আফসার ও শাহরিয়ার: গুলির জখম নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে কাতরাচ্ছে ১২ বছর বয়সি এ দুই শিশু
পিলারের পেছনে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট শাহরিয়ার ভয়ে কাঁপছিল। গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় এক পুলিশ সদস্য যখন আবার থানায় ফিরে যায়, তখন কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। সতর্কতার সাথে কয়েক কদম পেছনে গিয়ে আরেকটি পিলারের পেছনে অবস্থান নেয়।
কিন্তু একটু পরেই পুলিশরা আবার ফিরে আসে গুলি নিয়ে। এবার ভয়ে সে বসে পড়ে পিলারের আড়ালে। তখনই পেছন থেকে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, "সাবধান!"
পেছনে তাকাতেই শাহরিয়ার দেখল, মাত্র ১০ ফুট দূরে তিনজন পুলিশ তার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে আছে। এক পুলিশ শটগানের চেম্বার লোড করল, ক্লিক শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেল সে। তার সামনে তখন একটাই পথ খোলা— বেঁচে থাকার আশা নিয়ে সেই পিলারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা।
"আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম," স্মৃতিচারণ করে বলল শাহরিয়ার। ঠিক তখনই পা এসে গুলি লাগে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। আঘাত পাওয়া পা বুকের কাছে চেপে ধরে থাকে।
মাত্র ১২ বছর বয়স শাহরিয়ারের। জুলাই বিপ্লব আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিল সে। সেদিন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটের দিকে, হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির খবর শুনে অন্য সবার মতো সেও বিজয় মিছিলে যোগ দেয়। "এই খবর শোনার পরই আমরা রাস্তায় নেমে গিয়েছিলাম," বলল শাহরিয়ার।
মিরপুরের মডেল থানার কাছে পৌঁছানোর পরই বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনার মুখে পড়ে তাদের দল। শাহরিয়ারের ভাষ্যে, 'এক পর্যায়ে পেছনে ফিরে দেখি, আমাদের আশেপাশের লোকেরা সবাই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত'। এ অবস্থায় আশ্রয়ের খোঁজে কোনো কিছু না ভেবেই পিলারের পেছনে অবস্থান নেয় সে।
গুলিবিদ্ধ শাহরিয়ারকে নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)। ৩০ সেপ্টেম্বরের হিসেবে, জুলাই বিদ্রোহে আহত হয়ে নিটোর-এ ভর্তি হয়েছিল ৭৭ জন, যাদের বেশিরভাগই গুলিবিদ্ধ এবং বয়সে তরুণ; আগস্টে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল শতাধিক।
হাসপাতালের ওয়ার্ড-বি'র ৩০ জন গুলিবিদ্ধদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সি ছিল ১২ বছর বয়সি মো. শাহরিয়ার রশিদ ও আফসার হোসেন।
রাবার থেকে মেটাল
আবু সাঈদের মৃত্যুর পরের দিন, অর্থাৎ ১৭ জুলাই মিরপুরেও আন্দোলন শুরু হয়। ২০ সেপ্টেম্বর দেয়া সাক্ষাৎকারে টিবিএসকে শাহরিয়ার বলে, 'আমার এলাকার বড় ভাইদের আন্দোলনে যেতে দেখে আমিও তাদের সাথে যোগ দিই। আমি অনেককে গুলি খেতে দেখেছি।'
১৯ জুলাই মিরপুর মডেল থানার দিক থেকে পুলিশ রাবারের গুলি, শটগানের পিলেট এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ছিল, কিছু সময় পরে হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছোঁড়া শুরু হয়। শাহরিয়ারকে পাঁচটি রাবার বুলেট দিয়ে গুলি করে পুলিশ।
সেদিন বাসায় ফিরে যায় শাহরিয়ার। গুলি খাওয়ার ব্যাপারে কাউকেই কিছু জানায়নি সে। মায়ের কাছে ফুটবল খেলার পর ক্লান্তির কথা বলে প্যারাসিটামল খেয়ে ঘুমাতে চলে যায়।
৪ আগস্ট আবারও রাবারের গুলি খায় সে। ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের সহযোগী গোষ্ঠীগুলো পুলিশের সাথে মিলে রক্তাক্ত সহিংসতা চালায়। ওই দিন শাহরিয়ারের গায়ে তিনটি রাবার বুলেট লাগে।
আন্দোলনের এই কয়েকদিন তার প্রতিদিনকার রুটিন ছিল এরকম—মায়ের কাছে মিথ্যা বলে বাইরে বের হওয়া, বড়দের সাথে আন্দোলনে অংশ নেয়া, নিরাপদে বাসায় ফেরা এবং ঘুমোতে যাওয়া। পরের দিন আবারও একই।
"মা ওই দিন (৫ আগস্ট) আমাকে বাইরে বের হতে দেননি, কিন্তু আমি সবার সাথে আন্দোলনে যোগ দিতে বের হয়ে গেলাম," শাহরিয়ার বলে। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, এই ছোট্ট বয়সে কেন বড়দের সাথে এভাবে আন্দোলনে যোগ দিল, তখন সে কিছু না বলে মুচকি হাসল শুধু।
ভাগ্যক্রমে, সেদিন কিছু শিক্ষার্থী শাহরিয়ারকে মিরপুরের রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে। "তারা আমাকে রিকশায় তুলে আল-হেলাল বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সক্ষম হন। কিন্তু সেখানে পুরোপুরি চিকিৎসা সম্ভব হয়নি", জানায় শাহরিয়ার।
পরবর্তীতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (নিটোর) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। শাহরিয়ার জানায়, 'যখন তারা (ডাক্তাররা) ব্যান্ডেজ খুলল, তখন তারা দেখতে পেল, আমার বাঁয়ের ইউরেটার (মূত্রনালী) ছিঁড়ে গেছে'।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেস-এ তার দুটি সার্জারি হয় এবং দুই দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। পরে তাকে আবার নিটোরে পাঠানো হয়। হাড় ভেঙ্গে যাওয়ায় আরও তিনটা সার্জারি করতে হয় তাকে।
মিরপুরের অভিযাত্রিক স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, শাহরিয়ারের এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে পাঁচটি সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে। মিরপুরেই মায়ের সাথে থাকে সে। চার বছর আগে ব্রেন স্ট্রোক করে বাবা এখন শয্যাশায়ী।
শাহরিয়ারের একমাত্র ভাই—তিন বছর বয়সী রায়ান, মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে ভাইয়ের দেখাশুনা করে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও নিটোরে ভর্তি শাহরিয়ার।
"আমি দেখি সব এই রোগীরা হাসপাতাল থেকে ছাড় পাচ্ছে। কিন্তু আমার ছেলের এখনও সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে," বলেন শাহরিয়ারের মা সাদিয়া আখতার রানি। পরিবারের খরচ মেটাতে দর্জির কাজ করেন তিনি।
তার মা বলেন, 'ছেলের পাশাপাশি আমাকে আমার অসুস্থ স্বামীরও দেখভাল করতে হবে। আমি ভাবছি, কীভাবে তাদের চিকিৎসা করাব'। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ সুস্থ হতে তার প্রায় আরও এক বছর সময় লাগবে।
হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া সত্ত্বেও, আগস্ট মাসে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে যাওয়া-আসার কারণে শাহরিয়ারের মায়ের প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
"রাতে ঘুমোতে পারি না। ঘায়ের জায়গায় প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া করে, চুলকায় এবং ব্যথা সহ্যসীমার বাইরে," বলে শাহরিয়ার।
সবার ছোট আফসার
একই ওয়ার্ডে ভর্তি আফসার হোসেন। শাহরিয়ারের মতো, তার বয়সও ১২ বছর, কিন্তু তার শারীরিক গঠন একটু ছোট। ৫ আগস্ট, বিকেল ৪টার দিকে আজমপুর, উত্তরা এলাকায় কাঁধে গুলি লাগে তার।
"এটা ছাত্রলীগের কাজ ছিল নাকি পুলিশের, তা আমি বলতে পারব না," ৩০ সেপ্টেম্বর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলে আফসার।
২০ সেপ্টেম্বর, নিটোর হাসপাতালে ভর্তি গুলিবিদ্ধ রোগীদের দেখতে আসেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস। "আমি তাকে দেখেছি," আফসার বলে, "তিনি আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন"।
গুলিতে আফসারের একটি জয়েন্ট ছিঁড়ে গেছে। আফসারের মা জেসমিন আফসার এক্সরে রিপোর্ট দেখিয়ে বলেন, "গুলি এদিক দিয়ে ঢুকে, ওই পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে"।
তিনি জানান, "ডাক্তাররা তার ২০ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন, তখন অপারেশন করে জয়েন্টটি ঠিক করা যাবে"। আর এর আগ পর্যন্ত? "থেরাপি," আফসার বলে। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হতে হলে অপারেশন প্রয়োজন বলে জানায় সে।
আফসারের আট বছর বয়সি ছোট ভাই এবং বড় তিন বোন রয়েছে। "আমার স্বামী চলাফেরা করতে অক্ষম, মস্তিষ্কের স্ট্রোক হয়েছে উনার," জেসমিন বলেন।
৫ আগস্ট, আফসার ছিল আজমপুরে। বিশৃঙ্খলার মধ্যে গুলিবিদ্ধ হলে শিক্ষার্থীরা তাকে নিয়ে যায় প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন অ্যান্ড হাসপাতালে, সেখানে এক রাত ছিল সে।
পরদিন সকালে, অর্থাৎ ৬ আগস্ট, তারা নিটোর হাসপাতালে আসেন। "৭ আগস্টে আমাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। চিকিৎসার খরচ কীভাবে মেটালাম, সেটা আল্লাহ জানেন। আমার মেয়ে ও তার স্বামী এবং আমি আমাদের সোনা বিক্রি করেছি চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য।"
আফসারকে ২০ আগস্ট আবার নিটোর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৭ অক্টোবর, তার কাঁধের রড বের করতে অপারেশন হয়।
নোয়াখালীর ইসলামিয়া মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে আফসার। জুলাই মাসের আন্দোলনের আগে ঢাকায় তার বোনের কাছে বেড়াতে আসে সে। তার বোনের স্বামী এখানেই কাজ করেন।
১৯ অক্টোবর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আফসার ও তার পরিবার। "নোয়াখালীতে বন্যায় যখন আমার বাড়ি ডুবেছিল, তখন আমি ঢাকায়", ২২ অক্টোবর ফোনে জানালেন তার মা জেসমিন। আফসার এখনও পুরোপুরি হাঁটাচলা করতে না পারলেও কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানান তার মা।