ঝরনাকলমপ্রেমীরা ফাউন্টেন পেনের দিন ফিরিয়ে আনতে চান!
মন খারাপ রবীন্দ্রনাথের। তাঁর মুখে সবসময় একটাই কথা, 'আহা আমার সাধের ঝর্না কলম!' গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ পাঠের মাঝে মাঝেই বারবার একই প্রসঙ্গ তুলে মন খারাপ করছেন তিনি। একদিন সকালে, রবীন্দ্রনাথ পায়চারি করছেন জোড়াসাঁকোর দোতলার বারান্দায়, হঠাৎ উপস্থিত জোড়াসাঁকো থানার ইনস্পেক্টর। সঙ্গে কোমরে দড়ি বাঁধা এক ব্যক্তি। পুলিশটি বললেন, এটি একটি দাগী আসামি। চুরির কেসে ধরা পড়েছে। তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা জিনিসের মধ্যে সোনাগয়না, জামাকাপড়, বসনপত্র, বোতাম, বই ছাড়াও আছে একটি ঝর্না কলম। চোরটি বলছে কলমটা নাকি সে চুরি করেছে এই বাড়ি থেকে। কলমটি দেখেই রবীন্দ্রনাথ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলেন, এই তো আমার সাধের কলম (আনন্দবাজার পত্রিকা; ৭ই মে, ২০১৬)!
১৯৮২ সাল থেকে নিয়মিত ফাউন্টেন পেনে লিখছেন অনিক। মাস তিনেক আগে রবীন্দ্রনাথের দুর্ভাগ্যের মতো পাঁচ–ছয়টা কলম চুরি গিয়েছিল অনিকেরও। ক্লাস থ্রি (১৯৮২ সাল) থেকে ঝরনাকলমে নিয়মিত লিখছেন পেশায় আইনজীবী অনিক রুশদ হক।
অনিকের প্রথম কলমটি ছিল বাংলাদেশি বেলা কলম। নিউমার্কেট থেকে তার মা কিনে দিয়েছিলেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তিনি অবিরতভাবে ঝরনাকলমই ব্যবহার করে যাচ্ছেন। এজন্য লোকমুখে টুকটাক টিপ্পনিও শুনতে হয়েছে তাকে। একবার ব্যাংকে গিয়ে কর্মচারীদের মুখে শুনতে হয়েছে, 'এহ কি ভাব, দেখেন না...!' নিজের বিয়ের দিনও এই ফাউন্টেন পেন নিয়ে ঘটেছিল এক মজার কাহিনী।
'যখন কাগজে সাইন করছি, সবাই যেন হা হয়ে দেখছে; নতুন জামাই ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখে! সবচেয়ে মজার দৃশ্য ছিল — যে কাগজে সাইন করলাম, সেটিকে কাজী সাহেব বাতাস করা শুরু করলেন একপর্যায়ে। আমি ভীষণ অবাক হলাম। আমার বিয়ে, কোথায় আমাকেই না বাতাস করবে, অথচ, করছে কাগজটাকে!'
এছাড়া পরনের কাপড়চোপড়ে রঙ লেগে যাওয়ার জন্য বাড়িতে টুকটাক বকা তো শুনতেই হয়। অনিক বলেন, 'কত শার্ট যে আমার ফেলে দিতে হয়েছে কালি লেগে যায় বলে! কিন্তু কী করব, কালি ফুরিয়ে যাবার ভয়ে সবসময় দু'তিনটি কলম পকেটে রাখতে হয়।' বর্তমানে অনিকের সংগ্রহে আছে ৫০টি কলম।
'ঝরনাকলম' নামটি এলো কীভাবে?
১৮৮৩ সালে আমেরিকায় ফাউন্টেন পেন আবিষ্কারের পর ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশেও ফাউন্টেন পেন তৈরির ধুম পড়ে যায়। সকলেই এই পেন ব্যবহার করতে শুরু করেন। কলমের এই বহুল প্রসারে দেশে দেশে শিক্ষারও বিস্তার হতে থাকে।
বাংলায় 'ফাউন্টেন পেন' আসে ইংরেজদের হাত ধরেই। রবীন্দ্রনাথ কলমটির বাংলা নাম দেন 'ঝরনাকলম'। ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একসময় নানা জাতের, নানা দামের ফাউন্টেন পেন বাজারে আসতে থাকে। এর মধ্যে পার্কার, শেফার্ড, ওয়াটারম্যান, সোয়ান, পাইলট উল্লেখযোগ্য।
তবে এ কলমগুলোর নিব ও হ্যান্ডেল ছিল রকমারি এবং টেকসই। শৌখিন ও ধনী ব্যক্তিদের জন্য কোনো কোনো কলমে হিরে বসানো হতো। কখনো কখনো আবার প্লাটিনাম, সোনা ইত্যাদি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হতো ফাউন্টেন পেনকে। শ্রীপান্থ তার হারিয়ে যাওয়া কলম প্রবন্ধে বলেছেন, কখনও কখনও দোয়াত তৈরি হতো মূল্যবান সোনা দিয়ে। গ্রামের কোনো ছেলে মেয়ে পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলে বয়স্ক মানুষেরা আর্শীবাদ করতেন 'তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক' বলে।
সাহিত্যিকদের প্রিয় ছিল ঝরনাকলম
অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ফাউন্টেন পেন সংগ্রহের নেশা ছিল। তবে সোনা, হিরে, প্লাটিনামে মোড়ানো কলম হওয়ায় অতীতে এই ফাউন্টেন পেনের কদর শুধু ধনীরাই করতেন। গরীবদের এ কলম ব্যবহার বা একাধিক কলম সংগ্রহে রাখার বিশেষ সুযোগ ছিল কম। এমন এক উদাহরণ আমাদের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। টাকাপয়সার অভাবে কলম নিয়ে শৌখিনতার সুযোগ হয়নি মানিকের। তবে উপহার হিসেবে একবার পেয়েছিলেন শৌখিন সোয়ান কলম। সে কলম দিয়েই প্রচুর লেখালেখি করে গেছেন তিনি। লিখতে লিখতে এক সময় কলমের নিব, জিপ সব বেরিয়ে এলে সুতো দিয়ে সেগুলো এঁটেই না-কি চালিয়ে দিয়েছিলেন মানিকবাবু!
আবার একটি কলম দিয়ে শুধু একটি উপন্যাসই লিখতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর সেটি আর ব্যবহার করতেন না, সযত্নে তুলে রাখতেন।
ফাউন্টেন পেনের মধ্যে শেফার্স ছিল বুদ্ধদেব বসুর প্রিয়। যদিও পার্কার, ওয়াটারম্যান, মঁব্লঁও ছিল সংগ্রহে। তিনি কলম শুধু সংগ্রহই করতেন না, খুব খুঁতখুঁতেও ছিলেন। কলম নিয়ে তার ছিল একধরনের অধিকারবোধ। একবার চিঠিতে না-কি মেয়েকে ধমকেও ছিলেন এই বলে: 'তোর সাহস হয় কী করে আমায় ডট পেনে চিঠি লেখার!'
পণ্ডিত রবিশঙ্করও না-কি ঘড়ি ও কলমের ব্যাপারে ছিলেন উন্নত সাবেকিয়ানা চালের। লেখালেখির সময় ভুলেও কখনও অন্য কলম বাড়ালে উনি মিষ্টি হেসে বুকপকেট থেকে নিজের কলমই বের করে নিতেন।
বন্ধুর থেকে একটি শেফার্স কলম উপহার পেয়েছিলেন সমরেশ বসু। সেই কলমটির প্রতি ছিল তার বিশেষ মুগ্ধতা। বহুদিন ওই কলমেই লিখেছেন সমরেশ। তবে পাশাপাশি পার্কারও ছিল পছন্দের। তবে তিনি শুধু যে ঝরনাকলমে লিখেছেন তা-ই নয়, বলপেনেও লিখেছেন বহু লেখা।
আনন্দবাজার পত্রিকার বরাতে জানা যাচ্ছে, সত্যজিৎ রায় জীবনের শেষদিন অবধি বাংলা লেখার সময় ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতেন। রকমারি সব নামিদামি ফাউন্টেন পেন ছিল তার সংগ্রহে।
ফাউন্টেন পেনের সঙ্গে ৬ দশক
বলপয়েন্টের আগমনে ফাউন্টেন পেন যেন ধীরে ধীরে আমাদের জীবন থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। সত্তর বা আশির দশকে যারা পড়েছেন, তারাও বোধহয় বাড়ির বড়দের ফাউন্টেন পেন দিয়ে দু'চারবার লিখেছেন। নব্বই দশকের পর যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কতজন এই ঝরনাকলম হাতে নিয়ে দেখেছেন, তা বলা মুশকিল। কিন্তু এখনো এমন অনেকে আছেন, যারা যুগের সঙ্গে তাল না মিলিয়ে বরং সারাজীবন ঝরনাকলমের সঙ্গেই কাটাচ্ছেন। সেরকমই একজন ইফতেখার হোসেইন খান।
নামিদামি সব কলমের সংগ্রহশালা আছে ইফতেখার হোসেইন খানের। এখন অবসরজীবন কাটানো সাবেক ব্যাংকার ইফতেখারের সংগ্রহে প্রায় দুই থেকে তিন হাজার ফাউন্টেন পেন আছে। সেই ১৯৬২ সালে কলমের হাতেখড়ি হওয়ার পর থেকে এখন অবধি ৬০ বছর ধরে তিনি লিখে যাচ্ছেন ফাউন্টেন পেন দিয়ে।
কথায় বলে, ঝরনাকলম হলো প্রেমের, ভালোবাসার আর আভিজাত্যের প্রতীক৷ ইফতেখার হোসেনের কাছে ফাউন্টেন পেন মানেই যেন তা-ই। কিন্ডারগার্টেনে পড়াকালীন বাবার ফাউন্টেন পেনটির দিকে তার প্রথম নজর যায়। সেই থেকে ফাউন্টেন পেনের জন্য মায়া, ভালোবাসা, প্রেম, আকর্ষণ যেন এতটুকু কমেনি। বাজারে নতুন ভালো কোনো কলম পেলেই কিনে ফেলতেন তিনি। এখনো কেনেন। তবে এখন রঙবেরঙের কালি বা ফাউন্টেন পেনের ব্যবহারের চেয়ে শুধু ক্ল্যাসিকাল ফাউন্টেন পেনই তার পছন্দের।
ইফতেখারের ইচ্ছে মৃত্যুর আগেই তার এই বিশাল সংগ্রহের কোনো একটা ব্যবস্থা করে যাওয়ার। বিক্রিবাট্টা নয়, হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠান বা জাদুঘরে সংগ্রহশালার স্থান দেওয়া। যাতে তার মতোই যারা খাঁটি কলমপ্রেমী, তারা কলমের বিবর্তন দেখতে পারে, ইতিহাস জানতে পারে।
নারীদের আগ্রহ কেমন?
প্রতিভা বসুর কলম নিয়ে একদম মাথাব্যথা ছিল না। হাতের কাছে যা পেতেন, তা-ই দিয়ে না-কি লিখতেন। আশাপূর্ণা দেবীও অনেকটা তাই। বিশেষ কোনো কলমের মোহ ছিল না। বিছানায় উপুড় হয়ে প্যাডে লিখতেন কুইঙ্ক কালিতে।
অবশ্য নারীদের কলম নিয়ে আগ্রহ কম তা নয়। বয়স্ক নারীদের কথা জানিনা, তবে এ প্রজন্মের তরুণীদের মাঝে এ আগ্রহ দেখা যায়। খুব বেশিদিন হয়নি মেহনাজ তাবাসসুম ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখছেন। ২০২০ সালে ফাউন্টেন পেনের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়। পেশায় তাবাসসুম একজন স্থপতি ও শিক্ষক। ক্যালিগ্রাফি শিখতে গিয়ে মূলত ফাউন্টেন পেনের প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর লিখতে গিয়ে এ কলমে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, এখন নিজের বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, শিক্ষার্ত্থীদেরও উৎসাহ যোগান ঝরনাকলম ব্যবহারের জন্য।
'আমার পেশায় আঁকিবুঁকির বিষয়গুলো থাকায় এবং পাশপাশি দুটো জায়গায় কাজ করায় খুব স্ট্রেসফুল লাগত আমার। কিন্তু ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখার পর, আমার স্ট্রেসটাই যেন কেটে গেল! এ কলম দিয়ে তো খুব আস্তে আস্তে, সাবধানে লিখতে হয়। আর আমি এতেই যেন খুব আরাম আর শান্তি পাই। তাই, যদি সারাদিন কোনো লেখার কাজ নাও থাকে, রাতে এসে অন্তত একটা লাইন আমি লিখবোই ফাউন্টেন পেনে! এতটা প্রশান্তি দেয় আমাকে!'
বিলাসিতা নয়, বরং পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী
তাবাসসুম মনে করেন, মানুষ, বিশেষত তরুণেরা ধীরে ধীরে ফাউন্টেন পেন ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। তাছাড়া এটি ব্যয়সাশ্রয়ী বলেও মনে হয় তার কাছে।
'যারা একবার ব্যবহার করেছে তারা এর মজাটা বুঝতে পারছে। এর খরচও কম। এক কালি দিয়ে ছয়মাস চলে যায়, কলম তো বছরের পর বছর যায়। আমি আর কখনোই চাইনা বলপয়েন্টে লিখতে। '২০ সালের পর থেকে আমার টেবিলে আর বলপয়েন্টের জায়গাও হয়নি।'
তাই ফাউন্টেন পেনের নেশা বা শখ পূরণ এখন কেবল আর ধনীদের একচেটিয়া নয়। বাজারে এখন চীন, ভারত, জাপান ও জার্মানির বিভিন্ন দাম ও মানের ঝরনাকলম পাওয়া যায়। দুইশো থেকে শুরু করে বিশ–ত্রিশ হাজারের ওপরেও কলম আছে বাজারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ'র শিক্ষার্থী নিশাত বিনতে মনসুরের ঝরনাকলমের সঙ্গে যোগাযোগ বছর দুয়েক ধরে। পরীক্ষা বাদে ফাউন্টেন পেনেই তার সব কাজ হয়। তিনি বলেন, "একে তো ফাউন্টেন পেন পরিবেশবান্ধব, তার ওপর এ কলম বলপয়েন্টের মতো ব্যবহারের পর হারিয়ে যায়না (যেহেতু রক্ষণাবেক্ষণ বা বাড়তি মনোযোগের বিষয় থাকে)। তাই একটি কলম আর কালি দিয়ে কয়েক মাস বা বছর চলা যায়। আমার কাছে মনে হয় এটা একদিকে যেমন অর্থের দিক থেকে সাধ্যের মধ্যে, তেমনি 'এটা আমার' — এই অনুভূতিও দেয় আমাকে।"
পরীক্ষাটুকু বাদে সারাবছর ফাউন্টেন পেন
নিশাতের মতোই অল্পবয়সী তরুণ-তরুণীরা এখন আবার আগ্রহী হয়ে উঠছেন ফাউন্টেন পেন ব্যবহারে। কিন্তু এ যুগে এসে ঝরনাকলম দিয়ে দৈনন্দিন কাজ করা চারটিখানি কথা নয়। এর জন্য যেমন এ কলমের পেছনে শ্রম ও সময় দিতে হয়, ধৈর্য্যও রাখতে হয়। যাপিতজীবনের এত ব্যস্ততা আর যান্ত্রিকতার মাঝে কালি ভরা, ধুয়ে কলমটি আবার পরিষ্কার করা সত্যিই একটু ঝামেলার বটে।
কিন্তু এ শ্রমটুকু ভালোবাসেন অনুপম। বয়স তখন সাত কি আট, বাবার থেকে একটি ফাউন্টেন পেন উপহার পান অনুপম। সেই কলম দিয়েই শুরু হয় তার নতুন যাত্রা। নব্বই দশকের একজন হওয়ায় এ যাত্রা তার জন্য এতটাও সহজ ছিল না। যে কারণে সারাবছর ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখে এলেও পরীক্ষার সময় ফিরতে হতো ওই বলপয়েন্ট কলমেই।
অনুপম পেশায় একজন প্রকৌশলী। পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং লেখালেখিতেও আছে পারদর্শিতা। বলপয়েন্টে বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে লিখতে হলেও, ঝরনাকলম ছাড়া তার চলেইনা। কলমে কালি ভরা, আবার কলমগুলোকে ধুয়ে রোদে শুকোতে দেওয়া; এ কাজগুলোতে অনুপম যেন একধরনের স্বকীয়তা খুঁজে পান। তাছাড়া ফাউন্টেন পেনের সঙ্গে ব্যবহারকারীর যে আত্মিক যোগ তৈরি হয়, সে অনুভূতি বলপয়েন্টে পাওয়া যায় না। অনুপমের মতে, যাদের দৈনিকই লেখালেখি করতে হয় বা যারা একটু উদাসীন, তাদের জন্য ঝরনাকলম দারুণ একটি অনুষঙ্গ হতে পারে।
কেন হঠাৎ করে ঝরনাকলমে আগ্রহ এ প্রজন্মের?
বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে 'ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশ' নামক একটি প্রতিষ্ঠান। এদের মূল উদ্দেশ্য হলো, নতুন এবং আগামী প্রজন্মের কাছে এ কলমের আবেদন পৌঁছে দেওয়া। আর এজন্য ফাউন্টেন পেন সংগ্রহকারীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন তারা।
শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক ফাউন্টেন পেন কমিউনিটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাও এ প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে 'ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশ' বেশ কিছু উদ্যোগও নিয়েছে। নিয়মিত 'পেন মিটিং'-এর আয়োজন এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানটি তরুণদের মাঝে ঝরনাকলমের জনপ্রিয়তা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি সারাবছর ফাউন্টেন পেন হ্যান্ডরাইটিং কম্পিটিশনসহ নানা ধরনের আয়োজন করে থাকে 'ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশ'।
তাদের উদ্দেশ্য যে বৃথা যায়নি, তা বলাই যায়। বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের মাঝেও দেখা যাচ্ছে ফাউন্টেন পেন ব্যবহার এবং সংগ্রহের নেশা। ফলে ফেসবুকের মতো সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম বা অনলাইনেও গড়ে উঠেছে ফাউন্টেন পেনের বাজার।
ঝরনাকলম ব্যবহারকারী ও সংগ্রহকারীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ। 'ফাউন্টেন পেন লাভারস', ও 'ফাউন্টেন পেন কালচার' নামক দুটি গ্রুপে সংগ্রহকারী বা ব্যবহারকারীরা তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, অনুভূতি শেয়ার করেন। ফাউন্টেন পেন কালচার-এর অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা আমিন বাবু বলেন, "আমরা যারা ফাউন্টেন পেন ভালোবাসি বা ব্যবহার করি, তাদের কথা বলার জন্য তেমন কোনো জায়গা ছিলনা। সেই জায়গাটা তৈরির জন্যই 'ফাউন্টেন পেন কালচার'। আমরা ফাউন্টেন পেনের মাধ্যমে এক নতুন কালচারকে তুলে ধরছি।"
সমৃদ্ধ একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলার পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে কালি ও কলম আমদানি করে ভূমিকা রাখছে দেশের ফাউন্টেন পেনের বাজারে। সে-ই সঙ্গে সাহায্য করছে প্লাস্টিক বর্জন করে সচেতনতা ছড়াতে।
ফাউন্টেন পেনের নাগাল
রাজধানীর নিউমার্কেটে পেন গার্ডেন, মডার্ণ স্টেশনারী, বুক মার্ট, আলী ব্রাদার্স, ফ্রেঞ্চ স্টাডি ইত্যাদিসহ প্রায় ৬টি দোকানে ফাউন্টেন পেন পাওয়া যায়। এছাড়া বায়তুল মোকাররমে মহব্বত চাচার দোকান এবং সাথে আরও ৩–৪টি দোকানে ফাউন্টেনপেন পাওয়া যায়। অনলাইন, অফলাইন দু জায়গাতেই ফাউন্টেন পেনের গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এ নিয়ে বুক মার্ট-এর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সুমন বলেন, 'প্রতিদিন সাত থেকে দশজনের মতো ফাউন্টেন পেনের ক্রেতা পাই। তবে, দামি বা শৌখিন কলমগুলো কেনেন বেশি বয়স্করাই । আর তরুণেরা মূলত নিত্য ব্যবহারের জন্যই কেনে বেশি।'
ফাউন্টেন পেন বা এ ধরনের 'রুচিশীল' স্টেশনারির জন্য বাংলাদেশের প্রথম মার্কেটপ্লেস 'বিডি পেনস'। তাদের ওয়েবসাইট থেকে অর্ডার করলে দেশের সকল প্রান্তের কলমপ্রেমীদের কাছে পৌঁছে যায় আকাঙ্ক্ষিত কলম। আবার নিজের পছন্দের ডিজাইনের বা ব্র্যান্ডের কলম চাইলে পাশে থাকছে 'কালির দোয়াত'। এটির লক্ষ্য ফাউন্টেন পেন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, রিভিউ আলোচনা, ক্যালিগ্রাফি, সুন্দর হাতের লেখা, ফাউন্টেন পেন ফটোগ্রাফি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে অভিজ্ঞ এবং নতুনদের মাঝে মেলবন্ধন গড়ে তোলা। 'কলমের দোকান' নামক আরেকটি পেজেও মেলে দুর্লভ অনেক সংগ্রহ। এছাড়া 'পেন বাজার বিডি' নামক একটি অনলাইন ফেসবুক পেজে স্বদেশী আন্দোলনের প্রতীক সে-ই 'সুলেখা কালি'ও পাওয়া যায়।
বলপয়েন্টের যুগে ফাউন্টেন পেন
পেন গার্ডেন-এ বাবার সঙ্গে কলম কিনতে এসেছে আট বছরের নুসরাত। বাবা আখতারুজ্জামানের জানালেন, মেয়ের হাতেখড়ির জন্য কলম কিনতে এসেছেন তিনি। ফাউন্টেন পেনে লেখা সুন্দর হবে, তাই বলপয়েন্টের যুগেও হাতেখড়ি করবেন ফাউন্টেনপেন দিয়েই। দোকানের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ শাহ আমিন জানান, 'অনেকেই তাদের ছোট ছেলেমেয়েদের কলমের হাতেখড়ি দেন এ ফাউন্টেন পেন দিয়েই। ইদানিং এ সংখ্যা বাড়ছে; কারণ, ফাউন্টেন পেনে হাতের লেখা সুন্দর হয়।'
সারাজীবন শুধু ফাউন্টেন পেন দিয়েই পার করে দিয়েছেন এমন অনেকে যেমন আছেন, তেমনি অনেকেই আছেন যারা বলপয়েন্ট ব্যবহারের পর আবার ফিরেছেন ঝরনাকলমে। এ প্রজন্মের অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন নতুন করে এ ধারায় যুক্ত হতে। বন্ধুবান্ধব বা ফেসবুক গ্রুপগুলোতে যুক্ত থেকে তারাও বলপয়েন্টের পরিবর্তে ফাউন্টেন পেন ব্যবহারের কথা চিন্তা করছেন।
একটি ফাউন্টেন পেন ঘিরে থাকে কত যত্ন — একে ধোয়া, পরিস্কার করা, রোদে শুকোনো, কালি ভরা, সবসময় সঙ্গে রাখার মতো বাড়তি মনোযোগ। আর মনোযোগ তো তাকেই দেওয়া যায়, যার প্রতি থাকে ভালোবাসা আর টান। বলপয়েন্ট এসে ফাউন্টেন পেনের বাজার কেড়ে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আবেগটুকু নিতে আর পারেনি। এ কারণেই হয়তো এত দীর্ঘ সময় পরও মানুষ আবার ফাউন্টেন পেনের দিকে ঝুঁকছেন।