'মাস্টার অফ ফাউন্টেন পেন' মহব্বত মোস্তফা
উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আবিষ্কৃত হলো ফাউন্টেন পেন। এলো ভারতবর্ষে। রবীন্দ্রনাথ বাংলায় এর নামকরণ করলেন- ঝর্ণা কলম। অল্পদিনেই অভিজাত শ্রেণির সৌখিনতার সঙ্গী হয়ে উঠলো এই কলম। কিন্তু এরপর হঠাতই আবির্ভাব ঘটলো বলপয়েন্টের। বলপেনের সহজলভ্যতা একসময় ভুলিয়েই দেয় ঝর্ণা কলমের কথা।
বাংলাদেশে ফাউন্টেন পেনের এই উত্থান-পতনের একজন সাক্ষীও যদি কেউ থেকে থাকেন, তার নাম মোস্তফা কামাল পাশা। পেশায় তিনি ফাউন্টেন পেন মেরামতকারী। নানা সময়ে ভাগ্যান্বেষণে অন্য পেশায় গেলেও ফাউন্টেন পেনের সাথে তার দীর্ঘ ৪০ বছরের সখ্যতা। এ কলমের সোনালী যুগ যেমন দেখেছেন, পড়ন্ত বেলায় এখনও তার সঙ্গী ফাউন্টেন পেন। বর্তমানে ফাউন্টেন পেন যখন নতুন প্রজন্মের বিস্মৃতিতে, তখনও ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে ছোট একটি দোকান সাজিয়ে বসেন মোস্তফা কামাল পাশা। ফাউন্টেন পেন সংগ্রাহকদের অনেকের কাছেই তিনি 'মাস্টার অফ ফাউন্টেন পেন'!
ফাউন্টেন পেনের সাথে কয়েক যুগ
মোস্তফা কামাল পাশার জন্ম মুন্সিগঞ্জে। ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড় মোস্তফাকে পরিবারের হাল ধরতে হয় অল্প বয়সেই। ১৯৮২ সালে তিনি আনসার বাহিনীতে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ছেড়ে দেন চাকরি।
বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে ততদিনে যাত্রা শুরু করে বেশ কয়েকটি কলমের দোকান। সেগুলোর একটি ছিল মোস্তফার খালাতো ভাইয়ের। ১৯৮৫ সালে সেই দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে ঢোকানে তিনি। সেই থেকে শুরু হয় ফাউন্টেন পেনের সাথে তার দীর্ঘ পথ চলা।
৬ মাস দোকানে কাজ করে কলম সম্পর্কে ধারণা আসে তার। সেসময়ই তাকে করতে হতো কলম মেরামতের কাজ। হঠাৎ কলমের ব্যবসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন দোকান মালিক। সেসময় চাচার কাছ থেকে ৪ হাজার টাকা ধার করে তিনিই শুরু করলেন ব্যবসা। কিন্তু ব্যবসা হতো অনিয়মিত। বায়তুল মোকাররম মার্কেটে কখনো পুলিশ কখনো মার্কেট কর্তৃপক্ষের বাধার মুখে বার বার উঠে যেতে হয় তাকে।
নানা অসুবিধায় কলম বিক্রি ছেড়ে দিয়ে কখনো কাজ করেছেন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে, কখনো করতে হয়েছে হকারি। এসবের মাঝে আবার ফিরে এসেছেন কলমের কাছে। সর্বশেষ ২০০৬ সালে তিনি ফিরে আসেন মার্কেটে। কলম বিক্রেতা এক বন্ধুর অনুপ্রেরণায় আবার যাত্রা শুরু করেন ফাউন্টেন পেনের সাথে। কিন্তু ফাউন্টেন পেনের বাজার ততদিনে নিম্নমানের। তাই এবার শুধু কলমই নয়, সাথে যুক্ত করলেন মোবাইল সার্ভিসিং ও কম্পিউটার সার্ভিস।
তবে পুরো মার্কেটে একটি মাত্র সার্ভিসিং দোকান দিয়ে সুবিধা করতে পারছিলেন না তেমন। ধারদেনা করে দোকান ভাড়া দিতে হতো। ২০১৯ সালে মোবাইল সার্ভিসিং ছেড়ে পুরোপুরিভাবে ফিরে আসেন ফাউন্টেন পেনের কাছে।
নতুন করে কলম নিয়ে যাত্রা শুরুর গল্প বলছিলেন মহব্বত মোস্তফা। 'এই মার্কেটে একজন লোক ছিল, কলম ব্যবসা করতো, রহিম পাটোয়ারী নাম। সে ব্যবসা করবে না। আমাকে বললো তুমি আমার মালামাল কিনে নাও। আমার তো এত টাকা নাই। প্রতি মাসে মাসে দুইহাজার করে টাকা দিয়ে তার শোকেস নিলাম। এভাবেই আমার কলম ব্যবসা আবার উনিশ থেকে শুরু হইলো নতুন কইরা।'
যেসব কাজ করেন তিনি
নতুন করে শুরু করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহযোগিতা নেন মহব্বত মোস্তফা। তিনি দেখলেন, আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে নতুন প্রজন্মের অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেছে ঝর্ণা কলম নিয়ে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফাউন্টেন পেনের কথা উঠে এলে মানুষ জানতে পারে এই কলম এখনও কেনা-বেচা হয়। 'এর মধ্যে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার রিপোর্ট করলো, তখন মানুষ জানলো ফাউন্টেন পেন এখনও চলে,' বললেন মোস্তফা।
তবে বাংলাদেশের ফাউন্টেন পেন সংগ্রাহকদের একটি বড় অংশ বায়তুল মোকাররম মার্কেট এবং মহব্বত মোস্তফা সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিলেন। কোভিড পরবর্তী অনলাইন কার্যক্রম মোস্তফাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। অনেক আগে থেকেই কলম সংগ্রাহকদের ভরসার জায়গা ছিলেন তিনি। এখন আরও বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন এই বিরল পেশাজীবি।
তা কলমের কী কী মেরামতের কাজ করেন তিনি? প্রশ্ন করতে জানালেন, অনেক সময় কাজগুলো থাকে ঠুনকো, শুধু মাত্র কয়েকটা চাপেই ঠিক করে ফেলা যায়। তবে কখনো একটি নষ্ট কলমকে সম্পূর্ণ ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হয় তাকে। নিব ভাঙ্গা, বিভিন্ন পার্টস জোড়া লাগানো সহ কলমের প্রায় সব সমস্যাই সমাধান করতে পারেন তিনি।
একজন মেরামতকারী হিসেবে মহব্বত মোস্তফা কতটুকু দক্ষ? প্রশ্নটি করা হয়েছিল ফাউন্টেন পেন সংগ্রাহক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক জে.জে. পলাশকে। তিনি বললেন, 'মহব্বত ভাই এক কথায় জাস্ট দ্য মাস্টার অব ফাউন্টেন পেন।'
ফাউন্টেন পেনের ভেতরে প্রথমে কালি ভরতে হয়। পরে লেখার সময় চাপ প্রয়োগ করলে সরু নিবের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে সে কালি। এমন প্রযুক্তির কারণেই কলমটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'ফাউন্টেন পেন'। কলমের কালি যে অংশে থাকে, সে সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান রয়েছে মহব্বত মোস্তফার কাছে। তবে শুধু ফাউন্টেন পেন নয়, সবরকম কলমই মেরামত করেন তিনি।
রুবেল হোসেন বাংলাদেশের ফাউন্টেন পেন সংগ্রাহকদের মধ্যে অন্যতম। ফেসবুকে 'আঁকারু' নামের একটি পেইজের মাধ্যমে তিনি কলম বিক্রিও করে থাকেন। বায়তুল মোকাররমে কলমের দোকানে আসা-যাওয়ায় মধ্যে দিয়েই মহব্বত মোস্তফার সাথে পরিচয় তার। ফাউন্টেন কলমের মেরামতকারী হিসেবে মোস্তফার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন তিনি। বললেন, 'মহব্বত মোস্তফা সম্পর্কে মন্তব্য করার কিছু নাই। এত বছর কাজ শিখেছেন, জেনেছেন, উনার আসলে বিকল্প নাই। আমরা সবাই তার ওপর ভরসা করি।'
তার কাছে মিলবে কালি ও কলম
মহব্বত মোস্তফা মূলত ফাউন্টেন পেন মেরামতকারী হলেও, অন্য পাঁচজনের চেয়ে এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা বেশি বলে অনেক সংগ্রাহক কলম সংগ্রহে ভরসা রাখেন তার ওপর। তিনি নিজে বিক্রি করেন সামান্যই। তার দোকানের সংগ্রহ থেকে আগ্রহীদের তিনি কলম ও কালি বিক্রি করে থাকেন। নিজের ফেসবুক পেইজে মাঝেমধ্যে কলমের ছবি তুলে পোস্ট করে, কারো পছন্দ হলে দোকান থেকে সংগ্রহ করতে পারে। এছাড়া কুরিয়ারও করেন তিনি।
ঝর্ণা কলম ছাড়াও নিত্যব্যবহৃত বলপেন, মার্কার পেন, রঙিন কলমও তিনি বিক্রি করেন। রুবেল হোসেন জানালেন, কেউ যদি ফাউন্টেন পেন সংগ্রহ করতে চায়, সেক্ষেত্রেও মোস্তফা হতে পারেন ভরসার জায়গা। 'একজন দোকানদারের কাছে আসলে নানা জায়গা থেকে জিনিস আসে। নানা সোর্স, কেউ বিক্রি করে, কেউ বদল করে। তার ওপর সবাই হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভরসা করতে পারে।'
আগ্রহ বাড়ছে নতুন প্রজন্মের
প্রযুক্তির দান বলপেনের সহজলভ্যতায় হারিয়ে গিয়েছিল ফাউন্টেন পেন; আবার সেই প্রযুক্তির কল্যাণেই নতুন প্রজন্ম এ কলম সম্পর্ক জানতে পারছে, আগ্রহী হয়ে উঠছে।
মহব্বত মোস্তফা বলেন, 'ফাউন্টেন পেন হারিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত, ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখলে যেমন আনন্দ আছে, তেমনই ঝামেলা আছে। ফাউন্টেন ফ্রেন্ডলি কাগজ নেই, অনেক সময় কালি লিকেজ হয়ে জামাকাপড় কালির দাগ লেগে যায়। মেইনটেন্সের ব্যাপার আছে।'
তবে বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহের কথাও জানালেন তিনি। ফেসবুকে বেশ কয়েকটি গ্রুপের মাধ্যমে তারা বেশ সংঘবদ্ধ। 'বর্তমানে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির কিছু স্টুডেন্ট আছেন, স্রেফ শখের বসে বাবা মা সিনিয়র দের কাছ থেকে ফাউন্টেন পেনের গুণগান শুনে শুনে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। আশা করা যায় এই আগ্রহের কারণে ভবিষ্যতে ঝর্ণা কলমের আরও কদর বাড়তে পাড়ে।' বললেন মোস্তফা।
নেই উচ্চাকাঙ্খা
যদিও কলম মেরামতই মোস্তফার মূল পেশা, তিনি কাজের বিনিময়ে অযৌক্তিক কোন অর্থ দাবি করেন না। জানালেন, তিনি সার্ভিস চার্জ নিয়ে থাকেন নিজের পরিশ্রমের অনুপাতে। 'আমার যারা কাস্টমার, যারা কলম কেনে মাঝেমধ্যে, তাদের থেকে আমি প্রায় কোন পয়সাই নেই না। অনেক কাজই কিন্তু ঠুনকো। চোখের সামনে করলে মনে হয় কিছুই করতে হলো না। তা এর জন্য কি আমি ৫০০ টাকা চাইতে পারি? অনেকে জোর করে টাকা দেয়। তবে যেটুকু পরিশ্রম হয়, সে পরিমাণ অর্থ আমি নিই।'
অত্যন্ত সাদাসিধা জীবন যাপন করেন মহব্বত মোস্তফা। বললেন, 'জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন আমার পছন্দ না। আমি চলতে চাই সিম্পলভাবে। আমার বিবেকের সাথে বোঝাপড়া করে যা পাই, সেটাই করি। আমি সবসময় ভাবি, কাউকে ঠকালাম কিনা, কেউ আমার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলো কিনা।'
আরও বললেন, ব্যবসা জীবনে কোন দিন সোনালী দিন দেখেন নি তিনি। কারণ ব্যবসার মূলধন কলমের ব্যবসা উপযোগী ছিলো না। বললেন, 'তেমন আয় হতো না। যা পেতাম তা দিয়েই কোনভাবে দিন পার করে এসেছি। সবসময়ই ধার দেনার মধ্যে থাকতাম। যখন যেমন, তখন তেমন ভাবেই জীবন যাপন করেছি।'
তার সার্ভিস যারা নিয়েছেন, তারাও মোস্তফাকে চিহ্নিত করলেন একজন ভালো মানুষ হিসেবে। সংগ্রাহক মাহের মোহাম্মদ মোজাম্মেল জানালেন, 'আমি তার সার্ভিস নেইনি। আমার খুব পরিচিত কয়েকজন আছেন যারা উনার কাছ থেকে সার্ভিস নিয়েছেন এবং তাদের মতে নিঃসন্দেহে তিনি একজন জাদুকর।'
দিনশেষে এই প্রাপ্তিটুকুইকেই বড় করে দেখেন মহব্বত মোস্তফা। নিজের তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন; স্বামী-স্ত্রী ও মা মিলে ছোট একটি সংসার তার। এভাবেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান তিনি।