বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে স্কাইডাইভিং-এ গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করতে চায় আশিক
ধরে নিন আপনি একটি ছোট টুইন অটার অথবা সেসনা ক্যারাভান বিমানের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।
দরজা খুললেই বিমানের ভেতরে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। নীচের মাটির দিকে তাকিয়ে আপনি ভয় পেতে পারেন। কিন্তু আপনি এত উঁচুতে আছেন যে নীচের মাটি বিমূর্ত চিত্রের মতো দেখাচ্ছে। আপনার মস্তিষ্ক হয়ত ধারণাও করতে পারছে না আপনি কতটা উঁচুতে (হতে পারে ১৩ থেকে ১৪ হাজার ফুট) আছেন মাটি থেকে।
এখন শুধু ঝাঁপ দেওয়াই বাকি।
একজন স্কাইডাইভার বিমান থেকে লাফ দেওয়ার পর প্রায় ৪ হাজার ফুট নিচে না আসা পর্যন্ত প্রায় এক মিনিট সময় নিয়ে পড়তে থাকে (পড়ন্ত অবস্থায় ১৪ হাজার ফুট থেকে ৪ হাজার ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে ১ মিনিট সময় লাগে) এবং তার পরেই প্যারাসুট খুলে দেয়।
৪০ বছর বয়সী ক্যারিয়ার ব্যাংকার আশিক চৌধুরী ২০১২ সাল থেকে ৩০ টি স্কাইডাইভিং করেছেন। তিনি বলেন, "আপনি আসলে ইকারাসের মতো উড়ছেন! আপনি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছেন এবং আপনি ভয় পাচ্ছেন না। কল্পনা করুন আপনি একটি স্লাইডে আছেন এবং খেলার মাঠে শিশুদের মতো অবাধে স্লাইড থেকে পড়ে যাচ্ছেন। সেই অনুভূতিটি মনে আছে যখন আপনি নিচে পৌঁছানোর পর আবার সেই স্বাধীনতা অনুভব করার জন্য আবার স্লাইডে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন?"
অনেকেই স্কাইডাইভিংয়ের অনুভূতিকে তুলনা করেন 'শরীরের বাইরের অভিজ্ঞতা' হিসেবে। অন্যরা এটিকে 'উত্তেজনাময়' এবং 'খুবই স্বস্তিদায়ক' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আশিকের কাছে স্কাইডাইভিংয়ের অনুভূতি ধ্যান করার অনুভূতির মত।
তিনি বলেন, "অনেক লোক স্কাইডাইভিংকে খাঁটি 'অ্যাড্রেনালিন' রাশ মনে করে। কিন্তু আমি মনে করি এটি তার থেকেও বেশী। প্রথম কয়েকটি লাফে দিতে আপনি ভয় পাবেন কিন্তু তার পরে বিষয়টা হল আপনার শারীরিক এবং মানসিক শক্তিকে ছাড়িয়ে যাওয়া।"
একবার নিজের ভয়কে ঝেড়ে ফেলতে পারলেই আপনি স্বাধীনতার অনুভূতি পাবেন। আর সেই স্বাধীনতাই এইচএসবিসির এই বিনিয়োগ ব্যাংকারকে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ৪১ হাজার ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়ার কথা ভাবতে বাধ্য করেছে।
আশিকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা যশোরে। তার বাবা বিমান বাহিনীতে ছিলেন। তিনি ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ) পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি লন্ডন বিজনেস স্কুলে চলে যান এবং তার জীবনের বেশিরভাগ সময় যুক্তরাজ্যেই কাজ করেন।
তিনি বলেন, "আমি শুধু ২০১৯ সালে ঢাকায় ফিরে এসেছি কারণ আমি দেশের জন্য অবদান রাখতে চেয়েছিলাম। আমি আক্ষরিক অর্থেই এই দেশে জন্মগ্রহণ করেছি এবং আমার সমস্ত শিক্ষার খরচ এই দেশ জুগিয়েছে। তাই আমি সত্যিকার অর্থে মনে করি, দেশটি আমার উপর অনেক বিনিয়োগ করেছে।
তিনি আরো বলেন, "যদিও আমি সিঙ্গাপুরে কাজের সুবাদে দেশ থেকে চলে এসেছি, বাংলাদেশ আমার কাজের একটি বড় ক্ষেত্র এবং আমি বারবার ফিরে যাচ্ছি। হয়ত কোনো এক সময়ে স্থায়ীভাবে ফিরে আসব।"
আশিক এখন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ৪১ হাজার ফুট উপর থেকে স্কাইডাইভিং করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করতে চান।
আশিক বলেন, "আমি সবসময় মনে করেছি যে আমরা নিজেদের দেশকে খুব একটা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পারছি না। তাই আমার কাছে এটি একটি সুযোগের মত মনে হয়েছে। এবং এটি একটি অনন্য সুযোগ কারণ আমি এখনো কোনো বাংলাদেশি স্কাইডাইভারের খোঁজ পাইনি।"
আশিক চৌধুরী মে মাসে ৪১ হাজার ফুট উঁচুতে উড়ে যাওয়া বিমান থেকে লাফ দেবেন। আশিকের পিঠে থাকবে প্যারাস্যুট আর সাথে থাকবে বাংলাদেশের পতাকা। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস গড়তে তাঁর এই প্রচেষ্টার নাম 'দ্য লারজেস্ট ফ্ল্যাগ ফ্লোন স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার'।
আশিক যতক্ষণ সম্ভব পতাকা নিয়ে ওড়ার চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, "আমি ৪১ হাজার ফুট উঁচু থেকে লাফ দিই। আমি যতটা সম্ভব কম উচ্চতা যেমন ৩ হাজার বা আড়াই হাজার ফুটে এসে প্যারাসুট খুলি। সাধারণত আমি ৪ হাজার বা ৫ হাজার ফুটে প্যারাসুট খুলছি। তাই আমি ৩৯ হাজার বা ৩৮ হাজার ফুট পর্যন্ত উড়াবো।"
সব থেকে উঁচু থেকে লাফ দেওয়ার রেকর্ড গড়া হয়েছে মহাকাশ থেকে থেকে লাফ দিয়ে। ২০১২ সালে ফেলিক্স বামগার্টনার ১ লক্ষ ২৪ হাজার ৮৫২ ফুট উচ্চতা থেকে লাফ দিয়ে এই রেকর্ড করেন। দুই বছর পরে অ্যালান ইউস্টেস ১ লক্ষ ৩৫ হাজার ৮৮৯ ফুট উঁচু থেকে লাফ ফেন। দুজনই হিলিয়াম বেলুন ব্যবহার করেছিলেন।
কিন্তু ৪১ হাজার ফুট যেকোনো বাণিজ্যিক বিমানের জন্য সর্বোচ্চ উচ্চতা। শুধু স্পাই বিমান এবং ফাইটার জেটই এই উচ্চতা অতিক্রম করতে পারে। ৩৬ হাজার ফুট উপরে স্ট্রাটোস্ফিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়।
আশিক বলেন, "স্ট্রাটোস্ফিয়ারে ওড়ানো সবচেয়ে বড় পতাকার রেকর্ড হবে এটি। আমি এটি করার চেষ্টা করছি।"
এটি একটি নতুন রেকর্ড হলেও 'পতাকা সহ সর্বোচ্চ উচ্চতায় স্কাইডাইভিং' নামে একইরকমের আরেকটি রেকর্ড গত বছর জিথিন বিজয়ন অর্জন করেছিলেন। তিনি ৪২ হাজার ৪৩১ ফুট উঁচু থেকে লাফ দিলেও তার পতাকাটি তার হাতের চারপাশে মোড়ানো ছিল এবং ছোট ছিল।
আশিক জানিয়েছেন, তিনি একটি বড় পতাকা নিয়ে লাফ দিয়ে নতুন একটি রেকর্ড করতে চান।
বড় পতাকার জন্য অ্যারোডাইনামিক আরো জটিল হয়ে যাবে আশিকের জন্য। তাকে ১২ হাজার ফুট থেকে শুরু করে ১৫ হাজার ফুট এবং তারপরে ৩০ হাজার ফুট থেকে লাফ দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। সেই সময়ে তাঁকে সম্পূর্ণ কিট পরে এই প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
আশিক সবসময় অ্যাডভেঞ্চারে আগ্রহী ছিল। তিনি বাঞ্জি জাম্পিং (পায়ে দড়ি বেঁধে উচ্চতা থেকে লাফ দেওয়া) করেছেন। তিনি বিমান চালাতে পারেন। তার বাবাই ছিলেন তার অনুপ্রেরণা।
তিনি ২০১২ সালে প্রথম স্কাইডাইভিং করেন।
তিনি বলেন, "আমার এটা খুব ভালোভাবে মনে আছে। প্রথমবার আপনাকে একজনের সাথে লাফ দিতে হয় এবং তিনিই প্যারাস্যুট খুলেন। প্রথমবার আমি যার সাথে লাফ দিয়েছিলাম সে আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল, 'এটা কি তোমার প্রথমবার?'"
আশিক হ্যাঁ বললে তিনি বলেছিলেন, "এটি তোমার জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা।"
আশিক বলেন, "আমার প্রথম চিন্তা ছিল, 'আমি এখানে কি করছি? আমার বড় ভুল হয়েছে!' কিন্তু আপনি যখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন এবং সবাই লাফ দিতে থাকবে তখন আপনি নিজেকে কাপুরুষ মনে করতে থাকবেন। আপনি এটা হতে চাবেন না।"
প্রথম স্কাইডিভিং এরপর দ্বিতীয় স্কাইডাইভিং করতে আশিকের সময় লেগেছিল চাকরির কারণে।
তারপর থেকে তিনি ৩০টির বেশী স্কাইডাইভিং করচেহেন ১২ থেকে ১৪ হাজার ফুটের মধ্যে। যখন কেউ ১৫ হাজার ফুট অতিক্রম করে তখন বাতাস পাতলা হয়ে যায় এবং স্কাইডাইভারের অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়।
এই বছরের মে মাসে যখন আশিক ৪১ হাজার ফুট উঁচু থেকে লাফ দিবেন তখন সেটি তার আগের সব অভিজ্ঞতাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
সেই উচ্চতা থেকে একটি লাফ দেওয়ার পর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে প্রায় সাড়ে তিন মিনিটের ফ্রি ফল হবে আশিকের। বাতাস পাতলা হওয়াতে টার্মিনাল বেগ বেশি হবে এবং পতনের গতি প্রতি ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার বা তার বেশী হতে পারে।
আশিক বলেন, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে প্রায়ই পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া যুক্ত থাকে। তিনি বলেন, অপারেটরের ত্রুটির কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে।