ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে ডলফিনরাও একে অপরকে ‘হাসি’ দেয়!
মানুষ শুধু হাসি দিয়েই যেমন ভুল বোঝাবুঝি দূর করে ফেলে ঠিক তেমনি ডলফিনও নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে 'হাসি' দেয়। সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বোতলনোজ প্রজাতির ডলফিনরা খেলাধুলার সময় মুখ খোলা রেখে 'হাসি'র মতো অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।
গত বুধবার আই সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, ডলফিনরা খেলার সময় মুখ খোলা রেখে এক ধরনের অভিব্যক্তি প্রদর্শন করে যা 'হাসির' মতো দেখায়।
গবেষণাটি পরিচালনা করেন ইতালি ও ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা। তারা এ গবেষণার জন্য রোমের জুমারিনের ১১টি ডলফিন এবং পশ্চিম ফ্রান্সের প্ল্যানেটে সোভেজে ১১টি ডলফিনের ওপর এ পরীক্ষা চালিয়েছে। ডলফিনরা একে অপরের সঙ্গে কী করছে, মানব প্রশিক্ষকের সঙ্গে কী করছে এবং একা খেলার সময় কেমন আচরণ করছে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করেন তারা।
গবেষকরা ডলফিনদের এ কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পেয়েছেন, এ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো তাদের সঙ্গীরা দৃষ্টিসীমার মধ্যে এলেই হাসছে এবং এক-তৃতীয়াংশ সময় অপর সঙ্গীও তাদের পালটা হাসি দিচ্ছে। গবেষকরা ধারণা করছেন, এটি ডলফিনদের যোগাযোগের একটি মাধ্যমও হতে পারে। তারা ধারণা করছেন, খেলার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থেকে লড়াই এড়াতে ডলফিনরা একে অপরকে হাসি দিয়ে সমস্যা মিটিয়ে নেয়।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের সান অ্যান্টেনিও'র সেন্ট মেরি ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ডলফিন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ হিদার হিল বলেন, এ অভিব্যক্তি মানুষের 'হাসির' মতো মনে হলেও, এ সম্পর্কে অতিরিক্ত ধারণা পোষণ করা থেকে বিরত থাকাই ভালো।
তিনি সিএনএনকে বলেন, "আমি মনে করি ডলফিনরা খেলার সময় মুখ খোলা রেখে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়। এটি তাদের যোগাযোগের মাধ্যম হতে পারে। তবে আমি একে 'হাসি' বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি না। কারণ তারা অন্যান্য সময়ও এমন মুখ খোলা রেখে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।"
ডলফিনের সঙ্গে মানুষের সখ্যতা আছে। তারা খেলতে পছন্দ করে। এছাড়া তাদের সামাজিক জীবনও সমৃদ্ধ এবং একে অপরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ প্রক্রিয়াও জটিল। ডলফিনদের একসঙ্গে খেলার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময় একসঙ্গে পানির ওপর লাফায়, পানির মধ্যে ডুব দেওয়া বা উল্টানো কিংবা লেজ দিয়ে পানির ওপর আঘাত করা, কিংবা খেলার ছলে লড়াই করা বা ঢেউয়ের মধ্যে সার্ফিং করার মতো আরও অনেক কিছু করে থাকে।
তবে ডলফিনরা যখন খেলাধুলা করে, তাদের মুখাবয়ব কেমন থাকে তা কখনও পর্যালোচনা করা হয়নি। এর আগে মানুষ ও বানরের মতো অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের খেলার সময় মুখ খোলা ও হাসির মতো অভিব্যক্তি নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক এ গবেষণায় দেখা গেছে, ডলফিনরা যখন খেলে তারা ৯২ শতাংশ সময় মুখ খোলা রেখেছিল। আর এ অভিব্যক্তি দেখা গেছে শুধু যখন তারা একে অপরের সঙ্গে খেলছিল তখনই। তবে মানুষের সঙ্গে কিংবা একা খেলার সময় তারা এমন কোনো অভিব্যক্তি দেয়নি।
এছাড়া ডলফিনরা যখন আক্রমণাত্মক কিংবা প্যারালাল সাঁতার বা উলটা সাঁতারের মতো কাজ করছে তখনও তাদের মধ্যে ওই মুখ খোলা রাখার অভিব্যক্তি দেখা যায়নি।
ডলফিনদের খেলার সময় কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে যোগাযোগের গুরুত্বকেও গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন। তারা বলেন, তারা এ সংকেতগুলো রেকর্ড করেননি। কিন্তু ভবিষ্যতে এগুলো গবেষণার বস্তু হেতে পারে।
টুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ লিভিও ফাভারো এক বিবৃতিতে বলেছেন, "ডলফিনরা প্রাণীজগতের সবচেয়ে জটিল কণ্ঠস্বরের অধিকারী। তারা তাদের কণ্ঠস্বর শিকারি বা গুপ্তচরদের সামনেও প্রকাশ করতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "যখন ডলফিনরা একসঙ্গে খেলে তখন শিষ দেওয়া ও দৃশ্যমান সংকেত দেয়। এগুলো তাদের একসঙ্গে কাজ করতে এবং লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। তাদের এ কর্মকাণ্ড একসঙ্গে খেলায় বিশেষভাবে উপযোগী। কারণ এসময় তারা কম সতর্ক থাকে।"
তবে এ গবেষণার জন্য ব্যবহৃত সব ডলফিনই বন্দী ছিল। ডলফিন-যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ হিদার হিল বলেন, "হাসির মতো আচরণ তারা মুক্ত থাকা অবস্থাতেও করে। তবে সম্ভবত ঘন ঘন তারা এ আচরণ করে না। কারণ এসময় তারা বেশিরভাগ সময় খাবার খুঁজতে কিংবা শিকারিদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত থাকে।"
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, "এ গবেষণার পরবর্তী পদক্ষেপ হবে প্রাকৃতিক আবাসনে ডলফিনদের পর্যবেক্ষণ করা।"