নাজমুস ডি শামস: দেশের বিয়ের অনুষ্ঠান পাল্টে দিচ্ছেন যে ব্যক্তি
আপনি যদি জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ 'মেইড ইন হেভেন' দেখে থাকেন, তাহলে হয়ত আপনিও আমাদের দেশে একই ধরনের 'অল-ইন-ওয়ান' ওয়েডিং প্ল্যানার দ্বারা আপনার বিশেষ দিনটি সাজিয়ে তোলার কল্পনা করেছেন। হতাশ হবেন জেনেও হয়ত গুগলে সার্চও দিয়েছেন। তবে আপনার সেই কল্পনাকেই বাস্তবে রূপান্তর করছেন একজন। তার নাম নাজমুস ডি শামস।
নাজমুস ডি শামস বর্তমানে দেশের ওয়েডিং প্ল্যানারদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে তার তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো স্প্লেন্ডার বাই আনিকা বুশরা, ওয়েডিং বেরিস এবং পেপার বুটিকস।
'মেড ইন হেভেন' সিরিজটির বাস্তবজীবন সংস্করণের মতো শামস বিয়ের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সাজসজ্জা থেকে শুরু করে আমন্ত্রণ কার্ড এবং 'ডালা' পর্যন্ত সম্পূর্ণ সেবা প্রদান করছেন। যে কারণে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে শহরের অসংখ্য উচ্চবিত্ত মানুষের কাছে প্রথম পছন্দ এখন শামস।
২০১৩ সালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন শামস। তার কর্মজীবন শুরু হয় এলজি ইলেকট্রনিক্সে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে। চাকরিতে পূর্ণকালীন নিযুক্ত থাকা অবস্থায়ই তিনি তার ব্যবসা শুরু করেন।
শামস বলেন, "এমন নয় যে আমার আগে থেকেই ব্যবসার পরিকল্পনা ছিল। আমি একজন কর্পোরেট লোক ছিলাম, বিশেষ করে একজন মার্কেটিংয়ের লোক। তবে আমি মনে করি আমার মধ্যে সবসময় একজন উদ্যোক্তা হওয়ার স্পৃহা ছিল।"
২০১৬ সালে, শামস তার সহযোগী আনিকা বুশরার সাথে মিলে তার প্রথম ব্যবসায় উদ্যোগ বা স্টার্টআপ শুরু করেছিলেন। সে সময় অনিকা একজন উদীয়মান মেকআপ শিল্পী হিসেবে নিজের নাম অর্জন করেছেন।
শামস বলেন, "আনিকার মেকআপ সম্পর্কে ভাল জ্ঞান ছিল, আর আমার ছিল ভাল মার্কেটিং দক্ষতা। আমরা একসাথে মিলে 'স্প্লেন্ডার' এর যাত্রা শুরু করেছিলাম। আর শুরুর দিকে আনিকার বাসা থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করতাম।"
তিনি যোগ করেন, "আনিকা কনেদের সাজগোজসহ সার্বিক দিকে খেয়াল রাখত। আর আমি মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া এবং লজিস্টিকসের মতো বিষয়গুলো দেখতাম। মাত্র এক বা দুই বছরের মধ্যে স্প্লেন্ডার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে আমরা নিজস্ব বাণিজ্যিক কার্যালয় স্থাপন করি।"
শামস পরের বছর তার এক বন্ধুর সাথে মিলে 'ওয়েডিং বেরি' নামে একটি ইভেন্ট অর্গানাইজার প্রতিষ্ঠান চালু করেন।
তিনি বলেন, "কর্পোরেট সেক্টরে আমার চাকরিতে ঘন ঘন ইভেন্ট প্ল্যানিং প্রয়োজন হতো, তাই এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার বেশ ধারণা হয়েছিল। তাই আমি চিন্তা করলাম নিজেই এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করলে কেমন হয়!"
স্প্লেন্ডার এবং ওয়েডিং বেরিসের মাধ্যমে শামস এই ব্যবসার একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্কে প্রবেশ করেন। বিবাহ পরিষেবাগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদাগুলো আবিষ্কার করতে থাকেন এবং এই অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি একই বছর এক বন্ধুর সাথে 'পেপার বুটিক' প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যে পেপার বুটিক কার্ড শিল্পে এবং ডালা সজ্জায় বিশেষায়িত নাম হয়ে উঠেছে।
তিনি মন্তব্য করেন, "অবশ্যই, এই ব্যবসায় আরও অনেক ছোট স্থানীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তবে তারা ছোট আকারে কাজ করে। যখন হাই-প্রোফাইল বিয়ের কথা আসে, তখন আমরাই গেমটিতে একমাত্র খেলোয়াড়। এটি অনেকটা ফাঁকা মাঠে গোল করার মতো।"
শামসের প্রতিষ্ঠানটি মূলত উচ্চবিত্ত গ্রাহকদের লক্ষ্য করে সেবা প্রদান করে। স্প্লেন্ডারে ব্রাইডাল মেকআপ শুরু হয় ২৫ হাজার টাকা থেকে। আর পেপার বুটিকে ন্যূনতম ডালা ডেকোরেশনের দাম ৫০ হাজার টাকা।
একটি সৃজনশীল, উদ্যমী দল
পেপার বুটিক-এ, শামস শিল্প ও কারুশিল্পের প্রতি আগ্রহ আছে এমন সৃজনশীল তরুণদের নিয়ে একটি দল তৈরি করেছেন।
তিনি বলেন, "বর্তমান প্রজন্মের যে-সব দম্পতির বিয়ে হচ্ছে, তারা আমার বয়সী নয়। তাদের মানসিকতা এবং ইচ্ছাগুলো আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করার জন্য আমার এমন একটি দল দরকার যারা তাঁদের সমবয়সী অথবা কাছাকাছি। এজন্য আমরা পেপার বুটিকে আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তরুণদেরকে প্রাধান্য দিই।"
বর্তমানে শামসের ব্যবসায় প্রায় ৬৫ জন কর্মচারী আছেন। তার সব ব্যবসা ধানমন্ডিতে অবস্থিত। শামস তার মার্কেটিং (বিপণন) বিভাগ সম্পর্কে খুব নির্দিষ্ট এবং তার দলে পাঁচজন মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ রয়েছেন। এমনকি টিকটক ভিডিও পরিচালনার জন্যও তার একজন ব্যক্তি রয়েছেন।
বড় বাজেটের বিয়ের সুবিধা ও অসুবিধা
শামস বলেন, "বড় বাজেটের বিয়ে পরিচালনার সুবিধা হলো বাজেট নিজেই। বাজেটের সীমাবদ্ধতা না থাকলে আমাদের সৃজনশীল হতে এবং নিজেদের মতো করে অনুষ্ঠান আয়োজন করার সুযোগ থাকে।"
শামস জানান বাজেটের সীমাবদ্ধতা না থাকলে সেখানে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। অনুষ্ঠানে নতুনত্ব আনার চিন্তা করা যায়। তবে বড় বাজেটের অনুষ্ঠানে কিছু দায়িত্বও থাকে। আপনি এখানে ইচ্ছে করলেই যেন-তেন অনুষ্ঠান আয়োজন করে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে পারবেন না। এ বাজেটের গ্রাহকরা অনুষ্ঠানের খরচ বাঁচানো থেকে অনুষ্ঠান কতটা সুন্দর হয়েছে তার দিকে বেশি মনোযোগ দেন। তাই এখানে কোনো আপসের জায়গা রাখা যায় না। তাদের সেবা সব দিক দিয়েই পরিপূর্ণ হতে হবে গ্রাহকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।
শামস বলেন, "আমাদের জন্য এমন গ্রাহকের মুখোমুখি হওয়া অস্বাভাবিক নয় যারা সবকিছুতে সেরাটা খুঁজেন। তারা আমাদের আগের করা সেরা কাজগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন এবং আগের থেকেও ভালো করার জন্য প্রতিনিয়ত তাগাদা দেন।"
শামসের ব্র্যান্ডগুলো গ্রাহকদের নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণে অত্যন্ত মনোযোগী, যা তাদের অনন্য দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবে রূপ দেয়।
শামস বলেন, "একবার আমাদের একজন ক্লায়েন্ট একটি ফলের ডালা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন, তাই আমরা তার জন্য কৃত্রিম ফল দিয়ে শৈল্পিকভাবে একটি ফলের গাছ তৈরি করে দিয়েছি। আরেকবার একজন ক্লায়েন্ট একটি আমন্ত্রণ বাক্সের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভিয়েতনামী ফেব্রিক চেয়েছিলেন এবং আমরা কোনো দ্বিধা ছাড়াই এটি বিদেশ থেকে আমদানি করেছি। আমাদের ব্যবসায় অসম্ভবকে সম্ভব করা অপরিহার্য।"
তবে অনেক সময় অতিরিক্ত চাহিদার কারণে একাধিক বিক্রেতা এবং তৃণমূল ব্যবসায়ীদের সাথে সমন্বয় করে একসাথে কাজ করাটা ওয়েডিং বেরি এবং পেপার বুটিকের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হয় বলে জানান শামস।
শামসের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আনিকার বুশরার সাথে মিলে করা 'স্প্লেন্ডার' থেকেই বেশিরভাগ আয় এবং লাভ আসে। তিনি মনে করেন, স্প্লেন্ডারের এ সাফল্যের কারণ শুধু আনিকার প্রতিভা নয় বরং তার মার্কেটিং কৌশল এবং দোকানের ভালো লোকেশন।
তিনি বলেন, "রাজধানীর সবগুলো প্রিমিয়ার সেলুন গুলশান ও বনানীভিত্তিক। কিন্তু ধানমন্ডিতেও এর ভালো বাজার রয়েছে। আনিকার স্প্লেন্ডার ধানমন্ডির সব থেকে বড় সেলুন। তাই গুলশান বা বনানীতে স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ থাকলেও আমরা ধানমন্ডিতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
শুধু বিয়ের মৌসুমে নয়, শামস সারা বছরই তার ব্যবসা পরিচালনা করেন। দ্য পেপার বুটিকে, তারা সারা বছর ধরে জন্মদিন এবং অন্যান্য ইভেন্টের জন্য বিশেষ ঘোষণা বাক্স বা 'এনাউন্সমেন্ট বক্স' তৈরি করে। স্প্লেন্ডার বিয়ের সাজগোজ ছাড়াও বিভিন্ন সেলুন পরিষেবা প্রদান করে। এছাড়া 'ওয়েডিং বেরি' অফ সিজনে বিয়ে বাদেও অন্যান্য ইভেন্ট পরিচালনা করে।
শামস বিশ্বাস করেন তার সামাজিকতা এবং মিশুক স্বভাব ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সুবিধা রেখেছে।
সব শেষে তিনি বলেন, "ওয়েডিং প্ল্যানিংয়ের মতো ইন্ডাস্ট্রিতে মানুষের মনের ভেতর জায়গা করে নেওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যবসায় ক্লায়েন্টদের সাথে দৃঢ়, দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি এবং তা বজায় রাখতে হয়। কারণ আমাদের অনেক কাজই মুখে মুখে এক অন্যের সুপারিশ থেকে আসে।"