ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা রিভারক্রুজ: যা জানা দরকার
ঘুমঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে উঠে বেরিয়ে কুয়াশা মোড়া ভোরের আলোয় যদি দেখতে পান গহীন বনের পাশ দিয়ে ছুটে চলছেন জাহাজে ভেসে কিংবা ডেকের উপর সকালের মিষ্টি রোদে গা এলিয়ে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে অপেক্ষা করছেন 'সিটি অভ জয়' খ্যাত কলকাতায় পা রাখার! একঘেঁয়ে জীবনের ক্লান্তি নিশ্চয়ই এক নিমিষে উড়ে যাবে তখন! দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে যারা ভালোবাসেন, রিভারক্রুজ তাদের কাছে এক অন্যরকম আকর্ষণ। জাহাজে ভাসতে ভাসতে প্রতি মুহূর্তে বদলাতে থাকা নদীর দুই পাড়ের দৃশ্য বদলে দিতে পারে জীবন দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকেই। এবার সেই রিভারক্রুজে চড়ে দেশের বাইরে ভ্রমণের সুযোগ এসেছে বাংলাদেশে।
এমকে শিপিং লাইনের উদ্যোগে ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা রুটে চালু হচ্ছে রিভারক্রুজ এমভি রাজারহাট-সি। আগামী ২৯ নভেম্বর যার প্রথম যাত্রা শুরু হবে রাজধানীর হাসনাবাদ থেকে। দুই রাত তিন দিনের যাত্রাপথে বাংলাদেশ-ভারতের বিভিন্ন নদী ঘুরে জাহাজটি পৌঁছাবে কলকাতার পুলিশ জেটি ঘাটে।
শিপিং কোম্পানিটির প্রোপাইটর হাসিব খানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দুই দেশে পর্যটক নিয়ে যাতায়াতে সক্ষম এই রিভারক্রুজ চালুর পরিকল্পনা তাদের ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার যাত্রার তারিখ ঠিক করেও পেছাতে হয়েছে কার্যক্রম। বাংলাদেশ ও ভারতের মোট ১৭টি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়া শেষে এবার নিশ্চিতভাবে যাত্রা শুরুর দিনক্ষণ ঠিক করেছেন তারা।
হাসিব খানের ভাষ্যে, 'স্বাধীনতার পর থেকে জাহাজে করে দুই দেশের মধ্যে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ ছিল এতদিন যাবত। এ সময়ের ভেতর ভারত থেকে সাতটি পর্যটকবাহী রিভারক্রুজ বাংলাদেশে ঘুরে গেলেও আমাদের এদিক থেকে কোনো সফল উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল দেশবাসীকে এক নতুন ধরনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এতদিনে সেই পরিকল্পনা সাফল্যের আলো দেখতে পাচ্ছে।'
প্রায় ৮০০ মানুষ ধারণক্ষমতার এমভি রাজারহাট-সি জাহাজটি চলবে ৩৫০ জন পর্যটক নিয়ে। ১১৫টি কেবিন ও ২৪০টি স্লিপিং বেডসহ পুরো জাহাজে রয়েছে জিম, প্লে-জোন, নামাজের স্থান, রেস্টুরেন্টের মতো অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা।
ঢাকা থেকে কলকাতা যাতায়াতের পথে জাহাজটি যাবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে। নদীপথে ভারত যাওয়ার পাশাপাশি উপরি পাওনা হিসেবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগও পাবেন যাত্রীরা। কে জানে বনের ভেতর চলতি পথে সুন্দরী বা গোলপাতা গাছের ফাঁকে দেখা মিলতে পারে শিকার খুঁজতে বের হওয়া কোনো রয়েল বেঙ্গল টাইগারেরও!
'দেশের ভেতর পর্যটকবাহী জাহাজ সাধারণত সুন্দরবনের যে অংশ দিয়ে চলাচল করার অনুমতি পায়, আমাদের কলকাতাগামী জাহাজটি তার চেয়ে আরো অনেক গভীর বনের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করবে। রিভারক্রুজে থাকা পর্যটকেরা তাই সুন্দরবনের গহীনের অনেক অদেখা অঞ্চল দেখার সুযোগ পাবেন। সুন্দরবন আমাদের রিভারক্রুজের যাত্রায় একটা বাড়তি মাত্রা যোগ করবে,' বললেন হাসিব খান।
ঢাকার হাসনাবাদ ফেরী ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, কাউখালী, মোরেলগঞ্জ, মোংলা, চালনা হয়ে আংটিহারায় ইমিগ্রেশন পার করবে রিভারক্রুজটি। এরপর হেমনগর, বালি, কুমিরমারি, ভগবতপুর, নামখানা, ডায়মন্ড হারবার হয়ে পৌঁছাবে কলকাতা পুলিশ জেটি ঘাটে। পুরো যাত্রায় শুরুতে দুই থেকে তিনদিন ব্যয় হলেও ধীরে ধীরে পর্যটকদের চাহিদা বুঝে এই যাত্রার সময় বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্থলপথ বা আকাশপথে যাত্রার ক্ষেত্রে সময় বাঁচানোর যে চিন্তা যাত্রীদের মাথায় থাকে সে তুলনায় রিভারক্রুজের এই যাত্রা পুরোটাই ভিন্ন হবে বলে মনে করেন হাসিব খান। রৌদ্রজ্জ্বল দিনের সজীবতা বা জ্যোৎস্না মাখা রাতের স্নিগ্ধতায় দৈনন্দিন জীবন থেকে দূরে বিলাসিতায় মগ্ন হতেই পর্যটকেরা এই নৌবিহারে যুক্ত হবেন। তাই যতটা বেশি সময় প্রকৃতির কাছাকাছি কাটানোর ব্যবস্থা রাখা যায় সে চেষ্টাই থাকবে এই যাত্রায়।
নদীপথে নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে যাত্রীদের প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত লাইফ জ্যাকেট ও অন্যান্য নিরাপত্তা সামগ্রী মজুদ থাকবে বলে জানান হাসিব খান। ঢাকা থেকে জাহাজটি যাত্রা শুরুর পর দেশের ভেতরে এর রুটে অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য স্থান থেকেও চাইলে ভ্রমণে যুক্ত হতে পারবেন যাত্রীরা।
রিভারক্রুজটির যাত্রা শুরু উপলক্ষে ৪০ শতাংশ ছাড় চলছে এর সবধরনের টিকিটের উপর। ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত সর্বনিম্ন ভাড়া সিঙ্গেল স্লিপার জনপ্রতি ৬০০০ টাকা থেকে শুরু করে প্রিমিয়াম কেবিনে সর্বোচ্চ দুইজনের জন্য ৫০,৪০০ টাকা। পর্যটকদের ট্রাভেল ট্যাক্স অন্তুর্ভুক্ত থাকবে এই ভাড়ার ভেতর। পরিবারের সঙ্গে ১০ বছরের কম বয়সী দুই বাচ্চার জন্যও থাকবে ফ্রি টিকিট। জাহাজের ভেতর প্রতিদিন ৫০০ টাকার বিনিময়ে থাকবে তিন বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা।
হাসিব জানান, কোনো যাত্রী যদি একই সঙ্গে যাওয়া-আসার টিকিট বুক করেন তবে কলকাতা পৌঁছানোর পর ফিরতি যাত্রা শুরুর আগ পর্যন্ত চাইলে হোটেল বুকিং এর পরিবর্তে বিনামূল্যে জাহাজেই অবস্থান করতে পারবেন।
২৯ তারিখ যাত্রা শুরু করে ১ ডিসেম্বরের ভেতর কলকাতা পৌঁছে আবার ৪ ডিসেম্বর সেখান থেকে ঢাকা রওনা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এমভি রাজারহাট-সি'র। ঢাকা থেকে তাদের দ্বিতীয় যাত্রা শুরুর তারিখ ১৪ ডিসেম্বর। সব ঠিক থাকলে আপাতত মাসে দুইটি করে ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা ট্রিপ পরিচালনা করবেন তারা।
বর্তমানে নৌপথে ভ্রমণের জন্য ভারতীয় ভিসায় আলাদা কোনো পোর্ট না থাকায় যেকোনো পোর্ট সংযুক্ত ভিসা দিয়েই এই নৌবিহারে অংশগ্রহণ করতে পারবেন বাংলাদেশি যাত্রীরা। শীঘ্রই আনুষ্ঠানিকভাবে ভিসায় নৌরুট সংযুক্ত করার কার্যক্রম চলছে বলে জানান এমকে শিপিং লাইন কর্তৃপক্ষ। রিভারক্রুজের যাত্রীদের ভারতীয় ভিসা আবেদনের জন্য যাবতীয় সহযোগিতাও তাদের পক্ষ থেকে করা হবে।
কলকাতার পর ভারতের অন্যান্য অঞ্চল ও ধীরে ধীরে পুরো এশিয়া জুড়ে প্রমোদতরীতে করে দেশের পর্যটকদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে এমকে শিপিং লাইনের।