ভালোভাবে ফিরে আসার লক্ষ্যে উৎপাদন বন্ধ করছে ধুঁকতে থাকা ‘ইকোনো’ বলপেন
একসময় দেশের প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ঘরে পরিচিত নাম ছিল ইকোনো। জিকিউ বলপেন-এর মালিকানাধীন এ বলপয়েন্ট কলমের উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ভালোভাবে ফিরে আসার লক্ষ্যে কারখানা আধুনিকায়নের জন্য সাময়িকভাবে ইকোনোর উৎপাদন বন্ধ করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ চলতি বছরের ৩০ জুন থেকে আগামী ১২ মাসের জন্য ইকোনোর উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তীব্র পূর্ণ বাজারে ব্র্যান্ডটির মূল কোম্পানি পণ্যটির আধুনিকায়ন করতে পারেনি। এর ফলে এ ব্র্যান্ডের পারফরম্যান্স ক্রমেই কমতে থাকায় উৎপাদন বন্ধের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গত সপ্তাহে স্টক এক্সচেঞ্জে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোম্পানিটি বলেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সাল থেকে পরিচালন লোকসান দিয়ে আসছে। এ লোকসান কমাতে এবং পণ্যের গুণমান বাড়াতে তাদের কারখানার আধুনিকায়ন অপরিহার্য। এ কাজ করতে অন্তত ১২ মাস লাগবে। এ সময় ইকোনো উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে।
এছাড়া কোম্পানিটি জানিয়েছে, তারা কারখানার পুনঃভারসাম্য ও আধুনিকীকরণে প্রায় ৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছে। ভারসাম্য, আধুনিকীকরণ, পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ (বিএমআরই) সম্পন্ন করার পর কারখানা ফের চালু হবে। এতে কোম্পানিটি আরও ক্ষতি থেকে বাঁচবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, কোম্পানিটি অন্যান্য আয় থেকে কার্যক্রম বন্ধ রাখার সময় লভ্যাংশ প্রদান অব্যাহত রাখতে পারবে।
জিকিউ বলপেন আরও জানিয়েছে, তারা ভাড়া থেকে বছরে ৩ কোটি টাকা আয় করতে পারে। তাছাড়া উত্তরায় তাদের ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবনটির কার প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। চলতি বছর থেকে ভবনটি ভাড়া দেওয়া যাবে যাবে বলে আশা করছে তারা।
কোম্পানিটির বিবৃতিতে বলা হয়, গত বার্ষিক সাধারণ সভায় শেয়ারহোল্ডাররা কোম্পানির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি বিএমআরই সম্পন্ন হওয়ার আগপর্যন্ত কার্যক্রম বন্ধ রাখতে এবং প্রয়োজন নেই এমন কর্মচারীদের ছাঁটাই করতে ব্যবস্থাপনা ও বোর্ডকে জোরালো পরামর্শ দিয়েছেন। শেয়ারহোল্ডাররা বলেছেন, এটাই কোম্পানিটির টিকে থাকার একমাত্র উপায়।
এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে উজ্জল কুমার সাহাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কাজল মৃধাকে প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ও কে এম এরশাদকে কোম্পানি সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কোম্পানিটি তাদের শীর্ষ পদে রদবদল আনে।
ব্যবসার অবস্থা
জিকিউ ব্যবসা শুরু করে ১৯৮১ সালে। গত দশকে কোম্পানিটির বিক্রি ৯০ শতাংশ কমেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা, যা দশ বছর আগে ৩০ কোটি টাকা ছিল।
জিকিউ বলপেনের ২০১৯-২০ অর্থবছরে আর্থিক প্রতিবেদনে এর স্বাধীন নিরীক্ষক মাহফেল হক অ্যান্ড কো বলেছে, কোম্পানিটির যে আর্থিক অবস্থা, তাতে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
জিকিউয়ের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, ১৯৯৮ সালে ব্যবসা শুরু করা ম্যাটাডোর বলপয়েন্ট পেন বর্তমানে এ বাজারে শীর্ষস্থান দখলে রেখেছে।
কোম্পানিসংশ্লিষ্ট একজন ব্যক্তি জানান, জিকিউ বল পেন প্রতিষ্ঠিত হয় কাজী সালিমুল হক ও সালমা হকের হাত ধরে। তাদের মধ্যে কাজী সালেমুল হক ইকোনো কামাল নামে পরিচিত। তিনি মাগুরা থেকে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় তার ১০ বছরের জেল হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানিটির একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, কোম্পানির এমন অবস্থার জন্য কাজী সালিমুল হক দায়ী।
তিনি বলেন, 'কোম্পানিটি এখনও তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু কাজে লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এর জন্য আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন।'
এর আগে ২০২৩ সালের মে মাসে জিকিউ বলপেন সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের একটি অংশ পরিশোধ করতে চট্টগ্রামে অবস্থিত অব্যবহৃত জমি বিক্রি করে।
জিকিউ বলপেন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সবচেয়ে পুরনো কোম্পানিগুলোর একটি। কোম্পানিটি ১৯৮৬ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।
বছরের পর বছর ধরে লোকসান করলেও কোম্পানিটি রিটেইন্ড আর্নিংস থেকে শেয়ারহোল্ডারদের নিয়মিত নগদ লভ্যাংশ দিয়ে এসেছে।
তবে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা কোনো লভ্যাংশ নিচ্ছেন না। ঘোষিত লভ্যাংশের সুবাদে কোম্পানিটির শেয়ার পুঁজিবাজারের সেকেন্ডারি মার্কেটে 'বি' ক্যাটাগরির আওতায় লেনদেন করা গেছে।
২০২০ সালের জুনে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল মাত্র ৬৬ টাকা, কিন্তু ওই বছরের সেপ্টেম্বরে শেয়ারের দাম ২৭৬ শতাংশ বেড়ে ২৪৮ টাকা হয়। বিআরবি গ্রুপ কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছে, এমন গুজবে এ কারসাজির ঘটনা ঘটে।
বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতিষ্ঠানটির প্রত্যেক শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ১১২.৪০ টাকা।
বলপয়েন্টের বাজার
শিল্পসংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, দেশে এক কোটি শিক্ষার্থী প্রতি চার দিনে এক কোটি বলপয়েন্ট কেনে। এছাড়া অসংখ্য অফিস নিয়মিত বলপয়েন্ট কলম কিনে থাকে। তবে মোট বাজারের আকার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই, কারণ এ ব্যবসা মূলত আমদানি করা কলমের আধিপত্য রয়েছে।
স্থানীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রাণ-আরএফএল, জননী ও কুমু প্রতিদিন ২৫ লাখ বলপেন উৎপাদন করে। মেঘনা গ্রুপ ২০১৯ সালে বলপয়েন্ট কলমের ব্যবসায় প্রবেশ করেছে এবং 'ফ্রেশ' ব্র্যান্ডের অধীনে এ পণ্য বিক্রি করছে।
আমদানি করা পণ্যের কারণে বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠায় অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও রোজ হেভেন বলপয়েন্ট কলম উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।