‘সুইজারল্যান্ড প্রবাসী'-এর নেপথ্যের ‘প্রবাসী’ কে?
'আমি একজন সুইজারল্যান্ড প্রবাসী। এই দেশে আমরা পিজা নামে একটি খাবার খাই। যা খুবই সুস্বাদু। আমি জানতে চাই, বাংলাদেশে পিজা এখনো গেছে কিনা। দেশে যাই না অনেক বছর হয়। সুইজারল্যান্ডেই সেটেল, তাই দেশের খবর জানি না। পিজার দোকান না থাকলে দেশে একটা পিজার ব্যবসা দিব। আমাদের বাঙালি ভাইয়েরাও যাতে পিজার টেস্ট পায়। একটা নতুন খাবারের সাথে পরিচয় হয়।
ওসমান গনি
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী সংঘ'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়তো এমন পোস্ট অনেকেরই চোখে পড়েছে। এসব পোস্টে প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের চাকচিক্যময়, আরামের প্রবাস জীবনের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
'সুইজারল্যান্ড প্রবাসী' (Switzerland Probashi) নামক একটি ফেসবুক পেজের পোস্ট ওপরের লেখাটি। এ পেজে ওসমান গণি, কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান, প্লাম্বার আবুল কালামসহ আরও কয়েকজন সুইজারল্যান্ডপ্রবাসী বাংলাদেশি তাদের প্রবাসজীবনের মুখরোচক সব খবর জানিয়ে থাকেন। পাশাপাশি দেশে থাকা বাংলাদেশিদেরকে তাদের বিদেশের জীবন সম্পর্কে 'আলোকিত' করেন।
পেজটি খোলার ছয় মাসের মধ্যেই এর অনুসারীসংখ্যা এখন ৯৬ হাজার। বাংলাদেশের তুলনায় সুইজারল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জীবন কত 'দারুণ', তা তুলে ধরা হয় বাংলাদেশে দারুণ হিট হওয়া এই পেজের পোস্টগুলোতে। তাদের খাওয়া দারুণ সব খাবার, উপভোগ করা দারুণ সব দৃশ্য আর জীবনযাত্রা—এসবই এসব পোস্টের উপজীব্য।
এছাড়াও তারা প্রায়ই 'দুঃখী দেশবাসী'কে পরামর্শ দিয়ে থাকে। পাশাপাশি অ্যাডমিন প্যানেল কীভাবে দল হিসেবে কাজ করে, যার ফলে কখনও কখনও পেজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঝগড়া তৈরি হয়—তা নিয়েও পোস্ট দেওয়া হয় পেজটিতে।
প্রথম দেখায় যে-কারোরই মনে হবে, পোস্টগুলোতে বাংলাদেশিদের সোজাসাপটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। তবে একটু খুঁটিয়ে দেখলে মনে হবে, পোস্টগুলোতে চতুরভাবে অভব্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় ব্যঙ্গ করা হচ্ছে।
কিন্তু, এত জায়গা থাকতে সুইজারল্যান্ডকেই কেন বেছে নেওয়া হলো? কারণ অসাধারণ সুন্দর দেশ সুইজারল্যান্ড একজন প্রবাসী বাংলাদেশির সামনে তার স্বদেশীদের কুৎসিত চেহারা উন্মোচিত করে দিয়েছে।
একবার সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পেজের প্রতিষ্ঠাতা (নাম প্রকাশ না করার জন্য তাকে আমরা প্রবাসী হিসেবে উল্লেখ করব) বিদেশে বসবাসের কষ্ট নিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলেন। ওই পোস্টে তিনি বলেছিলেন, সুইজারল্যান্ড এমনকি তার প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকেও অনেক আলাদা। এতটাই আলাদা যে, যারা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে বসবাস করছেন, তাদের কাছেও এদেশে থাকাটাকে চ্যালেঞ্জিং মনে হবে।
কিন্তু ওই পোস্টের কমেন্ট বক্স সয়লাব হয়ে গিয়েছিল নেতিবাচক সব মন্তব্য। কেউ লিখেছিল, 'সামর্থ্য না থাকলে ওই দেশে থাকতে গেলেন কেন?', কেউ লিখল, 'এখানকার রীতিনীতিগুলো শিখে নিচ্ছেন না কেন?', আবার কেউ লিখল, 'বাংলাদেশিরা মাত্র একটা কাজই ভালো পারে—সেটা হচ্ছে বিদেশে এসে যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে দেশের নাম খারাপ করা'।
কানাকে কানা বললে যে সবাই এভাবে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে, কে জানত!
এরকম নেতিবাচক মানুষ শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গণ্ডিতেই আটকে নেই। 'প্রবাসী' কিছুদিন পরই টের পেলেন, এমন বেশ কিছু মানুষ তার আশপাশেই আছে।
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এ ধরনের মানুষ যেসব 'বিশ্রী' কথাবার্তা বলে এবং কাজকর্ম করে, সেসব টুকে রাখবেন। এভাবেই জন্ম হলো সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পেজের।
এখন আরও দুজন ব্যক্তি 'প্রবাসী'কে এ পেজ চালাতে সহায়তা করেন। তাদের একজন বাংলাদেশে থাকেন, আরেকজন থাকেন সুইডেনে।
প্রবাসী বলেন, 'দেড় বছর আগে লন্ডনে আসার পর অনেকবার রাস্তায় অজানা-অচেনা বাংলাদেশিরা এসে বলে গেছেন সেখানকার বাংলাদেশিদের সঙ্গে মেলামেশা না করতে। আমাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা, উল্টো প্রবাসী বাংলাদেশিরাই আমার কষ্টের কারণ হয়ে উঠলেন।'
বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা অনেকসময়ই দেশ থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের পছন্দ করতে পারেন না। কারণ তাদের ধারণা, শিক্ষার্থীরা শ্রমিক বা বৃত্তিমূলক চাকরি করতে যাওয়া বাংলাদেশিদের মতো 'সংগ্রাম' করতে পারবে না।
বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা অনেক ধরনের গোষ্ঠী গড়ে তোলে। যেমন, সিলেট থেকে বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশিরা সবসময় একসঙ্গে ওঠাবসা করে, আবার প্রথমে ইতালিতে গিয়ে পরে অন্য দেশে চলে যাওয়া- বাংলাদেশিরা দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে।
অনেকে আবার উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপে বসবাসকারীদের প্রবাসী বাংলাদেশিই মনে করেন না। তারা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে যারা থাকেন, একমাত্র তারাই 'প্রকৃত' প্রবাসী বাংলাদেশি।
এখন পেজটির প্রচুর অনুসারী থাকলেও শুরুটা সহজ ছিল না।
'প্রথমে সবাই মনে করতেন, আমি বাংলাদেশের মানুষদের ছোট করছি। তাই তারা পেজের পোস্টে আমাকে ভর্ৎসনা করে মন্তব্য করতেন, প্রতিবাদের অংশ হিসেবে বড় বড় ক্যাপশন লিখে আমার পোস্ট শেয়ার করতেন,' বলেন প্রবাসী।
আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'কিন্তু আমার পোস্টগুলো বাংলাদেশিদের ছোট করে করা নয়, বরং যেসব বাংলাদেশিরা অন্য বাংলাদেশিকে ছোট করে– তাদের নিয়ে করা স্যাটায়ার। পরে মানুষ ধীরে ধীরে বিষয়টি বুঝতে পারেন, পেজের কনটেন্টও পছন্দ করতে শুরু করেন।'
'আমার পোস্টের একটি দিক হলো এখানে বাঁকা কথায় টিপ্পনী কাটা হয় না; এগুলো স্রেফ বিনোদন। আমার মনে হয়, এ কারণেই মানুষ পেজটি পছন্দ করেন,' তিনি আরও বলেন।
এ পেজটি চালু করতে প্রবাসী উৎসাহ পেয়েছিলেন আরও একটা বাজে অভিজ্ঞতা থেকে। একবার এক রেস্তোরাঁয় শেফের পদে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন তিনি। ওই রেস্তোরাঁর মালিক ছিলেন এক বাংলাদেশি পুরুষ, ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন তার 'দেশি' গার্লফ্রেন্ড।
রেস্তোরাঁর পরিবেশ ছিল বেশ নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। তার ওপর খাবার দিতে দেরি করায় ম্যানেজার মেয়েটা এক্সিকিউটিভ শেফকে বললেন, 'তুই একটা চাকর, সেরকম করে কাজ কর না। আমার সঙ্গে গলা উঁচিয়ে কথা বলবি না, সম্মান দিয়ে কথা বলবি।' এটা দেখেই প্রবাসী বুঝতে পারলেন, এখানে থেকে পগারপার হওয়াই শ্রেয়।
একে-অপরের পাশে দাঁড়ানোর বদলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা একজন অন্যের পেছনে পড়ে থাকেন। অনেকেই বাংলাদেশ নিয়ে বিকৃত ধারণা পোষণ করেন, সেগুলো অন্যদের মধ্যেও ছড়ান।
প্রবাসী মনে করেন, বিদেশিরা প্রায়ই বাংলাদেশকে ছোট চোখে দেখেন। এ ধারণা বদলাতে তিনি অনেক বিদেশিকে বাংলাদেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
কিন্তু কেউ বাংলাদেশে আসতে চাইলেও প্রবাসী বাংলাদেশিরাই দেশ নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি নেতিবাচক দিকের কথা বলে তাদেরকে অনুৎসাহিত করেন।
'যারা রাজনৈতিক আশ্রয় খোঁজেন, তারা এমনটা বেশি করেন। রাজনৈতিক সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করে তারা বাংলাদেশকে খুবই অনিরাপদ একটি দেশ হিসেবে অভিহিত করেন,' বলেন প্রবাসী।
তবে সবাই খারাপ না। 'সবাই একরকম না। ভালো মানুষও আছে, কিন্তু তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন,' প্রবাসী বলেন। ওরকম মানুষ না পেলে বরং বাংলাদেশিদের কাছ থেকে দূরে থাকারই পরামর্শ তার। ওসমান গনি ও গংদের লেখা-পড়া হয়তো মজার, কিন্তু বাস্তবজীবনে তাদের 'চরিত্রের' মতো লোকদের সঙ্গে মেশাটা একদমই নয়।