দি একসরসিস্ট: অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও ভয় ও শিহরণ এখনও সতেজ
১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছিল উইলিয়াম ফ্রিডকিন পরিচালিত ভৌতিক চলচ্চিত্র দি একসরসিস্ট। এ মাসে প্রয়াত হয়েছেন ফ্রিডকিন । চলচ্চিত্রটিও পদার্পণ করেছে ৫০ বছরে। তবে অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আজও রক্তে শিহরণ জাগিয়ে তোলে সিনেমাটি।
চলচ্চিত্রটির মূল ভিত্তি ছিল উইলিয়াম পিটার ব্লেটির একই নামের উপন্যাস। বাংলায় এটি অনুবাদ করেছিলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। সেদিক থেকে বইটি বাংলাদেশের পাঠকদের অনেকের কাছেই পরিচিত।
১৯৭১ সালে পিটার ব্লেটির উপন্যাসটি বেরোনোর পর সে বছরই সিনেমার কাজে হাত দেন ফ্রিডকিন। একই বছর দ্য ফ্রেঞ্চ কানেকশন সিনেমার জন্য অস্কার জিতেছিলেন তিনি। সে সময় হরর বা ভৌতিক চলচ্চিত্রকে উন্নতমানের চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো না। কিন্তু ফ্রিডকিন ঠিক করেন তিনি পিটার ব্লেটির বইটিকেই চলচ্চিত্রের রূপ দেবেন।
তখন বড় পরিচালকদের ভেতর রোমান পলানস্কির রোজম্যারিস বেবি (১৯৬৮) ছাড়া বড় হাউজগুলোর ব্যানারে হরর সিনেমা তেমন একটা হতো না। কার্নিভাল অভ সোলস (১৯৬২) কিংবা নাইট অব দ্য লিভিং ডেড (১৯৬৮) সিনেমাগুলো সাফল্য পেলেও এগুলো ছিল স্বাধীন চলচ্চিত্র — বাজেটও ছিল সীমিত।
সে সময়কার হরর চলচ্চিত্রগুলো আমাদের কাছে পরিচিত করে তুলেছিল ভিনসেন্ট প্রাইস, ক্রিস্টোফার লি, পিটার কাশিংয়ের মতো অভিনেতাদেরকে। তবে হরর সিনেমা হতো অল্প বাজেটে, গৎবাঁধা কিছু ফর্মুলা নিয়ে।
ফ্রিডকিন একসরসিস্টকে বড় পর্দায় আনলেন এবং চমকে দিলেন সবাইকে। হরর চলচ্চিত্র সাধারণ ফর্মুলার ভেতর আর রইল না। সিনেমাটি মুক্তিও পেয়েছিল ওয়ার্নার ব্রাদার্স-এর মতো বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে।
মুক্তির পরপরই সিনেমাটি নিয়ে তৈরি হয় তুমুল শোরগোল। ১২ বছরের বালিকা রেগানের (লিন্ডা ব্লেয়ার) শরীরে আস্তানা গেড়ে বসা অশুভ আত্মা 'পাজুজু'কে তাড়াতে আসেন দুই যাজক। অভিনয়ে ছিলেন ম্যাক্স ফন সিডো (ফাদার মেরিন) ও জেসন মিলার (ফাদার কারাস)। রেগানের মা ক্রিস ম্যাকনিলের চরিত্রে ছিলেন এলেন বার্স্টিন।
সিনেমা মুক্তির আগে নির্মাণেই বেশ সময় চলে যায়। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন নানান অসুবিধার সম্মুখীন হন। ছবির কয়েকজন শিল্পীর পরিচিত কারও না কারওর মৃত্যু ঘটে ছবি মুক্তির আগে-পরে। তবে এর পেছনে কোনো অশুভ ব্যাপার ছিল বলে মনে করা যায় না।
সিনেমাটি মুক্তির পর ডিসেম্বরের সেই তীব্র শীতেও প্রেক্ষাগৃহের সামনে তৈরি হয় দর্শকদের বিশাল লাইন। একই সঙ্গে এর বিরুদ্ধেও তৈরি হয় নানা মত। যেমন ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে ছবিটি মুক্তি পাবার পর এটি দেখে মূর্ছা যান কয়েকজন দর্শক।
যাজকদের কাছ থেকে আসতে থাকে প্রতিবাদ। ছবিতে শয়তানে ধরা আত্মাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে সত্যিই খারাপ কিছু ঘটতে পারে বলে সাবধান করেন যুক্তরাজ্যের দুজন যাজক — ক্যানন জন পিয়ার্স হিগিন্স ও হেনরি কুপার।
ছবিটির প্রদর্শনী অনতিবিলম্বে বন্ধ না হলে দর্শকেরা খারাপ আত্মার খপ্পরে পড়বে, অনেকের সিজোফ্রেনিয়া হবে বলেও সাবধান করেন তারা। স্থানীয় কাউন্সিলগুলোর উদ্যোগে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে এর প্রদর্শনী বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অবশ্য এর কারণ শুধু যাজকদের সতর্কবার্তা নয়; ছবি দেখে দর্শকদের জ্ঞান হারানো, বমি করা, এমনকি হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঘটনাও ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে।
তবে দি একসরসিস্টকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। ১২ মিলিয়ন ডলার বাজেটের ছবিটি আয় করেছিল ৪৪১ মিলিয়ন ডলার। প্রথমবারের মতো কোনো হরর সিনেমা হিসেবে পেয়েছিল অস্কার মনোনয়ন। তার সঙ্গে সঙ্গে পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অন্যান্য হরর চলচ্চিত্রের জন্যও।
সিনেমাটিতে শয়তানের আছর ও এ থেকে মুক্ত করার প্রক্রিয়াগুলো গ্রাফিকালি বা একদম জীবন্তভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। দর্শকদের মনে হবে যেন সবকিছু তাদের সামনেই ঘটছে।
হরর চলচ্চিত্রে সাধারণত প্রেতাত্মা বা জম্বিদের এমনভাবে তুলে ধরা হয়, যাতে দর্শকদের ভেতর ভয়ের ভাব সঞ্চারিত হলেও তারা শেষপর্যন্ত এটিকে 'গল্প'ই মনে করেন। দি একসরসিস্ট সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। কাহিনীটি এমনভাবে সাজানো হয় যাতে ঈশ্বর ও শয়তানের প্রসঙ্গ আসে। ধর্মীয় এ ভাবাবেগ যোগ হওয়ায় এটিকে অনেকেই নিছক গল্প বলে ভাবতে পারেননি। বরং অনেক দর্শকের মনে হয়, এমনটা সত্যিই ঘটতে পারে যে কারওর সঙ্গে। তাই সিনেমায় দেখানো ভয় তাদের জীবনের একটি অংশই হয়ে ওঠে।
এছাড়া সিনেমায় থাকা সিঁড়ির সেই দৃশ্যটি ভয়ের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল দর্শক হৃদয়ে। এক্সরসিজম করানোর জন্য ফাদার দুজন যখন রেগানকে শূন্যে ভাসিয়ে তোলেন, তখন প্রচণ্ড ঠান্ডায় প্রত্যেকের নিঃশ্বাস সাদা ধোঁয়ার মতো বেরিয়ে বাতাসে মেশে। ফ্রিডকিন কৃত্রিম ঠান্ডা পরিবেশ তৈরি করে সচেতনভাবেই দৃশ্যটি ধারণ করেছিলেন, যেন নিঃশ্বাসও মূর্ত হয়ে ওঠে।
সিনেমায় শয়তানের উপস্থিতি বিশ্বাসী দর্শকদের আরও বেশি ভয়ের দিকে ঠেলে দেয়। কারণ যাদের মৌলিক ধর্মবিশ্বাস আছে, তাদের কাছে ঈশ্বরের পাশাপাশি শয়তানও অস্তিত্ব রাখে। ফলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অন্য সিনেমার ভূতদের মতো এ প্রেতকে তাদের মস্তিষ্ক নাকচ করে দিতে পারেনি। তাই সিনেমার এ অতিপ্রাকৃত ঘটনা দর্শকদের চোখে খুবই বাস্তব ও সম্ভবপর হয়ে ওঠে।
দি একসরসিস্ট-এর তুমুল সাফল্য ভৌতিক চলচ্চিত্রকে 'ভালো চলচ্চিত্রের' সম্মান যেমন এনে দেয়, তেমনি বাস্তবের আরও কাছাকাছি হওয়ার অণুপ্রেরণাও দেয়। ফলে প্রেত বা ভৌতিক সত্ত্বা পারিপার্শ্বিকের একটি অংশই হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে হরর জঁরাতেই আমূল পরিবর্তন তৈরি হয়।
সিনেমাটি থেকে অনুপ্রেরণা নেন পরবর্তী অনেক পরিচালক। ডেভিড ক্রনেনবার্গের শিভার্স (১৯৭৫) ও র্যাবিড (১৯৭৭) সিনেমায় দেখা যায় দি একসরসিস্ট-এর ছাপ। রিচার্ড ডোনারের দি ওমেন (১৯৭৬)-কে দি একসরসিস্ট-এর একটি মানসম্মত সংস্করণ বলা চলে। আর স্টিভেন স্পিলবার্গের জস (১৯৭৫)-এর কথা তো সর্বজনবিদিত। সিনেমাটি হররকে প্রাত্যহিক জীবনের একটি অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দি একসরসিস্ট-এর ঋণ আবারও স্বীকার করে। রিডলি স্কটের এলিয়েন (১৯৭৯) সিনেমায়ও আমরা দেখি দি একসরসিস্ট-এরই অনুসরণ। এমনকি তিন দশক পর ২০০৩ সালে রাম গোপাল ভার্মা যে ভূত সিনেমাটি বানালেন, সেটি দেখতে গেলেও আমাদের মনে পড়বে ফ্রিডকিনের সিনেমার কথা।
অর্ধশতাব্দী পরে এসেও তাই দি একসরসিস্ট চিরসবুজ। সিনেমার হররকে জীবন থেকে বা কাহিনীর চরিত্রগুলো থেকে আলাদা করে নয়, বরং মুখ্য একটি চরিত্রের ভেতরই বাস করতে দেখিয়েছে এটি। এর ফলে সিনেমায় ভয় হয়ে উঠেছে পরিবেশের একটি অংশ। আর এ ভয়ের অনবদ্য ও জীবন্ত চিত্রায়ন পালটে দিয়েছে হরর সিনেমার খোল-নলচে। তাই অর্ধশতক পেরিয়েও দি একসরসিস্ট ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক, নির্দ্বিধায় চিরায়ত।