এই সব বাড়ি এখন শুধুই ছবি
লেখালেখির সুবাদে যে কাজটি আমাকে গত দুবছরে সবথেকে বেশি আনন্দ দিয়েছে, তা হলো পুরান ঢাকা চষে বেড়ানো। রাস্তার অলিগলি ধরে গন্তব্যহীনভাবে হেঁটে বেড়িয়েছি এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। কখনো কোনো ঐতিহ্যবাহী খাবারের খোঁজে, কখনো বাড়িঘরের খোঁজে, কখনো বা উৎসব-সংস্কৃতির খোঁজে।
আর এসব খুঁজতে গিয়ে জেনেছি এই বৃদ্ধ নগরীর যৌবনকে। পুরান ঢাকার জরাজীর্ণ এই বাড়িগুলোর দিকে যখন তাকাই এখন, চোখে সেসব জৌলুস আর স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাসগুলোই ভেসে ওঠে কেবল। যেমন কোনো প্রাচীন বারান্দা দেখলে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ, স্যাঁতসেঁতে ভবন মনে হয় না। বরং সে বারান্দায় কীভাবে ঝালর দিয়ে সাজানো হতো, কীভাবে সন্ধে নামলে কুপি জ্বালিয়ে বারান্দা সাজানো হতো তা মনে হয়। আবার তাঁতিবাজার শাঁখারিবাজারের সরু গলিগুলো দেখলে মনে হয় কীভাবে জন্মাষ্টমীর মিছিলে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে সবাই একসাথে শামিল হতো এ রাজপথেই!
যদিও এখন চারপাশের সদ্য জন্মানো দোকানপাট, রাস্তাঘাটে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, তবু যেন এসব ছাপিয়ে চলে যাই সেই হারানো অতীতেই। তবে দিন দিন যেভাবে পুরাতন এসব স্থাপনা আর দালানকোঠাগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, তাতে এই 'হারিয়ে যাওয়া'র অনুভূতিও আর পাওয়া যাবে না। এই ভেঙে ফেলার হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না ২০০৯ সালে সরকারি গেজেটে হেরিটেজ হিসাবে স্কীকৃতিপ্রাপ্ত সেসব স্থাপনাও। হেরিটেজের তালিকাভুক্ত এবং অ-তালিকাভুক্ত এমন চারটি বাড়ি নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড খোঁজ চালিয়েছে। একসময় রাজধানীর হাজারীবাগ, লালবাগ, তাঁতিবাজার, ফরাশগঞ্জে সুউচ্চ এবং মনোমুগ্ধকর অট্টালিকা হিসেবে পরিচিত ছিল এই চারটি বাড়ি, যা আজ আর নেই।
চারুকলার শিক্ষার্থীদের জন্য হাজারীবাগের এই বাড়ি ছিল 'সাবজেক্ট', হয়েছে চলচ্চিত্র শুটিংও
'দেশ ভাগ হওয়ারও আগে, হাজী আফতাবউদ্দিন আহমেদ থাকতেন কলকাতার ভবানীপুরে। সেখানে ইস্ট পাকিস্তান ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন তিনি। এরপর ঢাকায় বদলি হলে এখানে চলে আসার জন্য গোছগাছ করতে শুরু করেন'—কথাগুলো বলছিলেন নাতি আসিফ আরশাদ আহমেদ। তিনি দাদাকেও দেখেননি। তাই ভবানীপুরে তাদের বাড়িঘরের অবস্থা ঠিক কী রকম ছিল, তা জানেন না। শুধু জানা যায়, ভবানীপুরে তাদের কয়েকটি বাড়ি ছিল এবং যতগুলো বাড়ি ছিল তারমধ্যে কেবল হাজারীবাগের এই বাড়িটিই তার দাদা বিনিময় করতে পেরেছিলেন। বাকি বাড়িঘরের কাগজপত্রগুলো সাতচল্লিশের দাঙ্গায় পুড়ে যায়।
নব্বই সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের মধ্যে হাজারীবাগের এই বাড়িটিই ছিল সবচেয়ে উঁচু। যদিও ভবানীপুরে তার দাদারা যে বাড়িতে থাকতেন, তা ছিল তিনতলা। আর এখানকার বাড়িটি দোতলা। দোতলা হলেও এখনকার যুগে তা চারতলার সমান উঁচু।
ইন্টারনেটে বাড়িটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির সময় অনেক জায়গাতেই এর নাম খুঁজে পাই, 'মানিকবাবুর বাড়ি'। মানিকবাবুর পদবী বা পুরো নাম জানা যায় না। তবে এলাকার অনেকেই এখনও এই বাড়িকে মানিকবাবুর বাড়ি বলেই ডাকেন। এই মানিকবাবু ছিলেন একজন হিন্দু জমিদার। তার ছিল দুই ছেলে। আসিফ জানান, এ দুভাইয়ের কোনো একজনের থেকেই বাড়িটি বিনিময় করেন দাদা আফতাবউদ্দীন আহমেদ। অন্য ভাইয়ের নামে যে অংশটুকু ছিল, কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সে বাড়ি আর বিক্রি করতে পারেননি। পরে তা বিভিন্ন মানুষের দখলে যেতে থাকে। আরশাদ আহমেদের বাড়িটিই অবশিষ্ট রয়ে গেছে মানিকবাবুর পুরো সম্পত্তির মধ্যে।
আরশাদের মতে, দাঙ্গার আগে ১৯৪৬ সালেই বাড়িটি ক্রয় করেন তার দাদা। যদিও এই বাড়িতে তিনি উঠে যেতে আর পারেননি, তার আগেই মৃত্যু হয় তার। স্বাধীনতার পর মাঝে প্রায় বিশ বছর সরকারি রিকুইজিশনের জন্য বাড়িটি দখলকৃত ছিল। কাগজপত্র থাকায় বাড়িটি শেষ পর্যন্ত রক্ষে হয়। তবে এ উদ্ধারের কাজে আরশাদের দাদি রওশন আরা বেগম একাই লড়েন।
এখানেই শেষ নয়। ২০০৩ সালে মুখোমুখি হতে হয় আরেক ভোগান্তির। বিশিষ্ট স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর পরিচালিত 'আহা!' চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে বাড়িটি ছেড়ে দিতে হয়েছিল আসিফ আরশাদ আহমেদের পরিবারকে। দু-তিন মাসের কথা বলে প্রায় দুবছর এই বাড়িতে শুটিং চালায় তারা। ফলে বাধ্য হয়েই দুবছর পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকতে হয়েছে আরশাদদের। প্রথমে যদিও তাদের ইচ্ছে ছিল ২০০৩ সালেই বাড়িটি ভেঙে ফেলার। কিন্তু শুটিংয়ের জন্য বাড়িটি ভাঙতে হয়েছে ২০০৫ সালে। আরশাদ জানান, '২০০৩ সালে সিমেন্ট-বালুর যে দাম ছিল, দুবছর পর ২০০৫ সালেই সেই দাম বেড়ে তিনগুণ হয়ে যায়।'
ফলে একে তো দুবছর বাড়িভাড়ার টাকা, এরপর ২০০৫ সালে বাড়ি বানানোর খরচ, সবমিলিয়ে বেশ মোটা অঙ্কের নগদ টাকার লোকসান হয় তাদের। এমনকি এ বাবদ কোনো ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি বলে আক্ষেপ করেন আরশাদ।
পুরো বাড়িটি ভাগের আগে আসলে কতটুকু ছিল, তা আরশাদরা নিজেরাও জানেন না। তারা তো কিনেছেন মানিকবাবুর এক ছেলের অংশটুকু। তবে আরশাদের বর্ণনামতে, বাড়িটি ছিল মূলত অর্ধচন্দ্রাকার। বিশাল বড় জায়গাজুড়ে এ বাড়ির বাগানে এমন কোনো দেশি ফল গাছ নেই যা ছিল না। চারুকলার শিক্ষার্থীদের দেখতেন সকাল সকাল এসে রাস্তার ওপরেই বসে যেতেন বাড়ির ছবি আঁকার জন্য। আরশাদ জানান, ছবিতে বাড়িটিকে যেভাবে দেখাচ্ছে, তা মূলত একেবারে শেষদিকের ছবি। সম্ভবত ২০০৩ সালের পর, যখন তারা বাড়িটি ছেড়ে দেন ভেঙে ফেলার জন্য, তকনকার।
মানিকবাবু এখানে নেই দাঙ্গার সময় থেকেই। কিন্তু তার নামে এখনো সবাই রাস্তা চেনে। হাজারীবাগ পার্ক যেখানে শেষ হয়েছে, তার পরপরই মানিকবাবুর ঢাল। বাড়ির নামেই রাস্তার নাম।
বাড়িটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত বলে অনুমান আরশাদের। কেননা এই অঞ্চলের অন্যান্য প্রাচীন স্থাপনাগুলোও সে সময়েই তৈরি। একসময় এই বাড়ির সাথে বুড়িগঙ্গা নদীর ঘাট ছিল। আরশাদের মনে পড়ে, ছোটোবেলায় বাড়ির পেছনে দাঁড়ালে নদী দেখতে পারতেন। হাজারীবাগের মানিকবাবুর এই বাড়ি নিয়ে ২০২১ সালে 'মনের মধ্যে আছে যে ঢাকা' শিরোনামে প্রথম আলো'র এক স্মৃতিচারণ লেখা হয়। লেখক সেরীন ফেরদৌস সেখানে লিখেছেন:
'সত্তর আশির দশকে বিশাল বড় লোহার গেটওয়ালা বিশাল এই জমিদার বাড়িটি তখন পোড়ো বাড়ি। গেটে সব সময়ই তালা দেওয়া থাকত। সন্ধ্যার পর আলোও জ্বলত না প্রায়। দিনের বেলায় একা একা সে বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে গেলে কেমন যেন অসহায় লাগে। কেউ কেউ নাকি ভূত দেখেও থাকবে! আমার বড় বোন বলত, প্রেতাত্মা থাকবে না! জমিদাররা তো আর ভালো মানুষ ছিল না, অতৃপ্ত আত্মা থাকাই স্বাভাবিক। ভুলেও ওই বাড়ির ভেতর ঢুকবি না।'
ভারী লোহার গেটের এই বিশালবড় জমিদারবাড়িও নেই, নেই ভূত-প্রেতাত্মাদের নিয়ে রক্ত হিম হয়ে আসা কোনো গল্পও। আরশাদের বাবা ফুপুদের মধ্যে ভাগ হয়ে গোটা জায়গাটুকু এখন ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা বাড়ি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। আর বাড়িটির সামনের উঠোনের অংশটুকুতে একতলা দালান তৈরি করে আরশাদ থাকছেন তার মা, ভাই ও পরিবার নিয়ে।
'চকবাজার, পোস্তা, লালবাগ সব মিলে লালাবাগের এই বাড়িটি ছিল দেখার মতো একটি বাড়ি।'
লালবাগের গেটের সামনে নেমে সবাইকে মোবাইলে সেভ করে রাখা হলুদ বাড়িটার ছবি দেখাচ্ছিলাম। বাড়ির রং হলুদ দেখালেও, এটা আসলে বাদামি সাদা রঙের। প্রায় বিশ বছর আগেও বাড়িটা এখানেই ছিল। এমন নকশাখচিত, চুন-সুরকির কাজ করা বিশাল দালানের কথা কারও সহজে ভোলবার কথা না। বরং এ বাড়ির সৌন্দর্য্য এমন যা এখনো অনেকের স্মৃতিতেই তাজা। তাই বয়স্ক দোকানদারদের কাছেই গেলাম। তারা শুধু চিনলোই না, বাড়িটি কে কবে বিক্রি করেছেন, কিনেছে সে-ও বলে দিলো। বাড়ির মালিকের নাম মরহুম হাজি সুলতান। হাজী সুলতানের বাড়ি বললেই দেখিয়ে দেয় ছয়তলা সমান একটি অ্যাপার্টমেন্ট।
ভেতরে গিয়ে কথা বললাম হাজি সুলতানের ছেলে হাজী ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে। তাদের পৈতৃক ভিটে ছিল চুড়িহাট্টায়। কিন্তু ৬৩ সালে তার বাবা(হাজী সুলতান) বাড়িটি কেনেন সরকার থেকে। তখন থেকে এখানে তাদের বাস। হাজি সুলতানের নয় ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। তারা, সবাই ছোটো থেকেই এ বাড়িতে বড় হয়েছেন। বাড়ি নিয়ে জানতে চাইলে প্রথম যে কথাটি ষাটোর্ধব ইসমাইল সাহেব বললেন, 'পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্ষণাবেক্ষণ আমরাই করতাম। মানে আমার বাবা। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার থেকে স্বীকৃতিও পেয়েছেন আমার বাবা। প্রতিবছর বা দু বছর পর পরই বাবা বাড়ি রঙ করতেন, পরিস্কার করতেন, কোনোকিছু ভেঙ্গে গেলে তা আবার আগেরমতো করে বানাতেন। বাড়ির ওপর 'ॐ' লেখা ছিল, সেটি মুছে শুধু আরবীতে আল্লাহু টুকু লিখেছেন। পরিবর্তন বলতে শুধু এ-ইটুকুই।'
বাড়িটির পূর্ব ইতিহাস বলতে দেশভাগের সময় বাড়িটি ছিল হিন্দু ছাত্র হোস্টেল- এটুকু জানা যায় কেবল। হোস্টেলের নাম বা কোন স্কুল বা কলেজের ছাত্ররা এখানে থাকত, তা বলতে পারেননি ইসমাইল হোসেন। তিনি জানান, 'দুটো বৈঠকখানা, তিনটি উঠোন, দুটি টয়লেটসহ প্রায় ষোলো-আঠারোটা ঘর ছিল এ বাড়িতে। বাবা মা ভাইবোনসহ দুজন লজিং মাস্টারও থাকতেন বাড়িতে। খোলামেলা এই বাড়িতে আলো এবং বাতাস ছিল পর্যাপ্ত। চুন সুড়কির কাজ হওয়ায় বাড়ি ছিল খুব ঠান্ডা, ছিল লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। হারিকেনের তাক, লালমেঝের উঠোনগুলোতে যখন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়তো, বোনেরা নেমে পড়তেন বৃষ্টিস্নান নিতে। একশো দেড়শো জালালি কবুতর এসে বসে থাকত ছাদের রেলিংয়ে। কেল্লা তো তখনও লালবাগ কেল্লা হয়ে ওঠেনি। তাই খেলতে যেতাম এই কেল্লার মাঠেই। তারকাটা টপকে সোজা চলে যেতাম। তিনটে বড় উঠোন ছিল। শীতের দিনে পিঠা উৎসব, মিলাদ বা বিভিন্ন আয়োজনে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশিদের ডাকা হতো। সবাই উঠোনে জড়ো হয়ে খেতে বসতো'-স্মৃতির পাতায় হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে কথাগুলো পরপর বলছিলেন তিনি।
প্রায় পাঁচ কাঠার ওপরে বাড়িটিতে এখন দশটা ফ্ল্যাট। আমদানির ব্যবসা ছিল তাদের। এছাড়া ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরে বাড়ি আছে , চকবাজারে দোকানপাট সহ, চক বোর্ডিং তাদের। পুরান ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পরিবার তারা। ইসমাইল জানান, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বইতে কাভারেজ দেয়া হয়েছিল আমাদের বাড়ির। কক্সবাজারের রেস্ট হাউজ গুলোতে এই বাড়ির ছবি ছিল বাংলাদেশের হেরিটেজ বাড়ির নিদর্শন হিসেবে। বিদেশিরা ঘুরতে এসে দরজা দিয়ে ঢুকে যেত। ভর্তি পরীক্ষার সময় চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের, এই বাড়ির ছবি দেওয়া হতো আঁকার জন্য। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, ছাত্রছাত্রী রাস্তায় কাগজ ছড়িয়ে বসে আছে, আর ছবি আঁকছে। চকবাজার, পোস্তা, লালবাগ সব মিলে এই বাড়িটি ছিল দেখার মতো একটি বাড়ি।'
কিন্তু প্রায় দুশো বছর পুরোনো বাড়ি হওয়ায়, রাস্তা বড় করার সময় বাড়িতে ফাটল ধরে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় বাড়িটি শেষমেশ ভেঙ্গেই ফেলতে হয়। এই অ্যাপার্টমেন্টের জায়গাতেই একসময় সগর্বে দাঁড়িয়ে ছিল অত্র এলাকার অন্যতম সুন্দর এই বাড়িটি।
'যতদিন সম্ভব আমরা মেরামত করে থেকেছি এই বাড়িতে। কিন্তু একসময় যখন দেখলাম বাড়িটি যেকোনো মূহুর্তে ভেঙ্গে পড়তে পারে, যা আমাদের এবং রাস্তার মানুষের জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তখনই ভেঙ্গে ফেলা হলো। আজ বিশ বছর পরও আফসোস এতটুকু কমেনি বাড়িটার জন্য।'
তাঁতিবাজারের জাঁকজমকপূর্ণ স্থাপনা ছিল ২৭ নাম্বারের এই বাড়িটি
২৭ কোতায়ালী রোড- এই ঠিকানা ধরে তাঁতিবাজার গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। দুপাশে সোনার দোকানগুলোতে চলছে লাল সবুজ লাইটিং। যথারীতি কয়েকজনকে ছবি দেখানোর পরই তারা দেখিয়ে দেয় এক স্বর্ণকারের দোকান। জুতো খুলে দোকানে ঢুকে গিয়ে বসলাম। ছবিটা দেখাতেই স্বর্ণকার নিজেই ফোনটা হাতে নিলেন। ছবির বাড়িটার ওপর হাতটা ছুঁয়ে বলে উঠলেন, 'আমাদের বাড়ি... কতদিন পর দেখলাম! কোথায় পেলেন?'। প্রথমে ভেবেছিলাম এই বুঝি মালিক। কথা বলে জানলাম, তারা মালিক নয় ঠিকই। কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই এ বাড়ির নিচতলায় দোকান ভাড়া। তাই মালিক না হলেও আবেগটা তেমনই। নাম জানাতে একদমই অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি জানান, ব্রিটিশ আমল থেকেই এই বাড়ির নিচে তাদের দোকান। বংশপরম্পরায় এখন তিনি দেখছেন এই ব্যবসা।
বাড়িটি ছিল এক হিন্দু জমিদারের। নাম কার্তিক চন্দ্র সেন। কার্তিক সেন এবং তার ভাই অনন্তলাল সেন তাঁতিবাজারের অভিজাত দুই সন্তান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কোতায়ালী থানাতেই বারো তেরোটা বাড়ি ছিল কার্ত্তিক চন্দ্র সেনের। কিন্তু গন্ডগোলের সময় বাড়ি বিক্রি করে পাড়ি জমান কলকাতায়। বিক্রি বলতে অন্যদের মতো তিনিও বিনিময় করেন। বিনিময়কারীর নাম খলিলুর রহমান। পৈতৃক নিবাস বিক্রম্পুরে হলেও, তখনকার ধনী ব্যবসায়ীদের মতো খলিলুর রহমানেরও ঢাকা-কলকাতা অনেক ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। ঐ হিসেবে খলিলুর রহমানের অনেকগুলো প্রপার্টি ছিল। বসতবাড়ি, সিনেমা হল, কাগজের কারখানা, সাবানের কারখানা আরও কত কী। ওখানকার জমিদারদের সমানই ছিল বলা যায় তাকে। ৬৩ সালে দাঙ্গার সময়ে এসকল সম্পত্তির ওপর আক্রমণ হয়, অনেক বাড়িঘর আগুন পুড়ে নষ্ট হয়। তখন থেকেই খলিলুর রহমান বুঝতে পারেন, কলকাতায় বেশিদিন আর টিকতে পারবেননা। তাই বাংলাদেশে চলে আসার কথা ভাবেন। সে অনুযায়ী খুঁজতে থাকেন ঢাকার এমন কোনো পরিবারকে, যাদের সাথে এই সম্পত্তিগুলো বিনিময় করা যাবে। ঢাকার তাঁতিবাজারের কার্তিক চন্দ্র সেন ছিল তেমন একজন। খলিলুর রহমান তার সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক করে যান। কিন্তু বাহাত্তরের ডিসেম্বরের দিকে মারা গেলে তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি। এরপর ১৯৭৭ সালে তার ছেলেরাই কাগজপত্র, টাকাপয়সার পাট চুকিয়ে ফেলেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায়।
এখানে এসে তারা বসবাস শুরু করেন তাঁতিবাজারের অন্য একটি বাড়িতে। কারণ অনেক আগে থেকেই ২৭ নাম্বার বাড়িটি ডিসি অফিসের কর্মচারীদের থাকার জন্য রিকুইজিশন নিয়েছিল। তবে সরকারী রিকুইজিশন বাড়ি হবার আগে কখনো কার্তিক চন্দ্র সেনরা এ বাড়িতে থাকতেন কি-না সে সম্পর্কে জানা যায় না। তাঁতিবাজারের একমাত্র জাঁকজমকপূর্ণ স্থাপনা ছিলো ২৭ নাম্বার এই বাড়িটি। আশেপাশের বৃদ্ধ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু জানা যায়, এই বাড়ির অন্যতম আকর্ষণ ছিল এর অলঙ্কারিক ভারী পেটানো লোহার কাজের বারান্দা। যা শহরের পুরানো অন্যনায় বাড়িগুলোতে সহসা দেখা যায়না। স্থানীয়রা জানান, যতদিন বাড়িটি ছিল, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পর্যটকরা ভবনটির ছবি তুলতে আসতেন।
বর্তমানে এই বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন মোঃ সালাউদ্দীন। তিনি জানান, এ বাড়ির নির্মম ইতিহাস। সালাউদ্দীনরা থাকতেন তখন গ্রিনরোডে। সেখানেও প্রায় বিশ পঁচিশটার মতো বাড়ি আছে তাদের। এদিকে এই বাড়ি ছিল ডিসি অফিসের কর্মচারীদের বসতস্থল। এভাবেই চলছিল। ২০১৫-১৬ সালের ঘটনা, একদিন সালাউদ্দীনের কাছে ফোন আসে। সালাউদ্দীন ও তার পরিবার জানতে পারে, তাঁতিবাজারের ২৭ কতায়ালী রোডের ঐ বাড়িটি আর নেই। এটি ভেঙে ডেভেলপারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। দোতালা এ বাড়িটির নিচে সামনের দিকে ছিল দোকানপাট, যা এখনো আছে। এই দোকানগুলোর ভাড়াই তারা কেবল পেতেন এই বাড়ি থেকে। আর পেছনে এবং দোতালা মিলিয়ে থাকতো চারটি পরিবার। এরমধ্যে একটি পরিবারে থাকত ডিসি অফিসের রেকর্ড কিপার। নাম আব্দুস সালাম তালুকদার। তার ছেলে উকিল এবং স্ত্রী জাহানারা তালুকদার। এই পরিবারটি পুরোনো রেকর্ড সরিয়ে এবং ভুয়া দলিল তৈরি করে বাড়িটির মালিক বনে যায়। এরপর এই আট নয় বছরে নানা মামলা মোকদ্দমা করে বর্তমানে বাড়িটির কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে এ বাড়ির ভবিষ্যৎ কতদূর সালাউদ্দীনরা নিজেরাও জানেননা। শুধু লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া তাঁতিবাজারে তাদের যেকয়টি বাড়ি আছে, সবগুলোতেই ঝামেলা চলছে।
ফরাশগঞ্জের এই কালো বাড়িটি ছিল একসময়ের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কালীচরণ সাহা পরিবারের
ফরাশগঞ্জের বিকে দাস লেন থেকে লক্ষ্মী ভিলা পার হয়ে আরেকটু এগোলেই আগে পাওয়া যেত এই কালো পাথরের বাড়িটি। বাড়িটি ছিল কোনো এক সাহা পরিবারের। যার এক পুরুষের দুই ভাইয়ের নাম উমানন্দ সাহা ও নিতাই সাহা। সে-ও নেই, বাড়িটিও নেই। বাড়িটি এখন আর নেই।
'ঢাকা শহরে এদের বহু প্রপার্টি ছিল; বহু প্রপার্টি। মারা যাবার পর বিক্রি করে দিয়েছেন টাকার জন্য। কোনো ব্যবসা ছিল না। জমিদার ছিল, সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে করে শুধু খাইসে।'
'নিতাইবাবু সকাল থেকে ধুতি পরত আর রাতে ছাড়তো। ইস্ত্রি করা জামাকাপড় পরত আর মন্দিরে মন্দিরে ঘুরত।'
এই ছিল প্রাথমিকভাবে এলাকাবাসীর কাছ থেকে পাওয়া সাহা পরিবারের পরিচয়। উমানন্দ ও নিতাই এ দুই ভাইয়ের কথা এখনো অনেক মুরুব্বীরাই মনে রেখেছেন। তাদের বাবার নাম রাধামাধব সাহা। আর দাদা কালীচরণ সাহা। কালীচরণ সাহা ছিলেন ওই এলাকার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। কালিচরণ সাহার নামেই রাস্তার নাম হয়েছে কালীচরণ সাহা রোড। নাজির হোসেনের 'কিংবদন্তীর ঢাকা' বইয়ে কালীচরণকে নিয়ে লিখেছেন, ১৯২২ সালে ঢাকা পৌরসভাকে সাড়ে তিন হাজার টাকা বিজলী বাতি সম্প্রসারণের জন্য দান করায় ঐতিহাসিক কাপুড়িয়ানগরের নাম কালীচরণ সাহা রোড করা হয়।
কালীচরণ সাহার বাবার আমল থেকে এই বাড়ি। কালীচরণের দুই ছেলে রাধাগোবিন্দ সাহা ও রাধামাধব সাহা। উমানন্দ ও নিতাইবাবু ছিলেন রাধামাধব সাহার দুই ছেলে। উমানন্দ সাহা ছিলেন চিরকুমার। তিনি সব সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান ভ্রাতুষ্পুত্র অনুপম সাহা গোপালকে।
অনুপম জানান, 'এই বাড়িতে আমরা বা আমাদের বাপ-কাকারাও কেউ কখনো ছিলাম না। সবসময় ভাড়া দেয়া ছিল। বিহারীরা ছিল, যারা প্রায় বিশ বছর ভাড়া না দিয়ে এই বাসায় থেকে গেছে! দুবার উচ্ছেদ মামলা হয়েছে, তা কাজ হয়নি।'
বাড়িটি কিনেছিলেন তার দাদা রাধামাধব সাহাই। তবে বাড়িটি কবে বা কার থেকে কিনেছিলেন, তা নিজেও জানেন না। বাড়ির সামনের অংশে নিচতলায় ছিল দোকানপাট। বিখ্যাত কাশ্মীরি স্টোর ছিল সেখানেই, যা এলাকাবাসীর স্মৃতিতে এখনো অমলিন। আর দোতলায় ছিল বসতবাড়ি। তিনটে পরিবার থাকত সেখানে। অবশ্য পরের দিকে বাড়িঘর ভাঙতে শুরু করলে পুরোটাই কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জায়গাটা ছিল সাড়ে পাঁচ কাঠার কাছাকাছি। অনুপম সাহা ডেভেলপারকে দিয়ে নতুন বাড়ি ওঠানোর চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। প্রায় পাঁচ বছর পড়ে থাকার পর ২০১৬ সালের শেষদিকে এমপি হাবিবুল্লাহ মোল্লার কাছে বিক্রি করে দেন। এমপি কিনে নিয়ে ভেঙে ফেলে অন্য বাড়ি বানিয়েছেন সেখানে।
অনুপম বলেন, 'হিন্দু সম্পত্তি রাখাই মুশকিল। এনিমি সম্পত্তি হয়ে যায়। লুটপাট করে হিন্দু সম্পত্তি। তাই বিক্রি করে দিয়েছি। মোটামুটি ভালোই দাম পেয়েছি।'
ফরাশগঞ্জের কাপুরিয়ানগরে কালীচরণ সাহা পরিবারের এসব সম্পত্তি বর্তমানে দেখাশোনা করছেন অনুপম সাহাই। এখন তারা থাকেন ফরাশগঞ্জের কাপুরিয়ানগরে। এছাড়া মিটফোর্ড, বাবুবাজার, আরমানিটোলাতেও তাদের সহায় সম্পত্তি কিছু অবশিষ্ট আছে। একসময় তারা অনেককিছুর ব্যবসাই করেছেন। মুড়ির টিনের ব্যবসা ছিল, ক্যাল্ট্যাক্সের এজেন্সি, ক্যান্ডি কারখানা ছিল, চিনির লাইসেন্স ছিল, পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ টোবাকো কোম্পানির বিটিসির এজেন্সি ছিল।
ঢাকায় মোট তেরোটি বাড়ি ছিল তাদের। এই মহল্লাতেই চারটি। বাড়িঘর যা ছিল অর্ধেক গেছে পাকিস্তানিদের হাতে, অর্ধেক গেছে বিক্রি হয়ে। সব যেতে যেতে কাপুরিয়ানগরের ওই দোতলা বাড়িটিই এখন শুধু টিকে আছে। এখানেই থাকেন অনুপম সাহা। শরিকরাও চলে গেছে কলকাতা, বিদেশ-বিভূঁইয়ে। এক ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকছেন এখানে। পৈতৃক ব্যবসাগুলোই যতটুকু টিকে আছে দেখভাল করছেন।
ঢাকার এবং ঢাকার বাইরে এরকম অসংখ্য স্থাপনা আছে যা আজ আর নেই কিংবা নেই হওয়ার পথে। কিন্তু একটু গভীরে খোঁজ করলে দেখা যাবে, প্রতিটিরই কোনো না কোনো ইতিহাস ছিল। কিন্তু না বাড়িগুলো রাখা সম্ভব হচ্ছে, না পারছি আমরা ইতিহাসগুলো জানতে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: যেহেতু বাড়িগুলোর প্রতিটির বয়স একশোর বেশি হবে, এবং বাড়িগুলো পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন, তাই সেই সময়ের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। যারাই বা বেঁচে আছেন, তাদেরও স্মৃতিভ্রম হয়েছে বার্ধক্যের কারণে। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে এবং খুব বেশি গভীরেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। তা-ও চেষ্টা করা হয়েছে বাড়িগুলোর সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ইতিহাস তুলে আনার।