‘কম্পিউটার জগৎ’ যেভাবে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশিত আইটি ম্যাগাজিন
বাংলাদেশের সবুজ মানচিত্র, দেখতে কিছুটা ঘোড়ার মতো, যাতে রয়েছে আবার কম্পিউটার। একইসাথে দেখা যাচ্ছে, একজন দুষ্ট লোক দেশের গতিকে বাধাগ্রস্ত করতে লাগাম টেনে ধরছে। বলছিলাম ১৯৯১ সালের মে মাসে সর্বপ্রথম প্রকাশিত মাসিক ম্যাগাজিন কম্পিউটার জগৎ এর কথা। যার প্রচ্ছদটি করেছিলেন বিশিষ্ট কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব।
ম্যাগাজিনটির স্লোগান ছিল 'জনগণের হাতে কম্পিউটার'। একইসাথে ম্যাগাজিনটিতে একটি কভার স্টোরি ছাপা হয়। যেটি লিখেন বিখ্যাত সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তান; যিনি ১৯৯০ এর দশকে বাংলায় আইসিটি সম্পর্কে প্রতিবেদনও তৈরি করেছেন।
প্রফেসর এম এ কাদের নিজ পরিকল্পনায় কম্পিউটার জগৎ ম্যাগাজিনটি প্রকাশ শুরু করেন। এটি বর্তমানে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা আইটি ম্যাগাজিন। ১৯৮০-এর দশকে 'কারিগর' নামে একটি বাংলা আইটি ম্যাগাজিন বাজারে খ্যাতি অর্জন করেছিল। তবে এটি কম্পিউটার জগতের মতো তেমন প্রভাব তৈরি করতে পারেনি।
করোনা মহামারী চলাকালীন ম্যাগাজিনটির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ২০২০ সালের এপ্রিলে ম্যাগাজিনটির শেষ মুদ্রিত কপি ধানমন্ডির অফিস থেকে প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে কম্পিউটার জগৎ ম্যাগাজিনটি ১৬ জন সদস্যের একটি দল দ্বারা পরিচালিত হয়। এখন শুধু অনলাইন ভার্সনে ম্যাগাজিনটি চালু রয়েছে।
বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কম্পিউটার জগতের নির্বাহী সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল হক অনু বলেন, "আপনি আমাদের আর্কাইভ বিভাগে পত্রিকাটির পিডিএফ কপি বিনামূল্যে পাবেন। আমাদের কাছে একটি অ্যাপও রয়েছে যেখানে আপনি আমাদের কপিগুলি পাবেন।"
১৯৯১ সালে ম্যাগাজিনটি প্রতি কপি ১০ টাকা বিক্রি হতো। ২০২০ সালে প্রতি কপির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭০ টাকা। আর মোট সার্কুলেশনের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার।
আব্দুল হক অনু বলেন, "আমরা অনেকটা ভর্তুকির ভিত্তিতে চলছি। কয়েকটি ছোট বিজ্ঞাপন পাই; কিন্তু তা ছাড়া পত্রিকাটির তেমন কোনো আয় নেই। প্রতিদিন আমরা ২০ টি পর্যন্ত লেখা তুলি যা মাসে প্রায় ৬০০ লেখার মতো হয়। প্রতি মাসে আমাদের প্রায় ৫ লাখের বেশি পাঠক এবং ২ লাখের বেশি ফেসবুক এনজগেজমেন্ট রয়েছে৷"
কম্পিউটার জগতের কন্টেন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রোডাক্টের রিভিউ করা, কোম্পানি ওপেনিংয়ের নিউজ করা, আইটি ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপস, নতুন সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ইত্যাদি।
২০১০ সালে ম্যাগাজিনটির পক্ষ থেকে একটি সার্ভে করা হয়। সেখানে দেখা যায়, তাদের প্রায় ৭০ ভাগ গ্রাহকই তরুণ। আর ১৫ ভাগ বিজনেস কমিউনিটির লোকজন আর বাকিরা পলিসি মেকার।
বাংলাদেশ সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩টি পাক্ষিক, ১৬টি মাসিক এবং একটি ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। এছাড়াও সারা দেশে ৬৩ টি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। যদিও এই প্রতিবেদনে কোনটি সংবাদপত্র আর কোনটি ম্যাগাজিন সেটি আলাদা করে উল্লেখ করা হয়নি।
তবে এরমধ্যে কিছু কিছু ম্যাগাজিন ও পাবলিকেশন বেশ দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। যার মধ্যে ক্রীড়া জগৎ (১৯৮২), দেশ (১৯৭৭), নিরিক্ষা (১৯৮০) এবং রবার (১৯৭৯) অন্যতম। এরমধ্যে কম্পিউটার জগৎ সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রকাশিত হওয়া দেশের আইটি ম্যাগাজিন।
১৯৯৬ থেকে ২০০০: ম্যাগাজিনটির স্বর্ণযুগ
১৯৯১ সালে ম্যাগাজিনটি যাত্রা শুরু করলেও প্রথমদিকে খুব একটা ভালো সময় পার করেনি। ম্যাগাজিনটির অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয় যে, এর বর্তমান প্রকাশক নাজমা কাদের, যিনি কি-না এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আব্দুল কাদেরের স্ত্রী, বিল পরিশোধ করতে নিজের গহনা বিক্রি করেছিলেন।
আব্দুল হক অনু বলেন, "তখন আমাদের খুব বেশি বিজ্ঞাপন ছিল না। এছাড়াও, আমাদের ম্যাগাজিনের একটি নীতি ছিল যে, আমরা আইটি বা কম্পিউটার-সম্পর্কিত নয় এমন কোনো কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রকাশ করব না।"
কেউ যদি ম্যাগাজিনটির প্রথম দিকের পাতাগুলো দেখেন, তবে দেখতে পাবেন যে তেমন কোনো বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনই নেই। উদাহরণসরুপ, ১৯৯৪ সালের জুনে প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিনের মোট ৭ টি বিজ্ঞাপন দেখা যায়। এরমধ্যে মাইক্রোলজিস্ট সিস্টেমস অ্যান্ড সলিউশন, অনন্ত জ্যোতি – এ কম্পোজ, লেজার প্রিন্টিং এন্ড ডেটা এন্ট্রি শপ, কম্পিউটার সেন্টার, ম্যাপল কম্পিউটার, ইনফোটেক লিমিটেড, বাংলাদেশ কম্পিউটার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড কম্পিউটারলাইন অন্যতম।
এদিকে ১৯৯৬ সালে সরকার ঘোষণা করে যে, কম্পিউটারের ওপর কোন ট্যাক্স আরোপ করা হবে না। ঠিক ঐ সময়টিতেই ম্যাগাজিনটি আন্তর্জাতিক কম্পিউটার ব্র্যান্ড যেমন এইচপির পক্ষ থেকে বড় অঙ্কের বিজ্ঞাপন পেতে থাকে।
এ সম্পর্কে আব্দুল হক অনু বলেন, "অনেকেই একটি কম্পিউটার কিনতে পারলেও সেটি পরিচালনা করার মতো ম্যানুয়াল জানা ছিল না। একইসাথে কম্পিউটার সাইন্স বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ছাড়া অন্য লোকদের শেখানোর জন্য তেমন কোনো প্রশিক্ষকও ছিল না। যেহেতু কম্পিউটার জগৎ প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার, ডাটাবেস, আইসিটি ইত্যাদি নানা বিষয়ে লিখছিল, তাই লোকেরা তখন এই ম্যাগাজিনটিতে সাবস্ক্রাইব করছিল। বিশেষত তখন একটি টিউটোরিয়াল খোঁজার জন্য গুগলের মতো কিছু ছিল না।"
১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কম্পিউটার জগৎ ম্যাগাজিনটির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এবং মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশে কম্পিউটার এবং এর সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলির ব্যবসাকে প্রসারিত করে।
'আমাদের গ্রাম' প্রজেক্টের ডিরেক্টর রেজা সেলিমের ২০১৮ সালে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে বলা হয়, "প্রথম দিকে অল্প কয়েকজন কম্পিউটার ডিলার ডিস্ট্রিবিউটর ব্যবসায় সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু এদেশের তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডকে ঘিরে গড়ে ওঠা কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ দেশে আমদানি করার যে উদ্যোগ, সেটিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কম্পিউটার জগৎ সেই দোকানের বিজ্ঞাপনগুলি সস্তায় প্রকাশ করেছিল, এমনকি অনেক সময় বিনামূল্যেও৷"
২০১০ সালে সরকার ঘোষণা করে যে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি স্কুল-কলেজের কারিকুলামে বাধ্যতামূলকভাবে সংযোজন করা হবে।
আব্দুল হক অনু বলেন, "তখন শহরাঞ্চলে বসবাসকারী লোকেরা প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ইন্টারনেটও এত সহজলভ্য ছিল না। তারপর তারা আমাদের ম্যাগাজিনে সাবস্ক্রাইব করতে শুরু করে। আমরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীয়ের জন্য প্রশ্ন সমাধানের মতো বিষয়গুলো যুক্ত করা শুরু করি।"
২০১০ সালের দিকে ম্যাগাজিনটি আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কিত কন্টেন্ট ছাপাতে থাকে। এমনকি একটি গ্রাহক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে যারা কি-না শুধু আউটসোর্সিং শেখার জন্যই সাবস্ক্রিপশন নিতেন। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে ম্যাগাজিনটির প্রচ্ছদে টেলিকম ও ভিওআইপি শিল্পে আউটসোর্সিংয়ের সুযোগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
ম্যাগাজিনটির দলের মতে, এটি শুধু একটি তথ্য সরবারাহের প্রকাশনা নয়। বরং ম্যাগাজিনটি এর চেয়েও বেশি কিছু। এ সম্পর্কে আব্দুল হক অনু বলেন, "আইটি কোম্পানি ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য আমরা নীতিনির্ধারকদের সাথে গোলটেবিল বৈঠক, ই-কমার্স মেলা এবং ট্রেডের আয়োজন করে থাকি।"
গুগল যুগের আগে তথ্য সোর্সিং
১৯৯১ সালের মে মাসে ম্যাগাজিনটির প্রথম সংস্করণে লিখেছিলেন বেশ নামীদামী ব্যক্তিরা। এরমধ্যে ছিলেন তৎকালীন সময়ের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক মোঃ আজিজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মোঃ ইব্রাহিম, বুয়েটের সিএসই ডিপার্টমেন্টের প্রধান সৈয়দ মাহবুব রহমান। এছাড়াও লেখকদের মধ্যে ছিল বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা শিক্ষার্থীরা এবং স্যামসাংয়ের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটররা।
অনু বলেন, "পেশাজীবী, শিক্ষক ও ছাত্ররা আমাদের জন্য তথ্যের একমাত্র উৎস ছিল। কেননা তারাই তখন আইটি সেক্টর সম্পর্কে জানত। তাছাড়া আমাদের কাছে কন্টেন্ট আইডিয়া পাওয়ার মতো বিকল্প কিছু ছিল না।"
তবে কিছুদিনের মধ্যেই তথ্য সংগ্রহের একটি সূত্র পাওয়া যায়। প্রফেসর আব্দুল কাদেরের একজন বন্ধু ছিল যিনি কি-না বিশ্বব্যাংকের হয়ে চাকরি করতেন। সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের অফিসে পিসি ম্যাগাজিন, পিসি কোয়েস্ট, পিসি ওয়ার্ল্ড, বিজনেস উইক, টাইমস ইত্যাদির মতো আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনগুলি সাবস্ক্রাইব করা ছিল। জনাব কাদের প্রতি মাসে এক সপ্তাহের জন্য এগুলি ধার করতেন এবং ম্যাগাজিনের কর্মীরা সেগুলি পড়তেন।
অনু বলেন, "ঐ ম্যাগাজিনগুলোতে এত কন্টেন্ট ছিল যে, আমরা মাত্র এক সপ্তাহে সেগুলো পড়ে শেষ করতে পারতাম না। তাই আমরা সেই ম্যাগাজিনগুলির কপি তৈরি করতাম এবং এভাবেই আমরা আইটি সম্পর্কে তথ্য পেতাম।"
এরপর যখন মাসিক সংখ্যা বের করার জন্য সকল কন্টেন্ট ঠিক হয়ে যেত, তখন পত্রিকাটির পক্ষ থেকে প্রচ্ছদের জন্য আহসান হাবিবের সাথে যোগাযোগ করা হতো। সে তখন সকল আইডিয়া শুনে একটি প্রচ্ছদ ডিজাইন করে দিতেন।
তবে ম্যাগাজিন প্রকাশের ক্ষেত্রে ছবি সংগ্রহের কাজটি বেশ কঠিন ছিল। কেননা তখন আজকের মতো গুগল ছিল না। তাই ম্যাগাজিনের কর্মীরা কম্পিউটারের দোকান, ডিস্ট্রিবিউটর, বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব ইত্যাদি জায়গায় গিয়ে যন্ত্রপাতির ছবি তুলে নিয়ে আসতো।
১৯৯৩ সালের মার্চের সংস্করণে ম্যাগাজিনটি শেষবারের মতো নিজেদের নামে বাংলা ফন্টের ব্যবহার করে। ঐ বছরের এপ্রিল থেকে বর্তমানে যে লোগোটি রয়েছে, সেটির ব্যবহার শুরু হয়। এই লোগোটি মূলত নির্ঝর নামের একজন এঁকে দিয়েছিলেন।
অনু বলেন, "শুরুর দিকে আমরা যখন আন্তর্জাতিক লেখাগুলি অনুবাদ করছিলাম, তখন আমরা শব্দগত জায়গা থেকে বেশ সমস্যা ভোগ করছিলাম। আইটি সম্পর্কিত শব্দগুলোর বেশিরভাগই ইংরেজি। এটা নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল যে, আমাদের হুবুহু ইংরেজি নামটিই ব্যবহার করা উচিত না-কি সেটিকে অনুবাদ করে বাংলা করা উচিত। আমরা মূলত মানুষদেরকে ইন্ডাস্ট্রির সাথে পরিচয় করাতে চাচ্ছিলাম। তাই আমরা অনুবাদ না করে বরং একই শব্দ ব্যবহার করতে থাকি।"
সময়ের সাথে সাথে যেন ম্যাগাজিনটি আরও প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিল। অনু বলেন, "প্রযুক্তির অগ্রগতি ও তথ্যের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা ক্রমাগত নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করছি কীভাবে আমরা প্রাসঙ্গিক থাকতে পারি। আমাদের বেশ কিছু পরিকল্পনা ও আইডিয়া রয়েছে। আশা করি আমরা পরের বছর যখন আমাদের পত্রিকাটিকে আবার প্রিন্ট সংস্করণে আনব তখন সেগুলি বাস্তবায়ন করতে পারব।"
ম্যাগাজিনটির যাত্রা শুরু
প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল কাদের ছিলেন একজন সরকারি কলেজের শিক্ষক। কিন্তু তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন। ১৯৬৪ সালে সে যখন স্কুলে ছিলেন, তখন শিশুদের জন্য প্রকাশিত বিজ্ঞানভিত্তিক ম্যাগাজিন 'তোরে তোক্কা' কিনেছিলেন।
১৯৮৭ সালে প্রফেসর কাদের একটি কম্পিউটার কোর্স করেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে কম্পিউটার ও এই সম্পর্কিত ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ঠিক তখনই তিনি বাংলায় একটি কম্পিউটার ম্যাগাজিন প্রকাশের কথা ভাবেন।
এক্ষেত্রে ম্যাগাজিনটি প্রকাশের ক্ষেত্রে মূল ধারণা ছিল, মানুষকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন করা। একইসাথে বাংলায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কম্পিউটার এবং এই সংক্রান্ত বিভাগে শিক্ষিত করা।
১৯৯১ সালের মে মাসে কম্পিউটার জগতের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। প্রফেসর কাদের যেহেতু একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন তাই তৎকালীন সময়ে পত্রিকাটির প্রকাশক হিসেবে থাকেন নাজমা কাদের।
ম্যাগাজিনটির প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রফেসর কাদের দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কনটেস্ট, ইন্টারনেট ফেয়ারের আয়োজন করেন। একইসাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক সারা দেশের স্কুলে কম্পিউটার বিতরণের উদ্যোগ নিলে তাকে ঐ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
কম্পিউটার জগৎ দেশের বেশ কিছু সুপরিচিত আইটি ব্যক্তিত্বের সাথে যুক্ত আছে। এদের মধ্যে মোস্তফা জব্বার, ডক্টর জামিলুর রেজা চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং নাজিম উদ্দিন মোস্তান ছাড়াও আরও অনেকে রয়েছেন।
রেজা সেলিম প্রকাশিত ২০১৮ সালের আর্টিকেলে বলা হয়, "কাদের ভাইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল কীভাবে এই প্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসা যায়। তার এই কাজে মোস্তান ভাই পাশে ছিলেন। ভূঁইয়া ইনাম লেনিন, যিনি পরে 'কম্পিউটার বিচিত্রা' নামে একটি প্রকাশনা শুরু করেছিলেন, কম্পিউটার সম্পর্কিত লেখার জন্য তিনি আমাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আমার দৃষ্টিতে লেনিন ভাই ও মোস্তান ভাই কাদের ভাইয়ের স্বপ্নকে অনেক দূর নিয়ে গেছেন।"
২০০৩ সালে অধ্যাপক কাদেরের মৃত্যুর পর নাজমা কাদের পত্রিকার সাথে পুরোপুরি যুক্ত হন। ম্যাগাজিনটির শুরুর দিকে তিনি ম্যানেজমেন্টের সাথে জড়িত ছিলেন। একইসাথে এর ব্যবসায়িক দিকগুলি তদারকি করতেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে অধ্যাপক কাদের অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পুরোপুরি দায়িত্ব নিতে হয়।
ম্যাগাজিনটির সাবেক সম্পাদক গোলাপ মুনীর, সাবেক সহ-সম্পাদক মঈনুদ্দিন মাহমুদ স্বপন এবং বর্তমান নির্বাহী সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল হক অনুর সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম নাজমা কাদেরকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন।
প্রফেসর আব্দুল কাদেরের ছেলে মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বর্তমানে ম্যাগাজিনটির সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। তিনি বলেন, "অধ্যাপক কাদের জীবদ্দশায় যে অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন তারা চাননি যে ম্যাগাজিনটি বন্ধ হয়ে যাক। মুস্তাফা জব্বার, ডক্টর জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদের মতো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি পত্রিকাটি চালু রাখতে তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।"
অনু জানান, ওয়াহেদ তমাল ২০০৭ সালে ম্যাগাজিনটিতে যুক্ত হয়। ম্যাগাজিনটির জন্য তার প্রথম উদ্যোগ ছিল আগের সংস্করণগুলোকে ডিজিটালাইজ করা। আর্কাইভটি সম্পন্ন করতে আমাদের প্রায় তিন বছর সময় লেগে গিয়েছিল।
২০১০ সালে কম্পিউটার জগৎ দীর্ঘ ১৩০ বছর ধরে যে ৩৬০ টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলোর অনলাইন আর্কাইভ সম্পন্ন করে। আর্কাইভ সম্পর্কে অনু বলেন, "এটি একটি সম্পদ, একটি ঐতিহাসিক সংরক্ষণ। কারণ কম্পিউটার জগৎই একমাত্র ম্যাগাজিন যেটি গত ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিবর্তনের নথিভুক্ত করে আসছে।""
বর্তমানে ম্যাগাজিনটি অনলাইন ভার্সন থেকে আয়ের চেষ্টা করছে। একইসাথে আগামী মার্চ মাস থেকে ফের প্রিন্ট ভার্সন শুরুরও পরিকল্পনা করছে। তমাল বলেন, "আমরা ২০০৯ সালে লাইভ ব্রডকাস্টিং সার্ভিসে উদ্যোগী হয়েছিলাম যখন ফেসবুক বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে নতুন ছিল।"
একই বছরে ম্যাগাজিনটি কমজগত টেকনোলজিস লিমিটেড নামের একটি টেক সলিউশন কোম্পানি তৈরি করে যেটি ফিনটেক, ই-লার্নিং এর মতো সেবা দিয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় কোম্পানিটি ২০০৯ সালে মন্থন পুরস্কার এবং পরবর্তীতে এটুআইয়ের পক্ষ থেকে সার্ভিস ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
২০১৩ সালে কম্পিউটার জগৎ টিম দেশের প্রথম ই-কমার্স মেলার আয়োজন করে। এতে সহযোগী হিসেবে ছিলেন সরকারের আইসিটি ডিভিশন ও ঢাকায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। পরবর্তীতে দেশের অন্য জেলাগুলোতেও ম্যাগাজিনটির পক্ষ থেকে ই-কমার্স মেলার আয়োজন করা হয়।
২০১৫ সালে সরকারের রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার আগে কম্পিউটার জগতের অফিস থেকেই ই-ক্যাব পরিচালিত হতো। অ্যাসোসিয়েশনটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তমাল আর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজিব আহমেদ।
প্রিন্ট বনাম অনলাইন
'মুদ্রণ বনাম অনলাইন' নিয়ে ১৯৯০ এর দশক থেকেই প্রকাশনা শিল্পে বিতর্ক চলছে। করোনা মহামারী যেন সেই বিতর্ককে পূর্বের তুলনায় আরও উস্কে দিয়েছে।
এ বিষয়ে তমাল বলেন, "তবুও আমি প্রিন্ট মিডিয়াকে ঘিরে অনেক আশাবাদী। যদিও আমাদের মুদ্রিত সংস্করণটি বন্ধ করতে হয়েছিল। তবে পরবর্তী বছর থেকে এটি পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।"
অনু স্বীকার করে বলেন যে, "মুদ্রাস্ফীতির কারণে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি কিছুটা টালমাটাল। প্রিন্ট চালানোর জন্য আমাদের বিজ্ঞাপন থেকে যে আয় দরকার, সেটা অর্জিত হবে না। আমরা নির্বাচন ও অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার অপেক্ষায় আছি। এর পরে আমরা নতুন করে সময় নির্ধারণ করব।"
ম্যাগাজিনটি দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজেদের মুদ্রিত কপি প্রচারের পরিকল্পনা করছে। তারা দু'জনেই এই বিষয়ে একমত যে, অনলাইন মিডিয়ার কন্টেন্ট মনিটাইজেশন শুরু হওয়ার পর নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যার ফলে হয়তো প্রিন্ট মিডিয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা করা যেতে পারে।
অনু ও তমাল বলেন, "কম্পিউটার জগৎ নিয়ে আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে বলতে পারি যে, ১৯৯০-এর দশকে টিকে থাকার জন্য জন্য আমরা আর্থিকভাবে যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি সেটি বর্তমানের চেয়েও বেশি। বর্তমানে শুধু প্রিন্ট এবং অনলাইনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।"
কম্পিউটার জগৎ – ম্যাগাজিন এবং আইটি ফার্ম?
তমাল বলেন, "আপনি দুটোই বলতে পারেন। সর্বপ্রথম এটি একটি আইটি ম্যাগাজিন যেটি বর্তমানে অনলাইনে চলছে। এছাড়াও আমাদের আরও দুটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ রয়েছে যা কমজগত টেকনোলজিস লিমিটেডের অধীনে।"
এরমধ্যে একটির নাম গোকন; যেটি লাইভ স্ট্রিমিং ও লাইভ ওয়েবকাস্ট সলিউশনের কাজ করে থাকে। আর অন্যটি হচ্ছে ব্র্যান্ডেলা; যেটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের বিষয়ে কাজ করে থাকে।
তমাল আরও বলেন, "আমরা মূলত আয়ের ক্ষেত্রে একটি মডেল তৈরির চেষ্টা করছি যার সাহায্যে আগামী বছরগুলিতে ম্যাগাজিনের, বিশেষ করে মুদ্রণ সংস্করণের প্রকাশ নিশ্চিত করতে পারি। এক্ষেত্রে আমাদের হাতে কিছু আইডিয়া রয়েছে যেটির ওপর আমরা কাজ করতে পারি।"