হেমন্ত মুখোপাধ্যায়: সুরের আকাশে শুকতারা
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা শুনলেই কানে বেজে ওঠে চমৎকার মন্ত্রমুগ্ধ এক কণ্ঠ। ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পরলোকে পাড়ি জমান এই মহান শিল্পী ও সুরস্রষ্টা। প্রধানত কণ্ঠশিল্পী হিসেবে খ্যাতিমান হলেও সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন হেমন্ত।
১৯৪৭ সালে অভিযাত্রী সিনেমা দিয়ে সংগীত পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এরপর ১৯৪৮ সালে ভুলি নাই সিনেমার সংগীত পরিচালনা এবং ১৯৫১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হেমেন গুপ্তের '৪২ সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা তাকে সুরকার হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়। তারপর হেমেন গুপ্তের আমন্ত্রণেই বোম্বে যাত্রা করেন হেমন্ত। সেখানে গুপ্তের পরিচালনায় আনন্দ মঠ (১৯৫২) ছবির সংগীত পরিচালনা করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নাগিন সিনেমায় 'মান দোলে মেরা তান দোলে' গানের প্রিলিউডে তার তৈরি করা সুরটি পরবর্তীকালে সাপের সিনেমার সিগনেচার টোন হয়ে ওঠে। নাগিনের তুমুল সাফল্যের পর পঞ্চাশ দশকে বলিউডের আরও কিছু সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করেন হেমন্ত। তবে কাজের ক্ষেত্রে সচেতন হেমন্ত বেছে বেছেই কাজ নিতেন।
এর ভেতর আবারও কলকাতার সিনেমায় কাজ করতে চাইছিলেন তিনি। সে সুযোগও এসে গেল শাপমোচন (১৯৫৫) ছবির সুবাদে। কথা ছিল শচীন দেববর্মণ সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা করবেন। তিনি সময় দিতে না পারায় ঘটনাচক্রে ছবির পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হেমন্ত। এ সিনেমাটি তুমুল সাফল্য পায়। 'সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা', 'শোনো বন্ধু শোনো' কিংবা 'ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস'-এর মতো গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এরপর হিন্দির তুলনায় বাংলা সিনেমাতেই বেশি সময় দিতে থাকেন হেমন্ত।
এর আগে ১৯৫১ সালে অজয় করের জিঘাংসা সিনেমায় সুরারোপের কাজ করেছিলেন হেমন্ত। এটি ছিল শার্লক হোমসের দ্য হাইন্ড অভ দ্য বাস্কারভিলস-এর বাংলা রূপায়ণ। সেই অজয় করের সিনেমা হারানো সুর-এ (১৯৫৭) সুর দিলেন হেমন্ত। এ সিনেমা থেকে 'তুমি যে আমার' কিংবা 'আজ দুজনার দুটি পথ'-এর মতো কালজয়ী গান উপহার পায় বাঙালি।
হেমন্ত তারপর ক্রমান্বয়ে আরও অনেক ছবিতে সুর দিয়েছেন। জীবদ্দশায় ১৪৭টি বাংলা চলচ্চিত্রে সুরারোপ করেছেন তিনি। এ তালিকায় আছে নীল আকাশের নীচে (১৯৫৮), দ্বীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯), মরুতীর্থ হিংলাজ (১৯৫৯), বাইশে শ্রাবণ (১৯৬০), সপ্তপদী (১৯৬১), দাদা ঠাকুর (১৯৬২), পলাতক (১৯৬৩), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), দাদার কীর্তি (১৯৮০), পাকা দেখা (১৯৮০) ইত্যাদি।
এসব সিনেমার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে হেমন্তের ঐন্দ্রজালিক সুর। 'এইতো হেথায় কুঞ্জছায়ায়', 'মুছে যাওয়া দিনগুলি', 'এই রাত তোমার আমার', 'পথের ক্লান্তি ভুলে', 'ও নদীরে', 'এই মেঘলা দিনে একলা', 'এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু', 'যে বাঁশি ভেঙে গেছে', 'ভুল সবই ভুল', 'জীবনপুরের পথিক রে ভাই', 'নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা', 'ও আকাশ সোনা সোনা', 'ও রাধে থমকে গেলি কেন', 'ফুলেশ্বরী, ফুলেশ্বরী', 'যমুনাতে দেখলাম সই', 'কিছু পেলাম আমি', 'চরণ ধরিতে দিও গো আমারে', 'খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে'-এর মতো এখনো সমান শ্রোতাপ্রিয় গান রয়েছে এ ছবিগুলোতে।
হেমন্ত হিন্দিতেও এক হি রাস্তা, এক ঝালাক, পায়াল, দো মাস্তানে, বিস সাল বাদ, সাহেব বিবি ওউর গোলাম, কোহরা, বিবি ওউর মাকান, মঝলি দিদি, খামোশি, রাহগির, বিস সাল পেহলে-এর মতো সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করেছেন।
এ তো গেল সিনেমার কথা। এর বাইরেও সুরস্রষ্টা হিসেবে মাধুর্যের ছাপ রেখেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। লতা মঙ্গেশকরের 'প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে', প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কত যে কথা ছিল', কিশোর কুমারের 'আমার পূজার ফুল' কিংবা 'চোখের জলের হয়না কোনো রং'-এর মতো গানগুলোর সুরকারও যে হেমন্তই।
হেমন্তের সুরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এর সাবলীলতা ও প্রাচ্যের নিজস্ব ধাঁচ রক্ষা। সুধীন দাশগুপ্ত কিংবা সলিল চৌধুরীর সুরে আমরা পাশ্চাত্যের জ্যাজ ও ব্লুজ সংগীতের দুর্দান্ত প্রয়োগ দেখেছি। হেমন্ত সে তুলনায় সেভাবে পাশ্চাত্য অভিমুখী নন। যেখানে যে রাগ যতটুকু দরকার, ততটুকুই ব্যবহার করে তিনি সুরে নানান রাগের সমন্বয় করতেন। 'এই পথ যদি না শেষ হয়'-এ যেমন হামিংয়ে একরকম সুর ও গানে প্রবেশের পর প্যাটার্ন বদলে আরেক রকম সুর। আবার 'সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়' গানে যেমন স্থায়ী বা মুখড়া অংশের সুর অন্তরা ও সঞ্চারীতে গিয়ে ভিন্ন রূপ লাভ করে।
হেমন্তের সুরে রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণের ছাপ পাই আমরা। তার সুরের একটি বিশেষ দিক আলাদাভাবে সঞ্চারী তৈরি করা। গানের তৃতীয় স্তবকে রবীন্দ্র আদলে হেমন্ত আলাদাভাবে সঞ্চারী তৈরি করতেন। যেমন 'যে বাঁশি ভেঙে গেছে' গানে 'একদা সুরে সুরে দিতো যে হৃদয় ভরে/দেখো তার গানের বীণা ধুলায় পড়ে', কিংবা 'আমার পূজার ফুল' গানে 'জানিনা কেমন করে কী দেব তোমায়/মন ছাড়া আর কিছু নেই তো আমার'। 'প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে' গানের 'যে আলো হয়ে এসেছিল কাছে মোর/তারে আজ আলেয়া যে মনে হয়/এ আঁধারে একাকী এ মন আজ/আঁধারেরই সাথে শুধু কথা কয়' — হেমন্তের তৈরি অনবদ্য সঞ্চারীর আরেকটি উদাহরণ।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গানের সুরের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতেন কথা ও পরিস্থিতির ওপর। তাই তার সুরে বেশ বৈচিত্র্যও পাওয়া যায়। 'জীবনপুরের পথিক রে ভাই'-এর সুরকার তাই 'শিং নেই তবু নাম তার সিংহ'-রও সুরকার। প্রতিটি দশকের সঙ্গে মানানসই করে তার সুরারোপের কাজ করেছেন হেমন্ত। গানের কথা অনুযায়ী সুর নির্মাণের ফলে গানের বাণীগুলোর অর্থবহতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে তার সুরে। এর সঙ্গে সবসময়ই তার সঙ্গী ছিল মেলোডি। সত্তর দশকের শেষভাগ ও আশির দশকে এসেও বোম্বের ধাঁচের সুর রচনা করেননি তিনি। বরং বাংলায় তার মেলোডির ছাপ রেখে গেছেন দশকের পর দশক।
তবে এত বিপুল সাফল্যের ভেতরও গোলাপে থাকা কাঁটার মতো তাকে বিদ্ধ করেছিল মহালয়ার গান। তার অনুরোধেই উত্তম কুমার রাজি হয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জায়গায় কথিকা পাঠ করতে। পঙ্কজ মল্লিকের জায়গায় হেমন্ত নিয়েছিলেন সুরারোপের দায়িত্ব। সাংগীতিকভাবে হেমন্ত নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছিলেন, কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও পঙ্কজ মল্লিকের জায়গায় উত্তম ও হেমন্তকে সাধারণ মানুষ একেবারেই মানতে পারেননি।
সামগ্রিক সংগীতজীবনে হেমন্ত তার সুরে সহজ লাবণ্য ও সুরের সাবলীল পরিচালনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে তেমনভাবে পাশ্চাত্যমুখী না হয়েও বাংলার আলো-হাওয়া-জলে হেমন্তের সুর খুঁজে নিয়েছে আপন ঠিকানা। গায়ক হেমন্তের পাশাপাশি সুরকার হেমন্তও তাই চিরায়ত আসন করে নিয়েছেন বাংলা গানে, 'সুরের আকাশে শুকতারা' হয়ে।