সংসদ ভবন অঞ্চল: ‘আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে…’
এখন হাঁটতে গেলেই ঢাকার প্রায় প্রতিটি রাস্তার পাশে দেখা মেলে কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি। সেখানে ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়ার রক্ত লাল রঙে মুগ্ধ হন না, এমন মানুষ মেলা ভার। পথে যেতে যেতে ক্লান্ত পথিকও একবার থেমে যান। তীব্র রোদ মাথায়ও মিনিটখানেক সময় নিয়ে উপভোগ করেন এই ফুলের সৌন্দর্য।
প্রকৃতি যখন পুড়ছে তাপপ্রবাহে, ঠিক তখনই চারপাশের সবকিছুকে রাঙিয়ে দিতে আগমন কৃষ্ণচূড়ার। রুক্ষতাকে হার মানিয়ে প্রকৃতি যেন হেসে উঠলো নতুন করে। কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙেই ভেসে ওঠে গ্রীষ্মের প্রকৃত সৌন্দর্য। রোদ ঝলমলে দিনে, নীল আকাশের নিচে এই ফুল দিগন্তকে যেন সাজিয়ে তোলে মোহনীয় রূপে।
তাই তো এই প্রখর রোদ উপেক্ষা করে থরে থরে ফুটে থাকা এই ফুলের সৌন্দর্য ফ্রেমবন্দী করার সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ প্রকৃতিপ্রেমীরা। রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকায় সে দৃশ্য দেখার মতই। প্রতিটি কৃষ্ণচূড়া গাছের আশেপাশে মানুষের ভীড়। সবার হাতে হাতেই ফোন এবং ক্যামেরা। সেসব দিয়ে যে যেভাবে পারছেন, ফ্রেমবন্দী করে নিচ্ছেন রক্তবর্ণ এই ফুলের নজরকাড়া সৌন্দর্য। বিকেল হতে হতে এই রূপ দেখতে মানুষের ভিড় বেড়ে হয় দ্বিগুণ।
কেমন যেন সম্মোহনী এক ব্যাপার আছে এই ফুলের রঙে। তাই তো ছেলে-বুড়ো সবাই মেতেছেন প্রকৃতির এই রূপ উপভোগে। মন রাঙিয়ে দিতে এমন আগুন ঝরা কৃষ্ণচূড়ার দেখা মেলে ঢাকার প্রায় প্রতিটি অলি-গলিতে। তবে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় সে সৌন্দর্য অন্য সবকিছুকে যেন ছাপিয়ে যায় নিমিষেই।
পৃথিবীর দৃষ্টিনন্দন এই ভবনের রাস্তাজুড়ে বড় বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছের সারি। সেখানে থোকায় থোকায় টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ার মেলা। মাঝে মাঝে মিষ্টি হলুদ রঙের কনকচূড়ার উঁকিঝুঁকি যেন এই সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে ২০০ একরেরও বেশি জায়গা নিয়ে এর অবস্থান। চারপাশে প্রশস্ত রাস্তা। সেসব রাস্তার দু পাশজুড়ে রঙ বেরঙের ফুল। লাল, হলুদ ফূলে শোভিত হয়ে আছে দুপাশ। রাস্তায় দাঁড়ালেই তাই ভবনের অনুপম সৌন্দর্য আরও বেশি চোখে পড়ে।
বিংশ শতাব্দীর সেরা আর্কিটেক্টদের একজন লুই আই কানের ডিজাইনে তৈরি হয় বাংলাদেশের সংসদ ভবন। এই ভবনটিকে আধুনিক স্থাপত্যের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবেও মানা হয়। ১৯৬৪ সালে স্থপতি লুই আই কানের নকশা অনুযায়ী শুরু হয় ভবন নির্মাণ। প্রায় এক যুগ ধরে চলে সে কাজ। বলা হয়ে থাকে, লুই আই কান যত কাজ করেছেন তার মধ্যে এটা সর্ববৃহৎ।
ভবনটিকে ঘিরে রয়েছে চারটি প্রশস্ত প্রধান সড়ক। উত্তর দিকে লেক রোড; দক্ষিণ দিকে মানিক মিয়া এভিনিউ; পূর্ব দিকে রোকেয়া স্মরণী এবং পশ্চিম দিকে মিরপুর সড়ক। প্রতিটি সড়কের সৌন্দর্যই ভিন্ন ভিন্ন। তবে এরমধ্যে লেক রোডের মোহনীয় রূপ আলাদা করে ধরা দেয় চোখে। প্রতিটি ঋতুর রূপ আলাদা করে ফুটে উঠে এই সড়কে। রাস্তার দুপাশে অসংখ্য গাছে বর্ণিল সব ফুলের সমাহার দেখতে পাওয়া যায় সেখানে।
রক্তের মত লাল টকটকে বলে কেউ কেউ এটিকে রক্তচূড়াও বলে থাকেন। এর উৎপত্তি কিন্তু এই দেশে নয়। অনেকেই ভেবে থাকেন কৃষ্ণচূড়া হয়তো এই উপমহাদেশেরই ফুল। আমাদের দেশে পথের ধারে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, বনে-জঙ্গলে— সবখানেই এই ফুলের আধিক্য থাকলেও এর আদি নিবাস সুদূর আফ্রিকা মহাদেশের মাদাগাস্কার। সেখানকার শুষ্ক পত্রঝরা বৃক্ষের জঙ্গলেই এর দেখা মেলে।
১৮২৪ সালের কথা। মাদাগাস্কার থেকে মরিশাসেই প্রথম আনা হয় এই ফুল। পরে সেখান থেকে ইংল্যান্ড এবং অবশেষে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার ঘটে। এভাবে করে এই ফুল জন্মাতে শুরু করে ভারতবর্ষ, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন, ক্যারাবিয়ান অঞ্চল, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কালক্রমে বাংলাদেশও যুক্ত হয় সে তালিকায়।
কৃষ্ণচূড়া ছাড়াও এই ফুলের আছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। ডেলোনিক্স শব্দটি গ্রিক শব্দ। যার অর্থ দাঁড়ায়- 'দৃশ্যমান থাবার মতো'। আবার ইংরেজিতে বেশ কয়েকটি নাম লক্ষণীয়। যেমন— ফ্লেম ট্রি, রয়্যাল পৈন্সিয়ানা, ফ্ল্যাম্বোয়ান্ট এবং পিকক ফালুয়ার নামেও এটি পরিচিত। অন্যদিকে, হিন্দিতে এই নাম একেবারে ভিন্ন। এই ভাষায় কৃষ্ণচূড়াকে বলা হয় গুলমোহর নামে।
তবে এই ফুলের বাংলা নামকরণ নিয়েও আছে বেশ মজার কল্পকাহিনী। কীভাবে এই ফুলের নাম কৃষ্ণচূড়া হলো, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. মোহাম্মদ আমীন তার 'পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রমবিবর্তন' গ্রন্থে লিখেছেন, 'রাতে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো কৃষ্ণগহ্বরের মতো নিকষ হয়ে ওঠে। এ নিকষ কৃষ্ণই দিনের বেলা গাছের চূড়োয় রঙিন স্বপ্নে জ্যৈষ্ঠ মাসের অসহ্য গরমেও দু'দণ্ড শান্তির বার্তা বয়ে আনে। তাই ফুলটির রাখা হয়েছে কৃষ্ণচূড়া।'
অবশ্য আরেক লেখক, আমিরুল আলম খান, তার 'পারুলের সন্ধানে' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন অন্য গল্প। ১৭ শতকের দিকে এক রাজকবি নাকি দেবতা কৃষ্ণের মাথার চূড়ার বর্ণনা করতে গিয়ে রক্তবর্ণ ফুলের সঙ্গে একে তুলনা করেছিলেন। তারপর সেখান থেকে কোনো কাব্যরসিক হয়তো কৃষ্ণচূড়া নামটি রেখে দেন। পরবর্তীতে সে নামটিই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে মনোমুগ্ধকর, দৃষ্টিনন্দন এই ফুল গাছের কিছু কুফলও আছে বটে। কেউ কেউ এই গাছ পরিবেশবান্ধব নয় এমন কথাও উল্লেখ করেন। প্রকৃত অর্থেই এই গাছ পরিবেশের জন্য কতটা অপকারী– তা জানতে চাইলে উদ্ভিদ বিষয়ক গবেষক মোকাররম হোসেন বলেন, "কৃষ্ণচূড়া একটি অর্নামেল্টার ফুলের গাছ। এই গাছের ক্ষতিকর দিক হলো– এর গোড়া, ডালপালা সব কিছু অনেক নরম। ভেঙে পড়ে। এইজন্য আমরা সাজেস্ট করি রাস্তার দুইপাশে যেখানে মানুষ বা যানবাহন চলাচল করে সেখানে যাতে না লাগানো হয়।"
"একটি নির্দিষ্ট বয়সের (৩০ বছর) পর এই গাছের ডালপালা, গোড়া নরম হয়ে যায়। শিকড়ের ভেতর দিয়ে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। তখন কেটে ফেলাই শ্রেয়। যদি একান্ত লাগানো হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে নজরদারি প্রয়োজন," যোগ করেন তিনি।
তবে যাই হোক না কেন, এই ফুলের মন ভোলানো সৌন্দর্য্যে সাধারণ মানুষ উপেক্ষা করে যায় গ্রীষ্মের দাবদাহকেও। কাঠফাটা রোদের উতপ্ত বাতাসে দুলতে থাকা রক্তিম কৃষ্ণচূড়া যেন তাই এক পশলা বৃষ্টির মত স্বস্তি এনে দেয় মানবজীবনে।