রাসেলস ভাইপার কি আবার ফিরে এসেছে!
ফরিদপুর। চরভদ্রাসনের মুন্সীরগঞ্জ বাজারের পাশে আস্তানা গেড়েছে বেদের বহর। বাঁশের ফালি বাঁকিয়ে তাতে পলিথিন ঝুলিয়ে চন্দ্রাকৃতি তাঁবু বানিয়ে তাতে বেশ কিছুদিন ধরে বসবাস করে আসছে কয়েকটি পরিবার।
১১ জুলাই ২০২৩। গভীর রাত। প্রবল বৃষ্টি। বহরের প্রতিটি তাঁবুতে প্রত্যেকটি পরিবার তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু ঘুম নেই নজরুলের চোখে। বেদের ছেলে সে, কিন্তু ভালোবেসে বিয়ে করেছিল এক গৃহস্থের কন্যাকে। কিন্তু কয়েক বছর সংসার করেও কৃষককন্যার মন টেকেনি বেদের ঘরে। অন্য যুবকের হাত ধরে চলে যায় সে, শুরু করে নতুন সংসার। নজরুলের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এমনিতেও সে জাতিতে যাযাবর, কিন্তু ভালোবাসার মানুষটি পরের হাত ধরে চলে যাওয়ার পর তার মনটাও যাযাবর হয়ে যায়। আর বিয়ে করেনি সে। যাযাবরের চাইতেও বড় যাযাবর হয়েছে, ঘুরে বেড়ায় এক বহর থেকে অন্য বহরে। কোনো রাতেই ঘুম তার সঙ্গী হয় না, তাই আজও এই তুমুল বৃষ্টির রাতে জেগে আছে বিরহী নজরুল।
বরাবরের মতো একটু বেলা করে ঘুম ভাঙ্গে নজরুলের। আঁচড়া আর ছাঁকুনি নিয়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে সে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে জলের নিচে হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণের অলংকার কিংবা মূল্যবান জিনিস খুঁজে বের করাই তার কাজ। বাঁশের হাতল লাগানো লোহার আঁচড়া আর বাঁশের তৈরি ছাঁকনির মাধ্যমে সে জলের নিচের হারানো জিনিস খুঁজে বের করে। এতে হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়ার আনন্দে লোকজন খুশি হয়ে তার হাতে পারিশ্রমিক তুলে দেয়। মানুষের হারানো জিনিস খুঁজে বের করতে নজরুলের ভালোই লাগে। এটা বেদেদের আদি পেশা। অন্য অনেকে তা ছেড়ে দিলেও নজরুল ধরে রেখেছে। কারণ, হারানোর বেদনা তার চেয়ে বেশি আর কে বোঝে ?
বহর থেকে বেরিয়ে মুন্সীরগঞ্জ বাজারে এসে এক হোটেল থেকে নাস্তা সেরে নেয় নজরুল। তারপর অটোরিক্সায় উঠে রওনা দেয় চরাঞ্চলের হাজীগঞ্জ গ্রামের উদ্দেশে। আজ ওদিকেই তার যাওয়ার কথা। এরপর একসময় অটোরিক্সা থেকে নেমে যায় হাজীগঞ্জ বাজারের পাশে। আঁচড়ার বাঁশের হাতলের মাথায় ত্রিকোণাকৃতির ছাঁকনিটা ঝুলিয়ে গ্রামের দিকে হাঁটা শুরু করে সে। এ অবস্থায়, মূল্যবান জিনিস খোয়া গেছে এমন লোকজন, কিংবা তাদের পরিচিত কেউ, তাকে দেখলেই ডেকে নেবে।
গ্রামীণ পথ ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় একবার লোকজন তাকে দেখে ডেকে ওঠে। নজরুল তখন মনে মনে বেশ খুশি, যাক দিনের প্রথম কাজ পাওয়া গেল। কিন্তু তাদের কাছে গিয়ে জানতে পায় ভিন্ন ঘটনা। পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে চায়না দুয়ারী জাল পেতেছিল একজন, তাতে আটকা পড়েছে অদ্ভুত এক সাপ। লোকজন জানে হারানো জিনিস যারা খুঁজে বেড়ায় তারা বেদে সম্প্রদায়ের লোক। তাই নজরুলকে দেখে ওরা ডেকে নিয়ে আসে সাপটাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। লোকজন আরও বলাবলি করছিল,"সাপটা ভয়ংকর, ভীষণ হিস হিস শব্দ করছে।"
জাত সাপের খবরে নজরুলের শরীরের রক্ত ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বেদের ছেলে সে, বলতে গেলে বেড়ে উঠেছে সাপের সঙ্গে। পেশা যা-ই হোক সাপ ধরা আর সাপ নিয়ে খেলা দেখানোর বিষয়টা ওদেরকে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা দেয়া হয়।
নজরুল তখন লোকজনের সঙ্গে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দিল। মনে মনে বেশ খুশি সে, যদি বড় আকারের জাত সাপ (বিষধর) হয় তবে বিক্রি করে বেশ টাকা পাওয়া যাবে। যদিও প্রচলিত বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন অনুযায়ী সাপ বেচাকেনা দণ্ডনীয় অপরাধ, তবু নিজেদের মধ্যেই বেচাকেনা এখনো হরদম চলে।
লোকজন তাকে চায়না দুয়ারী জাল (আসলে এক বিশেষ ধরনের ফাঁদ) পেতে রাখা সেই জলাশয়ের কাছে নিয়ে যায়। ওটা আসলে একটা খাল। নজরুল খালে নেমে ফাঁদের কাছে গিয়ে উঁকি দেয়, ফাঁদের নিচে জলের উপর বসে থাকা সাপটাকে দেখে খুশিতে ভরে ওঠে তার মন। বাহারি রং আর নকশাকাটা নুদুসনুদুস দেহ, ত্রিকোণাকৃতি মাথা। এ যে অজগরের বাচ্চা। তবে জাত সাপ না হলেও ভালো দামেই বিক্রি করা যাবে। দেরি না করে সে সাপটাকে ধরে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ফেলে। তারপর রওনা দেয় হাজীগঞ্জ বাজারের উদ্দেশে, সেখানে পৌঁছে সোজা চলে যাবে বহরে, তারপরই হাতে আসবে কচকচে নোট। কিন্তু লোকজন তার পিছু ছাড়ছে না। সবাই বারবার সাপ দেখতে চাইছে। পথের মধ্যে এক জায়গায় সাপটাকে দেখাল সে। তারপর সেটাকে আবার ব্যাগে ভরে রাখার পর এক লোক বৃদ্ধ মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে এসে বলল, "ভাই আমার মায়ের খুব ইচ্ছা, সাপটার একটু দেখান।"
নজরুল অনিচ্ছাসত্ত্বেও সাপটাকে বের করে ওই মহিলাকে দেখিয়ে ব্যাগে ভরে রাখার সময় সাপটি হঠাৎ ছোবল হানে তার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে। সমবেত লোকজন হায় হায় করে ওঠে। সবাই তাকে ছোবলের স্থানের উপরে রশি দিয়ে বাঁধতে বলে। নজরুল মনে মনে হাসে, এটা তো অজগরের বাচ্চা, বিষ নেই, শত কামড়ালেও কিছু হবে না। তাই সে সাপটাকে দ্রুত ব্যাগে ভরে হাজীগঞ্জ বাজারে এসে মুন্সিরগঞ্জগামী অটোতে উঠে পড়ে। ছোবলের সাথে সাথেই ব্যথা শুরু হয়েছিল, নজরুল পাত্তা দেয়নি। কিন্তু অটোতে ওঠার পর সেই ব্যথা মহাতীব্র আকার ধারণ করে। বুড়ো আঙ্গুল থেকে ডান হাত দিয়ে ব্যথা যেন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে। নজরুলের মনে ধাক্কা লাগে, অজগরের বাচ্চা কামড়ালে তো এত ব্যথা হওয়ার কথা নয়? ভীষণ অস্থিরতা শুরু হয় মনে, চোখের সামনের পৃথিবীটা ক্রমেই যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। সেই অবস্থায় সাপভর্তি ব্যাগ নিয়ে অটো থেকে নেমে কোনোমতে বহরে পৌঁছায় সে।
বহরের প্রবীণ ব্যক্তিরা ব্যাগ খুলে সাপ দেখে চমকে উঠে বলে, "সর্বনাশ! এ তো অজগররে বাচ্চা নয়, ভয়ানক বিষধর সাপ।" কয়েকজন ওঝা তখনই তৎপর হয়ে ওঠে নজরুলের বিষ নামাতে। এভাবে ঘণ্টাখানেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর নজরুলের মুখ দিয়ে রক্ত চলে আসে। আর তখনই টনক নড়ে ওঝাদের। ওরা বুঝে নেয় এসবে কাজ হবে না, রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু এর জন্য যে বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন। সে টাকা সংগ্রহের জন্য আরো কিছু মূল্যবান সময় নষ্ট হয় সেখানে। ততক্ষণে নজরুলের প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত আসতে শুরু করে।
ছোবল-আক্রান্ত হওয়ার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর সাপুড়ে নজরুল ইসলামকে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ধৃত সাপটিকে সঙ্গে করে আনা হয় সেখানে। হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম না থাকায় বাইরে থেকে দুই ডোজ (এক ডোজ=দশ ভায়েল) কিনে আনেন নজরুলের আত্মীয়রা। প্রতি ডোজ এভি-এস ওদের কিনতে হয়েছে ১৬ হাজার টাকা করে। একটি জেলা পর্যায়ে হাসপাতালে এভি-এস না থাকাটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। সেই সময়টাতে টাকা জোগাতে বহরের মহিলারা নিজেদের গায়ের গয়না বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল।
নজরুলের পায়খানা, প্রস্রাব এবং আর বমির সঙ্গে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তখন। অতঃপর তার দেহে দুই ডোজ অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হয়। রক্ত জমে নজরুলের চোখ দুটো তখন টকটকে লাল। কিছু সময় পর তার কিডনি বিকল হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়, পেট ফুলে যায়, ফুসফুসে পানি জমতে শুরু করে। অবস্থার অবনতি হলে ১২ জুলাই নজরুল ইসলামকে ফরিদপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে প্রথমে তাকে মেডিসিন ওয়ার্ডের আইসিউতে ভর্তি করা হয়। সেই মুহূর্তে তার কিডনিসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অকার্যকর হতে শুরু করে। পরে কিডনি ডায়ালাইসিসের সুবিধার্থে তাকে মূল আইসিউতে স্থানান্তর করা হয়।
১৯ জুলাই দুপুরে নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়। তাকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করা হচ্ছিল। বিগত আট দিনে তার শরীরে দশ ব্যাগের অধিক বি পজিটিভ গ্রুপের রক্ত প্রবেশ করানো হয়েছিল। দেহের বিভিন্ন অংশ দিয়ে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ, কিডনি জটিলতাসহ অন্যান্য কারণে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ৩৫ বছর বয়সি বেদে যুবক।
আসলে এই সাপের হেমোটক্সিনসমৃদ্ধ বিষ নজরুলের শরীরের সমস্ত রক্ত নষ্ট করে দিয়েছিল। গোখরা (Cobra) কিংবা কেউটের (Krait) ছোবলে যেখানে জীবন-মৃত্যু নির্ধারিত হয়ে থাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, সেখানে এই সাপের কামড়ে আক্রান্ত রোগী দুসপ্তাহ পরও মারা যেতে দেখা গেছে। হেমোটক্সিনের তীব্র প্রভাবে ছোবলের স্থানের আশপাশে ফোসকা পড়ে এবং মাংস পচে যায়। এতে করে সুস্থ হওয়ার পরও অনেকের অঙ্গহানি ঘটতে দেখা যায়। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরার পরও দীর্ঘ সময় নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগতে হয়। এভাবে দীর্ঘ রোগভোগের পরেও অনেকের মৃত্যু ঘটেছে।
সর্প দংশনে আক্রান্ত রোগীকে যত দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা যায় ততই মঙ্গল। সাপুড়ে নজরুল ইসলামকে ভর্তি করা হয়েছিল ছোবলের সাড়ে তিন ঘণ্টা পর। রক্তবিনাশী হেমাটক্সিন ততক্ষণে তার দেহে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছোবলের অন্তত ১০০ মিনিটের মধ্যে নজরুল ইসলামকে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলে হয়তো তিনি বেঁচে যেতেন। তবে আরেকটি কথা, এই সাপের নির্দিষ্ট কোনো AVS, অর্থাৎ এককভাবে এর বিষ বিনষ্টকারী 'মনোভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম' দেশে নেই। বাংলাদেশে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় ভারত থেকে আমদানিকৃত পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যা গোখরা (CObra), কেউটে (Krait) এবং চন্দ্রবোড়া (Russell's Viper) এই তিন সাপের বিষ প্রতিরোধে কাজ করে থাকে। তবে এই পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনমের বদৌলতে এ পর্যন্ত দেশে বহু মানুষের প্রাণরক্ষা হয়েছে, এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য। তবে আসল কথা হচ্ছে, রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো। তা না হলে পলিভ্যালেন্ট কিংবা মনোভ্যালেন্ট কোনোটাতেই কোনো কাজ হবে না। বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া সাপের বিষ প্রতিরোধে শতভাগ কার্যকর অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ চলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে। এটা তৈরির প্রাথমিক ধাপের কাজ শেষ হয়েছে। গবেষকরা পুরোপুরি সফল হলে এটি হবে দেশে তৈরি প্রথম অ্যান্টিভেনম সিরাম। নিঃসন্দেহে এ এক বিশেষ সুসংবাদ।
'সাপের ছোবলে সাপুড়ের মৃত্যু।' 'দেশে নতুন আতঙ্কের নাম রাসেল'স ভাইপার।' 'ভারত থেকে আসা বিষধর রাসেল'স ভাইপার ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।'—সাপুড়ে নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর সামাজিক এবং জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর এ ধরনের শিরোনামে দেশজুড়ে রীতিমতো রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক নেমে আসে। কারণ বিগত সময়গুলোতে পদ্মা এবং এর শাখা নদীসমূহের তীরবর্তী জেলাগুলোতে এই সাপের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলায় আক্রান্ত হতে থাকে মানুষ। গড়াই আর আত্রাই নদীপারের মানুষের ঘুম হারাম হবার অবস্থা ভয়ানক এই সাপের দুশ্চিন্তায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রাসেলস ভাইপার কি ভিনদেশি সাপ?
এবার তার মূল পরিচয়ে আসা যাক। বিখ্যাত স্কটিশ হার্পেন্টোলজিস্ট প্যাট্রিক রাসেলের নামানুসারে এর ইংরেজি নামকরণ করা হয়েছে 'Russell's Viper', বৈজ্ঞানিক নাম Daboia Russelii, বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া নামে পরিচিত। শরীরের বিভিন্ন স্থানে চন্দ্রাকৃতি ছোপ ছোপ গোল দাগের জন্য এ ধরনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। এই ফোটাগুলো আবার দেখতে পিঠের দিক দিয়ে শেকলের মতো, একটির সঙ্গে আরেকটি জুড়ে আছে। তাই অনেকে আবার এদের ডাকে চেইন ভাইপার বা শেকলবোড়া নামে। পরিত্যক্ত উইঢিবি ওদের বসবাসের খুবই পছন্দের জায়গা, এজন্য উলুবোড়া নামেও এদের কেউ কেউ ডাকে। ভাইপারিডি পরিবারভুক্ত এই সাপ দীর্ঘ বিষদাঁতের অধিকারী, বিশ্বে যার স্থান দ্বিতীয়। যা দিয়ে সে শত্রু কিংবা শিকারের দেহের গভীরে বিষ ঢেলে দিতে সক্ষম হয়। সাপের জগতে হিংস্রতা আর আক্রমণের ক্ষিপ্রতায় অন্যতম তার স্থান। আক্রমণের গতি এতটাই তীব্র যে এক সেকেন্ডের ১৬ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে ছোবলকার্যটি সম্পন্ন করতে পারে সে। তীব্রগতিতে স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে ওঠা, শত্রুকে আক্রমণকারী এই সাপ কিলিং মেশিন নামেও পরিচিত।
চন্দ্রবোড়া; এ যেন এক জান্তব প্রহেলিকা, চোখের সামনে বিষময় মৃত্যুদুতকে দেখেও মানুষের কাছে মনে হয় নির্বিষ অজগরের বাচ্চা। কারণ চন্দ্রবোড়ার সঙ্গে অজগরের গায়ের রঙের অদ্ভুত মিল রয়েছে। যা মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। ঘটে নির্মম দুর্ঘটনা।
একটি পূর্ণবয়স্ক চন্দ্রবোড়া দৈর্ঘে সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা হয়। তবে ২০১৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মানুষের হাতে মারা পড়া চন্দ্রবোড়াটি আট ফুট লম্বা ছিল, যা এখনও বিশ্বরেকর্ড হিসেবে গণ্য হয়। এই সাপ জঙ্গলের চাইতে কৃষিজমি কিংবা ঘাস বনে থাকতে ভালোবাসে। ওরা ওত পেতে বসে থাকে শিকারের আশায়। শিকার আয়ত্তের মধ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে ছোবল দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। শিকার কিছুদূর গিয়ে বিষক্রিয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করে। সে তখন গন্ধ শুঁকে শিকারের দেহ খুঁজে বের করে ভক্ষণে লিপ্ত হয়। এদের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য হচ্ছে ইঁদুর। মাঝেমধ্যে ছোবল খাওয়া ইঁদুর নিজের গর্তে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে। আর চন্দ্রবোড়া তখন সেখানে উপস্থিত হয়ে অন্যান্য সব ইঁদুরদেরও একে একে খেয়ে ফেলে। এদের মানব বসতির কাছাকাছি চলে আসার একটি বড় কারণ হচ্ছে ইঁদুর।
চন্দ্রবোড়া নামে বাংলা সাহিত্যে গল্প এবং নাটিকা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভয়ের রূপক হিসেবে এই নামটি ব্যবহার করা হয়েছে। চন্দ্রবোড়া বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। কেউ কেউ বলে থাকেন, এরা হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের আদিবাসী। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটির রং এবং চন্দ্রবোড়ার গায়ের রং প্রায় একই রকম। তাই সহজে ওরা সেখানে মানুষের চোখ এড়িয়ে থাকতে পারে। আবার একইভাবে মানুষ নিজের অজান্তে একেবারে ওদের ছোবলের নাগালে গিয়ে পড়ে। তবে এরা শুধুই বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ নয়।
এই বিচিত্র সাপের আরেক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা অন্য সাপের মতো ডিম দেয় না। সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে থাকে। সদ্য প্রসূত বাচ্চারা ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। অল্পবয়সি চন্দ্রবোড়া সাপের মধ্যে স্বজাতি ভক্ষণের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। অর্থাৎ মাঝেমধ্যে ওরা নিজেদের ভাইবোনকেও খেয়ে ফেলে। বাচ্চা প্রদানের ক্ষেত্রেও চন্দ্রবোড়া অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। দেশের অন্যান্য সাপ যে পরিমাণ ডিম দিয়ে থাকে অথবা বাচ্চা দেয়, চন্দ্রবোড়া তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি বাচ্চা দিয়ে থাকে। এরা সর্বোচ্চ আশিটি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করে থাকে। এরা বছরের শুরুতে জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে মিলনে লিপ্ত হয়ে থাকে। এ সময় পুরুষ সাপটি নানাভাবে চেষ্টা করে সঙ্গিনীর মন জয় করার জন্য। দীর্ঘ সময় ধরে চলে তাদের পূর্বরাগের পালা। এরপর পরস্পরের দেহ পেঁচিয়ে মিলনে লিপ্ত হয়। স্ত্রী সাপ ছয় মাস গর্ভধারণের পর বাচ্চা পৃথিবীতে আসে। কিন্তু চিড়িয়াখানায় কিংবা বন্দি অবস্থায় এদের গর্ভকাল হয়ে থাকে তিন মাসের কিছু উপরে।
১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত প্রথিতযশা জীববিজ্ঞানী এবং সর্প বিশেষজ্ঞ ড. মো: আলী রেজা খানের 'বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী' বইয়ে দেশের বেশ কিছু স্থানে চন্দ্রবোড়া সাপের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, 'উত্তরবঙ্গে দেশের অন্য এলাকা থেকে বেশি পাওয়া যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে বেশ কটা চন্দ্রবোড়া ধরা হয়েছে। মারা পড়েছে অনেক। দক্ষিণবঙ্গের কুষ্টিয়া, যশোর এবং খুলনাতেও বেশ পাওয়া যায়। কেবল ঢাকা বিভাগের যমুনার পূর্বদিকে এদের সন্ধান পেয়েছি।' কিন্তু কথা হচ্ছে পরবর্তীতে দেশের প্রকৃতি থেকে চন্দ্রবোড়া আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে শুরু করে। একটা সময় এসে অনেকের মনে ধারণা হয়, এই সাপ বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একসময় সুন্দরবনের কিছু অংশ, মধুপুরের শালবন এবং দেশের অন্যান্য কিছু স্থানে এদের উপস্থিতি ছিল। দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৯ সালে দেশের প্রকৃতিতে আবার এদের দেখা মেলে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনাম রিচার্জ সেন্টারের প্রশিক্ষক বোরহান বিশ্বাস। সাপ অন্তঃপ্রাণ এক মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ পর্যন্ত ২৫ হাজারেরও অধিক সাপ উদ্ধার করেছেন। চন্দ্রবোড়া সম্পর্কে তার যেমন সম্যক জ্ঞান রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানাবিধ অভিজ্ঞতা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে জানান, "২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চন্দ্রবোড়ার দেখা পাই রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার জৈটা বটতলায় এবং মার্চ মাসে দেখা মিলে একই উপজেলার ঋষিকুলে। এরপর একই বছরের এপ্রিলের শেষে রাজশাহীর তানোড়ে চন্দ্রবোড়ার দেখা পাই। এই সাপটি একজনকে দংশন করেছিল।" তিনি আরো জানান, দীর্ঘ সময় ধরে চন্দ্রবোড়ার দংশনে মানুষ আক্রান্ত হলেও, হাসপাতালে রোগীর রেকর্ড হয় আরও কয়েক বছর পর। ২০১১ সাল পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চন্দ্রবোড়া দংশিত রোগী এলে অ্যান্টিভ্যানমের অভাবে চিকিৎসা দেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।
সাপটির পুনর্জাগরণের পর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এর ছোবল আর মানুষের মৃত্যুর ঘটনা। বিভিন্ন স্থানে বৃদ্ধি পেতে থাকে এদের সংখ্যা। অনেকে তখন ধারণা করেন বর্ষার বন্যায় কিংবা পদ্মা নদীর জলে ভেসে ভারত থেকে এসব সাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ইতিপূর্বে চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলেও বর্তমান সময়ে দেশের ঠিক কতগুলো জেলায় এদের অস্তিত্ব রয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর পাবনা, শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, বাজিতপুর থেকে শুরু করে ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভারেও চন্দ্রবোড়ার দংশনের ঘটনা ঘটেছে। প্রায়শই নতুন জায়গা থেকে এদের আগমনের সংবাদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ নদীবাহিত পথ ধরে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলেছে এদের যাত্রা। এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে এদের ছোবলে।
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন, হারিয়ে যাওয়া চন্দ্রবোড়া কী করে আবার ফিরে এল প্রকৃতির কোলে। তা-ও আবার এতটা সাড়ম্বরে; দেশের প্রকৃতি এখন যেখানে অনেকটাই বন্যপ্রাণী এবং সাপশূন্য। যুগের পর যুগ মানুষ বন্যপ্রাণীদের নিছক উৎপীড়ন মনে করেছে, আর সব দেখার সঙ্গে সঙ্গে শত শত মানুষ জড় হয়েছে তাকে পিটিয়ে মেরেছে। এই অবস্থায় এক বিশেষ সাপের উত্থান। কারণ কী? অতীতের চন্দ্রবোড়া আসলে কখনোই হারিয়ে যায়নি। লোকচক্ষুর অন্তরালে আত্মগোপনে ছিল। বসবাসের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় আবার ওরা স্বাভাবিক সংখ্যায় ফিরে আসছে।
কৃষিজমিগুলোতে এখন সারা বছরই উন্নত জাতের বিভিন্ন ফসলের আবাদ হয়। যেখানে ফসল খেত সেখানেই ইঁদুর থাকে। অনেকে ধারণা করে থাকেন, যেদিন থেকে দেশে ইরি ধানের চাষ শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই চন্দ্রবোড়ার বৃদ্ধির সূত্রপাত। খাদ্য পানীয় এবং আবাসস্থলের সুবিধা এদের বংশবৃদ্ধিকে সহজ করে দেয়।
বর্তমানে দেশের প্রকৃতির খাদ্যশৃঙ্খল একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এই কারণেও চন্দ্রবোড়ার উত্থান ঘটতে পারে। কারণ খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়লে হঠাৎ যেকোনো প্রাণীর মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। বনবিড়াল, খেঁকশিয়াল, দাঁড়াশ, গোখরাসহ দিবাচর এবং নিশাচর কিছু শিকারি পাখি মেঠো ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করত। মানুষের নির্মমতায় একে একে প্রকৃতির কোল থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে ওরা। যেখানে দেখেছে সেখানেই পিটিয়ে কিংবা গুলি করে মেরেছে। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে ইঁদুরের সংখ্যা। পর্যাপ্ত খাদ্য থাকায় স্বাভাবিকভাবেই চন্দ্রবোড়ার জীবন সাবলীল হয়ে ওঠে। আগেই বলেছি, সাধারণ সাপের তুলনায় এরা কয়েকগুণ বাচ্চা দিয়ে থাকে। আগে বাচ্চাগুলোর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করত স্বয়ং প্রকৃতি। গুইসাপ, বেজি, তিলা নাগ ঈগল, কালকেউটে, শঙ্খিনী আর হুতুম প্যাঁচার প্রিয় খাদ্য ছিল চন্দ্রবোড়ার বাচ্চা। কিন্তু ওদের জীবন যে আজ বড়ই বিপন্ন। তাই এখন চন্দ্রবোড়ার প্রায় প্রতিটি বাচ্চা অনেকটা নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠছে। দিন দিন বাড়ছে ওদের সংখ্যা।
দেশের মানুষ বরাবরই বন্যপ্রাণীদের নিছক উপদ্রব মনে করে আসছে। কোথাও ঠান্ডা মাথায়, কোথাও দলবেঁধে মহা উল্লাসে ওদের হত্যা করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এই অবস্থা চলার ফলে প্রকৃতি এখন প্রায় বন্যপ্রাণীশূন্য। এ অবস্থায় হঠাৎ কোনো প্রাণীর উত্থান, বৃদ্ধি, কিংবা উপদ্রব যাই বলি না কেন এ হচ্ছে আসলে প্রকৃতির এক ধরনের প্রতিশোধ। বন্যপ্রাণী হত্যা করে মানুষ নিজেই নিজের বিপদ ডেকে এনেছে।
শেষ কথা হচ্ছে, এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ চন্দ্রবোড়া সাপ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। আর কোনো মানুষের যেন মৃত্যু না হয় চন্দ্রবোড়ার ছোবলে, আর কোনো চন্দ্রবোড়া যেন নিহত না হয় মানুষের আক্রমণে। মানুষ এবং সাপের সহাবস্থান কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে কাজ করতে হবে। আর এজন্য বন বিভাগ, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, সর্প বিশারদ, সাপ উদ্ধার কর্মীসহ সকল সচেতন নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ বাঁচুক, চন্দ্রবোড়াও বেঁচে থাক; পৃথিবীটা সকলের।