যাতদের পোর্ট্রেট, কখনো আবার রং-তুলিতে ফুটিয়ে তুলছেন আবহমান বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য- পটচিত্র। একবার হাতে পেন্সিল, খানিক বাদে জলরঙ আর তুলি। এভাবেই একে একে নান্দনিক চিত্রকর্মে ভরে উঠছে দেয়াল।
শাহবাগ মোড় থেকে ফুটপাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে কত কী-ই না চোখে পড়ে। কেউ বিক্রি করছেন বই, ক্যাপ কেউ বা তেলেভাজা। এই অনেক কিছুর ভিড়ে সবার আকর্ষণ একাই কেড়ে নেন এই রঙিন মানুষটি। মাথায় ভাঁজ করে বেঁধে রেখেছেন লাল-সবুজ পতাকা, পরনে জিন্স ও টি-শার্ট। দিনের পর দিন রঙ লেগে ওগুলোর নান্দনিকতাই বেড়েছে শুধু। পাবলিক লাইব্রেরির সামনের ব্যস্ততম ফুটপাতকে তিনি বানিয়েছেন নিজের শিল্প সৃষ্টির আখড়া।
নাম তার পটুয়া টাইগার নাজির
দিনাজপুরের পার্বতীপুরের একটি ছোট গ্রামে ১৯৮২ সালে জন্ম পটুয়া নাজিরের। বাবা মা নাম রেখেছিলেন নাজির হোসেন। ছোটবেলাতেই চক কিংবা মায়ের রান্নায় ব্যবহৃত কাঠকয়লা দিয়ে কখনো মাটিতে, কখনো আবার দেয়ালে আঁকিবুঁকি করতেন। তখন বয়স আর কতই বা হবে, চার কি পাঁচ। এরপর যখন স্কুলে ভর্তি হলেন, লেখার চেয়ে পাঠ্যবইয়ে আঁকা ছবিগুলোই তাকে বেশি টানতো। বইয়ের সেসব ছবি দেখে নিজের মতো করে আঁকতেও চেষ্টা করতেন নাজির। রবীন্দ্র-নজরুলের ছবি আঁকতেন পড়ার খাতায়। কখনো হতো, কখনো হতো না। আট ভাই বোনের সংসারে আঁকাআঁকিকে কে-ই বা ভালো চোখে দেখবে? কেউ ভালো বলতো, তবে নিন্দাই শুনতে হতো বেশি।
কিন্তু কিছুতেই দমে যান নি নাজির। ছবি আঁকতেন মনের আনন্দে। স্কুলে হাতে তৈরি শিল্পকর্মের প্রতিযোগীতায় প্রাণিদের ছবি এঁকে কিংবা মাটির বাঘ বানিয়ে বাহবা কুড়াতেন। আরেকটু বড় হয়ে যখন 'রঙধনু' নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে যোগ দিলেন, তখনই নাজির একরকম নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন, আঁকাআঁকিই হবে তার জীবনের একমাত্র পাথেয়। এরপর আর তাকে কে পায়!
নাজির আঁকতেন তার আশেপাশের সাধারণ মানুষের ছবি। কামার-কুমোর, জেলে, তাঁতি কিংবা কৃষক- এ মানুষগুলোই উঠে আসতো তার ছবিতে। গ্রামের মা-বোনেদের আঁকা নকশি কাঁথার ছবিগুলো, কিংবা মাটির তৈজসপত্রের চিত্র ছিলো তার অনুপ্রেরণা। এ সময়েই বইপত্রের মাধ্যমে নাজিরের পরিচয় ঘটে মহান সব শিল্পী ও তাদের চিত্রকর্মের সাথে। জানতে শুরু করেন চিত্রশীল্পের নানা ধরণের আর্টের কথা। জয়নুল আবেদীন, এস এম সুলতান, কামরুল হাসান থেকে শুরু করে যামিনী রায়, সকলের খোঁজ রাখতেন পত্রপত্রিকাতে। সেসময় তিনি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হন পটুয়া শিল্পীদের আঁকা চিত্রগুলোর প্রতি, সেসব ছবির সাথে খুঁজে পান নিজের আত্মিক যোগ।
নব্বইয়ের দশকে বন্ধুদের মাধ্যমে জানতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার কথা। শোনেন, এখানে ছাত্র-শিক্ষক সবাই শুধু শিল্পচর্চা নিয়েই থাকেন। ১৯৯৬ সালে নাজির প্রথম ঢাকা শহরে আসেন। সঙ্গে ছিলো একবুক আশা আর মায়ের দেওয়া অল্প কিছু টাকা। এটি তার স্থায়ীভাবে আসা ছিলো না। এ সময়টায় প্রায়ই আসতেন, টাকা ফুরিয়ে গেলে আবার চলে যেতেন গ্রামের বাড়ি।
ঢাকায় আসলে সারাদিন ঘুরঘুর করতেন চারুকলায়। এভাবেই সকলের সাথে বাড়তে থাকে পরিচিতি। একবার নিজের আঁকা চিত্রগুলো নিয়ে এসে দেখালেন শিক্ষক ও ছাত্রদের। তাদের থেকে বাহবা পেয়ে আগ্রহ বেড়ে গেল নাজিরের। এতদিন যেসব শিল্পগুরুদের কেবল পত্রিকাতেই পড়েছেন, ঢাকায় এসে সরাসরি দেখতে পেলেন তাদের চিত্রকর্ম। এবার আর তার সিদ্ধান্ত নিতে কোন দ্বিধা থাকলো না তার, ঠিক করে ফেললেন ঢাকায় এসেই ছবি আঁকবেন তিনি।
ঢাকায় স্থায়ী হতে হলে যে অর্থের প্রয়োজন হয়, তা ছিলো না নাজিরের। টুকটাক ছবি এঁকে কোনমতে জীবনযাপন করতেন। কখনো ছবির হাটে কখনো আবার চারুকলার দেয়ালে নিজের আয়োজন করতেন নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনী। সেখানে দু'একটি ছবি বিক্রি হলে তাই দিয়ে চলতে হতো।
৯৬ সালে সেই যে এলেন, আর ফিরে যেতে হয়নি তাকে। বহু চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়েছেন, কিন্তু শাহবাগ ফেরায়নি তাকে, বরং বরণ করে নিয়েছে গভীর মনতায়। চারুকলার আশেপাশে নানা জায়গায় ছবি এঁকে এঁকে তিনি এখন স্থায়ী হয়েছেন জাতীয় গ্রন্থাগারের সামনের ফুটপাতে। তার এই পটচিত্র সাধনার অর্জন এই যে, আজ শিল্পঅঙ্গনের বহুল-চর্চিত ও সমাদৃত একটি নাম পটুয়া টাইগার নাজির।
পটচিত্র আঁকেন, নাম তাই পটুয়া। কিন্তু নামে টাইগার যুক্ত হলো কীভাবে? জিজ্ঞেস করাতে যুক্তিসঙ্গত উত্তরই দিলেন নাজির। "যত বড় বড় শিল্পী আছেন, কিংবা আমাদের যে লোকশিল্পের পটুয়ারা, তাদের সকলেরই একটি নিজস্ব স্টাইল ছিলো। যামিনী রায়ের ছবিতে চোখগুলো দেখলেই বুঝা যায় এটা যামিনী এঁকেছেন। তখন আমি ভাবলাম আমিও এমন চিত্রকর্ম আঁকবো, যেটা আমার সংস্কৃতি, আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করবে, একই সাথে আমার নিজস্ব স্টাইল থাকবে। তখন আমি একটি আইকন খুঁজে পেলাম, যেটা আমাদের একান্ত নিজস্ব, আবার গৌরবের প্রতিক। এভাবেই আমার ছবিতে বাঘ চলে এলো।"
যারা নাজিরের ছবি দেখেছেন, তারা হয়তো টাইগার নামটির তাৎপর্য মুহূর্তেই ধরতে পারবেন। বাঘ হলো নাজিরের ছবির প্রধান উপজীব্য! তার ছবিতে যেমন দেখা মেলে নানা রঙ ও ঢঙের বাঘ, তেমনই ছবিতে বাঘগুলোর নানা কর্মকাণ্ডও কৌতুহলের জন্ম দেয়! কোন ছবিতে বাঘ হাল চাষ করছে, কোথাও দোতারা বাজাচ্ছে, কোথাও আবার করছে মাস্টারি। কোন কোন ছবিতে বাঘকে দেখা যাচ্ছে জমিতে ফসল বুনতে! আর শুধু তা-ই নয়, বাঘের ছবিকে নাজির ব্যবহার করেন নিজের সিগনেচার হিসেবে। তিনি যখন কোন মানুষের পোট্রের্টও আঁকেন, সে ছবিতে স্থান পায় বাঘ।
এসব কারণে নাজির পেয়েছেন 'বাঘ মামা' খেতাব। কেউ কেউ ডাকে 'বাঘ ভাই' বলে! সবচেয়ে বড় ব্যপার, নিজের নামটাই যে হয়ে গেছে 'টাইগার'। তবে এসব বিষয় বেশ উপভোগ করেন বলেই জানালেন এই পটুয়া।
পটুয়া ও পটচিত্র
পটুয়া কথাটি শুনলে প্রথমেই মনে পড়ে শিল্পী কামরুল হাসানের কথা। বাংলার জাতীয় পতাকার ডিজাইনার কামরুল হাসান নিজের নামের আগে পটুয়া শব্দটি একারণেই ব্যবহার করতেন, যেন সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নামটি।
'পট' শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ 'পট্ট' থেকে, যার অর্থ কাপড়। প্রাচীনকালে যখন কোন রীতিসম্মত অঙ্কনরীতি ছিলো না, গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ যেসব চিত্রকর্ম আঁকতেন বিভিন্ন মাধ্যমে, তা-ই মূলত পটচিত্র নামে পরিচিত। পটচিত্র এমন একটি শিল্পমাধ্যম যেখানে ছবি একে গল্প বলা হয়। প্রাচীনকালে মূলত পৌরাণিক কাহিনীগুলো পাটের পটে এঁকে গল্পের ঢঙে উপস্থাপন করা হতো। আর যারা এই পটচিত্র আঁকতেন, তাদের বলা হতো পটুয়া। বিভিন্ন দেশজ উপাদান, যেমন ইটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা দিয়ে পটে আঁকা হতো নান্দনিক এসব চিত্রকর্ম। সেসব চিত্রকর্ম থেকে আবার তৈরি হতো গান, হাতে পটচিত্র নিয়ে তা দেখিয়ে দেখিয়ে সুরে সুরে গাওয়া হতো কোন পৌরাণিক কাহিনী। জমে যেত আসর। সেসব গানকে বলা হতো পটুয়া সংগীত।
তবে এই চিত্রশিল্প সবচেয়ে বেশি বিকাশলাভ করে কলকাতার কালীঘাটে কালীমন্দিরের কাছে। এখানে আঁকা পট সারা বাংলায় বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এ পটগুলো আঁকতেন মূলত কুমোর সম্প্রদায়ের মানুষজন। এঁরা প্রতিমা ও পুতুল তৈরি করতেন, প্রতিমা তৈরির সময় চালচিত্র আঁকতেন। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর 'আর্ট ম্যানুফ্যাকচারস অফ ইন্ডিয়া' (১৮৮৮) গ্রন্থে এই পটুয়াদের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
কালের অবর্তনে গ্রামীণ এসব চিত্রকর্ম এখন উঠে এসেছে শিল্পকলার মূলস্রোতে। তবে সমাজের উচ্চশ্রেণির বসার ঘরে পটচিত্র পৌঁছাতে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তার নাম শিল্পী যামিনী রায়। আহমদ ছফা তাকে 'দেশীয় রীতিতে ঐতিহ্যনির্ভর মনোমুগ্ধকর অঙ্কনশৈলীর উদ্ভাবক এবং বাংলার একান্ত ঘরোয়া চিত্রশিল্পী' বলে উল্লেখ করেছিলেন। পটুয়া কামরুল হাসান তো নিজেকে পটুয়া বলে ঘোষণা করতেন গর্বের সাথে।
ভারতীয় পটুয়ারা মূলত ধর্মকে আশ্রয় করে পটচিত্র আঁকতেন। তবে সে রীতিতে পরিবর্তন আনে বাংলাদেশের পটুয়ারা, জানালেন পটুয়া নাজির। তার মতে, গাজী-কালু, বনবিবির কাহিনী পটচিত্রে আঁকা হলেও ইতিহাস নির্ভর পটচিত্র আঁকায় বাংলাদেশের পটুয়ারাই ভূমিকা রেখে বেশি।
নাজিরের পটচিত্র বিশ্ব দরবারে
পটুয়া নাজিরের শিল্পসাধনা অল্প কয়েক বছরের নয়, বরং কয়েক যুগের। সমগ্র জীবন তিনি ব্যয় করেছেন পটচিত্র সাধনার। তা নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই, আছে গর্ব। কুড়ে ঘরে থেকেও শিল্পের বড়াইটা জারি রেখেছেন নাজির। মিলেছে স্বীকৃতিও। দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিল্পবোদ্ধা, সকলের প্রসংশা যেমন কুড়িয়েছেন, মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছেন শিল্পরসিক বিদেশীদেরও। একদিন বিকেলে চা খেতে খেতে সেব গল্পই করলেন এই পটুয়া।
এখন অবধি ৫৯টি একক প্রদর্শনী হয়েছে তার। এর মধ্যে একাধিকবার রয়েছে শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, রাশিয়ার সাংস্কৃতিক সেন্টার, ফরাসি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা কিংবা বেঙ্গল গ্যালারির নাম।
২০১৩ সালে জাপান সরকারের আমন্ত্রণে 'টিটিএনা-২০১৩ এক্সিবিশনে' অংশ নেন নাজির। সেবার বাংলাদেশ থেকে নবীন-প্রবীণ প্রায় ১০০ জন শিল্পী প্রদর্শনীতে অংশ নেন। নাজিরের বাঘের পটচিত্র সকলের নজর কাড়ে। তার আঁকা বাঘের মাসকট নির্বাচিত হয় জাপান-বাংলাদেশ গুডউইল অ্যাম্বাসাডর হিসেবে। দুই দেশের বন্ধুত্বকে তুলে ধরেছে তার সৃষ্টিকর্ম 'বানতুরা কুন', যার অর্থ 'বাঙালি বাঘ ভাই'।
নিজের ডকুফিল্ম 'উইম্যান বিহাইন্ড দ্য ক্যামেরা' নিয়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এসেছিলেন মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা এলেক্সিস ক্রাসিলভস্কি। সে ২০১৮ সালের কথা। একটি স্ক্রিনিং শেষে এলেক্সিস তখন জাতীয় যাদুঘরের সামনে এসেছেন। দেখলেন দুজন সুইডিশ নির্মাতার কাঁধে ঝুলছে বাঘের ছবি আঁকা চমৎকার দুটি ব্যাগ। খোঁজ করতেই জানতে পারলেন, অদূরেই একজন শিল্পী আপন মনে এঁকে যাচ্ছে ছবিগুলো।
সেদিন নাজিরের চিত্রকর্ম দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন এই নির্মাতা, নাজিরের পটচিত্র ব্যবহার করে একটি গ্রন্থ লেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তখন থেকেই নাজিরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন এলেক্সিস। আরেকজন সহ-লেখকের সাথে মিলে লিখেছেন 'টুকি দ্য টাইগার' নামের বই। এখন শুধু প্রকাশের অপেক্ষা। নাজিরের ইলাস্ট্রেশন সহ বইটি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে।
নাজিরকে খুঁজে পাওয়া এবং তার চিত্রকর্ম নিয়ে কাজ করার আগ্রহ কীভাবে হলে জানতে চাইলে এলেক্সিস শোনালেন সেই গল্প। "আমি যাদুঘর থেকে ছুটে গেলাম, গেটের কাছে দেখলাম একজন অসাধারণ শিল্পী এবং তার জিনিসপত্র। ব্যাগে আঁকা বাঘের ছবি আসলে আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলেছিলো। আমি তখনও জানতাম না যে বাঘ বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাহসিকতার প্রতিক। এরপর নাজির হোসেনের কাজ সম্পর্কে যত জেনেছি, বুঝেছি যে বাংলাদেশ কীভাবে একটি দেশ হয়ে উঠলো- সে গল্প নিজের কাজের মাধ্যমে বলতে চান তিনি, ততই অনুপ্রাণিত হয়েছি। নাজিরকে আমি বিশটির অধিক 'স্টোরিবোর্ড' করতে দিয়েছিলাম, যেগুলো ব্যবহার করে বই ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করবো বলে আশা করছি।"
নাজির জানালেন, শিশু ও কিশোরদের জন্য হলেও তার অন্যতম ক্রেতা বিদেশি নাগরিক। "আমার বিভিন্ন প্রদর্শনী থেকে বিদেশীরা আমার চিত্রকর্ম কিনে সংগ্রহ করে। তাদের ভালো লাগে বলেই নেয়। তারা তো সেরাটা খুঁজে বেড়ায় বিশ্বজুড়ে।"
তার চিত্রকর্ম দেশের কথা বলে
দেয়ালে ঝোলানো নাজিরের চিত্রকর্মগুলো যেন সারাক্ষণ বলে চলেছে দেশের কথা, গেয়ে চলেছে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গান। তার ছবিতে দেখা মেলে নদী, খালবিল, শাপলা, মৎস্যকন্যা, হাতি, পেঁচা , কিংবা বিড়াল ছানা। কোন ছবিতে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিচ্ছেন, কোন ছবিতে সাঁতার কাটছে মৎস্যকন্যরা। গ্রাম বাঙলার চিরায়ত গল্পগুলোই যেন উঠে এসেছে তুলির ছোঁয়ায়।
তার ছবির প্রধান রঙ লাল, হলুদ, সবুজ, সাদা, কালো ও নীল। নিজের মত তার আঁকা চিত্রগুলোতেও নায়ক নায়িকার মাথায় থাকে লাল-সবুজের পতাকা। এটিই তার ছবি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন নাজির। "ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেশপ্রেম যেন বৃদ্ধি পায়, আমার এই ছবি মাধ্যমে আমি সে কথাই বলতে চাই। দেশ সবার আগে, দেশ থাকবে মাথায়। আমার ছবির নায়কেরা, এমনকি বাঘের মাথাতে জড়ানো থাকে জাতীয় পতাকা।"
নাজির চান এই শিল্পচেতনা যেন ছড়িয়ে পরে সকলের মধ্যে। এজন্য বিনামূল্যে ছবি আঁকা শেখান তিনি। "আগে ছবির হাটে ছিন্নমূল শিশুদের ছবি আঁকা শেখাতাম। করোনার মধ্যে সেসব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আবারো চেষ্টা করছি। দেয়ালে বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছি যে, ছবি আঁকা শেখানো হয়। আমি কোন টাকা নেই না। বিনামূল্যে আঁকা শেখাই।"
বিলুপ্তপ্রায় লোকশিল্প তুলে ধরাই নাজিরের ব্রত
পটচিত্রকে গণমানুষের কাছে নিয়ে যেতে চান নাজির। ছোটবেলা থেকে নিজের চারপাশে যা দেখেছেন, সবসময় চেষ্টা করেছেন সাবলীলভাবে সেসবই চিত্রকর্মে ফুটিয়ে তোলার। তিনি চান, তার ছবি দেখে যেন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন। ফুটপাতে ছবি আঁকার অনেক কারণের মধ্যে এটাও একটি কারণ- সাধারণ পথচারী, শ্রমজীবী মানুষ যেন ছবি দেখে, সুন্দর জিনিস দেখে। তার অংকনরীতিও সহজ। জটিল প্রক্রিয়া নেই। কখনো ব্যবহার করেন পেন্সিল, কখনো সাধারণ মানের রঙ।
নাজিরের মতে, আমাদের চারপাশে বড্ড বেশি অসুন্দর জিনিস, বরং সুন্দরে ভরিয়ে তোলা উচিত সব। "সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে পারে, সেজন্যই আমি রুট লেভেলে কাজ করছি। চারুকলা, শিল্পকলা, যাদুঘরে সাধারণ আমজনতা কিন্তু সহজেই ঢোকে না। তাদের তো নানারকম কাজ আছে। ফুটপাত হলো গণমানুষের। এখানে একজন রিক্সাচালক যেতে যেতে ছবি দেখছে, একজন পথচারী ছবি দেখছে, এটাই আমার অর্জন। পাবলিক প্লেসেই বেশি করে আর্ট প্রদর্শন করা উচিত।"
পৃষ্ঠপোষকতা পেলে স্বপ্ন দেখেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের
"কোনো শিল্পীকে কি দেখেছেন কোন একটি প্রাণীর ছবিকে আইকন করে এত এত ছবি আঁকতে?" প্রশ্নটি করেই নাজির জানালেন, এখন অবধি তিনি বাঘের ছবিই এঁকেছেন ৩০ হাজারের বেশি। এও জানালেন, বাঘের ছবি এঁকেই তিনি করতেন চান বিশ্বরেকর্ড।
"আমি দুই যুগ ধরে লাল-সবুজ পতাকা মাথায় ধারণ করি, অন্তরেও ধারণ করার চেষ্টা করি। এটাও একটা ভাবনা, পতাকা নিয়ে এত বেশি চিত্রকর্মও বোধয় আর কারো নেই। এটাও একটা রেকর্ড হতে পারে," বললেন নাজির।
তবে তৃণমূল থেকে উঠে আসা শিল্পীদের প্রতিনিয়ত যে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়, তা জানাতে ভুললেন না এই গুণী শিল্পী। তিনি নিজে নানা সময়ে ভুগেছেন পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। সঠিক মর্যাদা পেলে লোকশিল্প বিশ্বজয় করতো বলেও মত তার।
তবে স্বপ্ন দেখা থামাননি কখনো। আশা করেন, লোকশিল্প ও লোকশিল্পী, দুটোই একদিন ক্ষমতাবানদের সুনজরে আসবে। তার মত পথের শিল্পীরা পাবে সঠিক মর্যাদা, যেমনটা তাকে দিয়েছেন বিদেশী শিল্পরসিকগণ। তার স্বপ্ন ঢাকা শহরে লোকশিল্প দখল করবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। "আমি একটা স্বপ্ন দেখি- ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় লোকশিল্পের বড় বড় স্থাপনা হবে। আমাদের সন্তানেরা তো আর নকশিকাঁথা আঁকবে না, তারা অন্তত দেখবে আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি।"