বাংলাদেশের ডলফিন আর হাঙরের জন্য এক সুইস সামুদ্রিক সংরক্ষণবিদের ভালোবাসা
এলিজাবেথ ফাহরানী মনসুর ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বসবাস করছেন। এই দুই দশকে, তিনি ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডাব্লুসিএস) বাংলাদেশের সাথে যুক্ত ছিলেন। সংস্থাটি সাগরের ডলফিন, তিমি, হাঙর এবং শংকর মাছের মতো সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে।
সুন্দরবনে স্বাদুপানির ডলফিনের জন্য তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য স্থাপনে সহায়তা এবং সোয়াচ-অফ-গ্রাউন্ড সাবমেরিন ক্যানিয়নে বাংলাদেশের প্রথম সামুদ্রিক সুরক্ষিত অঞ্চল (এমপিএ) তৈরি করেছেন তিনি। এছাড়া, সামুদ্রিক বন্যজীবন রক্ষা এবং টেকসই মাছ ধরার জন্য আরও দুটি এমপিএ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এলিজাবেথ আইইউসিএন এসএসসি শার্ক স্পেশালিস্ট গ্রুপের (এসএসজি) ভারত মহাসাগরের আঞ্চলিক ভাইস চেয়ারের দায়িত্বেও আছেন।
এলিজাবেথের মতো তার স্বামীও কাজ করেন বন্যপ্রাণী নিয়ে। রুবাইয়াত মনসুর মোগলি, একজন সুপরিচিত বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফার, গবেষক এবং সংরক্ষণবাদী। সুন্দরবন এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক অঞ্চলে তিমি, ডলফিন এবং পরপয়েজ নিয়ে গবেষণায় তিনিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তাদের প্রতিষ্ঠান 'মোগলিজ প্রোডাকশন'-এর মাধ্যমে 'সুন্দরবন- অ্যা বেসিক ফিল্ড গাইড', 'লিভিং উইথ টাইডস অ্যান্ড টাইগার্স- দ্য সুন্দরবনস ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট' এবং 'দ্য মোয়ালিস অব দ্য সুন্দরবন' নামে তিনটি বই প্রকাশ করেন তারা।
স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে খুলনায় থাকেন এলিজাবেথ। সম্প্রতি ঢাকায় তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তার জীবন এবং বছরের পর বছর ধরে সংরক্ষণবাদী, প্রকৃতি গাইড, বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী এবং শিক্ষক হিসেবে তিনি যে অসংখ্য ভূমিকা পালন করেছেন সে সম্পর্কে আমরা দীর্ঘ আলাপ করেছি।
তিনি নিজেকে পরিবেশ শিক্ষার প্রতি অনুরাগী একজন অভিযাত্রী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এলিজাবেথ সম্প্রতি ডব্লিউসিএস বাংলাদেশের মেরিন কনজারভেশন প্রোগ্রামের সিনিয়র ম্যানেজারের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং এখন তার দক্ষতা এবং আগ্রহের আরও বিকাশের জন্য নতুন সুযোগের সন্ধান করছেন।
এলিজাবেথের সাথে আমরা সুন্দরবন এবং মানুষ ও বন্যপ্রাণী উভয়ের টেকসই ভবিষ্যতের জন্য প্রকৃতিকে সম্মান ও সুরক্ষা কেন গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়েও কথা বলেছি।
১৫ মাস ধরে সুন্দরবনে বাস
২০১৯ সালে সুন্দরবনে দীর্ঘ সময় কাটানোর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন এই দম্পতি। সুন্দরবনের আনাচে কানাচে চষে বেড়ানোর জন্য চার সদস্যের পরিবারের সবাই স্কুল এবং কর্মক্ষেত্র থেকে এক বছরের ছুটি নেন।
তারা একটি গোলপাতা (নিপা তালগাছ বা কাণ্ডবিহীন তালগাছ, একটি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতি) গাছের বজরায় ১৫ মাস কাটান যেটিকে তারা পরে হাউজবোটে রূপান্তরিত করেছিলেন।
এলিজাবেথ বলেন, 'এটা সত্যিই আমাদের সবার জন্য একটি অসাধারণ বছর ছিল। এই অনন্য অভিজ্ঞতা আমাদের গহিন বন, কাদামাটি এবং সেখানকার মানুষের সাথে গভীরভাবে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ তৈরি করে দেয়'।
'সুন্দরবনের যে ব্যাপারটা আমার সবচেয়ে ভালোলাগে তা হলো— এখনো আমাদের অনেক কিছু জানার আছে, অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বাকি আছে। আপনি একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেও আরও পাঁচটি প্রশ্ন আপনার সামনে চলে আসবে। ক্রমাগত আপনাকে ব্যাখ্যা ও এর মানে খুঁজে বেড়াতে হবে', বলেন এলিজাবেথ।
এলিজাবেথের মতে, বন-জঙ্গল প্রকৃতির স্বাভাবিক ও আসল রূপের প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি বলেন, 'এটি কাদাময়, লবণাক্ত এবং অতিথিপরায়ণ। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এবং অনেক ধরনের শিকারি বন্যপ্রাণী রয়েছে। এখানকার বাস্তুতন্ত্র জোয়ার ও ঋতুর মতো পরিবর্তনশীল'।
তাদের প্রথম বই, 'লিভিং উইথ টাইডস অ্যান্ড টাইগার্স: দ্য সুন্দরবনস ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট'-এ সুন্দরবন ও এর অধিবাসীদের সদা পরিবর্তনশীল প্রকৃতিকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
শীঘ্রই আরও একটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা করছেন, যেখানে এই অনন্য ম্যানগ্রোভ বনে হাউসবোটে তাদের বছরব্যাপী থাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরবেন তারা।
প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা, বাংলাদেশে প্রেমে পড়া
সুইজারল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এলিজাবেথের মা আমেরিকান এবং বাবা সুইস নাগরিক। তার মা ও বাবার দুইজনেরই প্রথম দেখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
এরপরে তারা সুইজারল্যান্ডের জার্মান-ভাষী অংশে চলে যান, যেখানে এলিজাবেথ কৃষিজমি এবং বনের মধ্যে একটি গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। পারিবারিকভাবে তারা অনেকটা সময় বাইরেই কাটাতেন। দেশবিদেশে নানা জায়গায় ঘুরেছেন তারা।
অনেকগুলো পোষা প্রাণীও ছিল এলিজাবেথ ও তার বোনের। 'আমাদের একটি বড় বাগান ছিল, যেখানে আমাদের বিড়াল এবং খরগোশ ছিল, পাশাপাশি শজারু, টিকটিকি, প্যাঁচা এবং শিয়ালসহ বিভিন্ন প্রাণী ছিল'।
এলিজাবেথ জানান, সুইজারল্যান্ডে, নবম শ্রেণির পরে, আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আপনি ব্যবসা-বাণিজ্য শিখতে চান নাকি স্কুলের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চান। এলিজাবেথ বলেন, 'সত্যি বলতে স্কুলে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চাইনি আমি'।
ক্যান্টনাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর এলিজাবেথের বাবা-মা তাকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাইস্কুলে এক বছর কাটানোর অনুমতি দেন। সেখানকার শিক্ষকরা তাকে থিয়েটার, শিল্পকলা, খেলাধুলা এবং বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, যা পড়াশুনার প্রতি তার আগ্রহকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে পাঁচ বছর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। 'ভিজ্যুয়াল আর্টস, সংগীত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে জড়িত হওয়ার এবং কীভাবে তাদের শেখানো যায় তা শেখার সুযোগগুলো খুব অনুপ্রেরণামূলক ছিল। আমার ভীষণ ভালো লেগেছে', বলেন তিনি।
টিচার্স ট্রেনিং কলেজে থাকাকালীন তিনি জাপানে লায়ন্স সামার ক্যাম্পে অংশ নেন যেখানে তার সাথে পরিচয় হয় কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কন্যা ফারিয়া হোসেন লারার সাথে। লারা তাকে গ্রীষ্মে বাংলাদেশে ঘুরার আমন্ত্রণ জানান।
লারা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর এবং এক বিমান দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে মারা যান। লারার মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে রুবাইয়াতের সঙ্গে এলিজাবেথের পরিচয় হয়।
২০০২ সালে এলিজাবেথ বাংলাদেশে চলে আসেন এবং দ্য গাইড ট্যুরস লিমিটেডের ন্যাচার গাইড হিসেবে রুবাইয়াতের সাথে যোগ দেন। নৌকায় করে সুন্দরবনে দেশি-বিদেশি অতিথি, চলচ্চিত্র কলাকুশলী, গবেষক ও আলোকচিত্রীদের পথ দেখিয়েছেন তারা।
ডলফিন রক্ষা এবং 'শুশুক মেলা'র আয়োজন
গঙ্গা নদী ও ইরাবতী ডলফিন দিয়ে সামুদ্রিক সংরক্ষণে এই দম্পতির যাত্রা শুরু হয়। ডব্লিউসিএসের বিজ্ঞানী এবং আইইউসিএন স্পিসিস সারভাইভাল কমিটির সিটাসিয়ান স্পেশালিস্ট গ্রুপের এশিয়া কো-অর্ডিনেটর ব্রায়ান ডি স্মিথ বাংলাদেশের সুন্দরবনে প্রথম ডলফিন জরিপে নেতৃত্ব দেন এবং এই অভিযানের জন্য রুবাইয়াতের নৌকা ভাড়া করেন।
এলিজাবেথ ব্রায়ানকে তাদের পরামর্শদাতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 'আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে এবং আপনার আগ্রহ এবং দক্ষতা শিখতে এবং বিকাশ করতে সক্ষম করার জন্য কাউকে লাগে। কীভাবে বন্যপ্রাণী অধ্যয়ন করতে হয়, হুমকি শনাক্ত করতে এবং সংরক্ষণের সমাধান খুঁজে পেতে হবে তা শিখিয়েছিলেন আমাদের', বলেন এলিজাবেথ।
রুবাইয়াত এর আগে যেসব গবেষকের সাথে কাজ করেছেন তাদের অধিকাংশই তাকে বলতেন যে তাদের পদ্ধতি বুঝতে হলে প্রথমে বিজ্ঞানী হতে হবে। ব্রায়ান তাকে দেখিয়েছিলেন যে প্রকৃতি রক্ষার জন্য কাজ করার জন্য আনুষ্ঠানিক বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ পূর্বশর্ত নয়।
ব্রায়ান কঠোর পরিশ্রমী পুরুষ ও নারীদের একটি দল তৈরি করেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের চোখ থাকত পানির দিকে।
এলিজাবেথ বলেন, 'সূর্যাস্তের পর তারা দিনের ডাটা ঢোকার আগে একটা ছোট্ট বিরতি নিতেন, এই সময়ে তারা [ব্রায়ানের দল] কী করছিল এবং কেন করছিল তা ব্যাখ্যা করত আমাদের। ব্রায়ান আমাদের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ পেশাদার হতে অনুপ্রাণিত করেছেন'।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ার সাথে সাথে তারা ভারত ও মায়ানমারের সিটাসিয়ান জরিপ দলে যোগ দেয়। তারা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির জন্য একটি বাংলাদেশ প্রোগ্রাম তৈরি শুরু করে, যা ২০১২ সালে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত হয়।
'২০০৪ সালে শীতের সময় যখন নদীর পানি শান্ত থাকে তখন আমরা উপকূলীয় অঞ্চলে নিয়মিত জরিপ শুরু করি। রুবাইয়াত উপকূলীয় ডলফিনের জন্য একটি ফটো-শনাক্তকরণ গবেষণা শুরু করেছিলেন, আর আমি শিক্ষার প্রসারের দিকে মনোনিবেশ করেছিলাম। আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলগুলো সরকারি কর্মী এবং স্থানীয় জেলেদের জন্য সহজ ভাষায় অনুবাদ করেছি যাতে বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে থাকা এই মিঠা পানির ডলফিনগুলো রক্ষায় তাদেরও এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করা যায়', বলেন তিনি।
স্বাদুপানির ডলফিন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণে এলিজাবেথের প্রথম উদ্যোগটি ছিল 'শুশুক মেলা' ('শুশুক' মানে গঙ্গা নদীর ডলফিন এবং 'মেলা' মানে বাংলায় মেলা বা কার্নিভ্যাল)।
পাঁচ বছর ধরে, তার দল গোলপাতা বজরায় চেপে সুন্দরবনের অরণ্যের নিকটবর্তী সম্প্রদায়গুলোতে একটি ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী চালিয়েছিলেন, যেখানে এই প্রজাতির বেশিরভাগই বাস করে।
ডলফিন কী এবং হাঙ্গর কী?
মানুষ সহজে ডলফিন এবং হাঙ্গরের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। কিন্তু উজ্জ্বল নীল তিমি হাঙরের কানের দুল পরা এলিজাবেথ আমাকে তার ডলফিন, হাঙর, শংকর মাছ এবং সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রপস দেখিয়ে খুব সহজ ভঙ্গিতেই পার্থক্য বুঝিয়ে দিলেন।
ডলফিন হলো বায়ু-শ্বাস-প্রশ্বাসের স্তন্যপায়ী প্রাণী যার লেজ উপর-নিচে যায়। অন্যদিকে হাঙ্গরের লেজ পাশাপাশি (বাম-ডান) যায়।
একটি অর্কা মূর্তির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে অর্কাস, ইরাবতী ডলফিনের আত্মীয়, যাদের বেশিরভাগ সমুদ্রে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের জন্য কেবল একটি নথিভুক্ত রেকর্ড রয়েছে, যা একজন জেলে তৈরি করেছেন। এলিজাবেথ বলেন, 'তিনি আমাদের দ্বারা নাগরিক বিজ্ঞানী হিসেবে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন এবং প্রাণীটির অত্যন্ত লম্বা পৃষ্ঠীয় পাখনার ছবি তুলেছিলেন'।
এলিজাবেথ নৌকা থেকে ডলফিন বা তিমির খেলা দেখতে পছন্দ করেন। 'আমি ডুবুরি নই, তবে পানির নিচে না থেকেও সিটাসিয়ানদের পর্যবেক্ষণ করা যায়। তারা শ্বাস নিতে পৃষ্ঠে আসে, যখন আমরা তাদের পর্যবেক্ষণ করতে এবং ছবি তুলতে পারি', বলেন তিনি।
সম্প্রতি ডাব্লুসিএস থেকে পদত্যাগ করেছেন এলিজাবেথ, পরিবারের সাথে আরও বেশি সময় কাটাতে চান তিনি।
তিনি বলেন, 'আমি বাংলাদেশে বাস করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, এটি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং আকর্ষণীয় দেশ। এখানের মানুষজন অতিথিপরায়ণ, প্রিয় এবং অমায়িক। আমি এখানে যে সুযোগ পেয়েছি এবং কাজে লাগাতে পেরেছি তা অনন্য। এই দেশকে নিজের বাড়ির মতো মনে হয়। আমি এখানে ভালোর জন্য এসেছি'।