‘ফকিন্নি বাজার’: সাধ্যের মধ্যে সাধের সদাই
শরিফা বেগম পুরো বাজার ঘুরে ঘুরে একাধিক দোকান পরখ করলেন। কোন দোকানে কত দাম—সেটাও খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর একটি দোকান থেকে একে একে বেগুন, শসা, কাঁচকলার সঙ্গে মুলাও কিনলেন। সব মিলিয়ে দোকানিকে দিলেন ৫০ টাকার একটি নোট। দোকানি তাকে ১০ টাকা ফেরতও দিলেন। অর্থাৎ এতগুলো সবজির দাম মাত্র ৪০ টাকা!
কেমন অবাক লাগছে, তা-ই না? দুর্মূল্যের এ বাজারে এমন দামে এতগুলো সবজি কেনা রীতিমতো অসম্ভব।
সাধ্যের মধ্যে সাধের বাজার
ধরুন, আপনার হাতে আছে মাত্র ৫০ টাকা। এ টাকায় আপনি কিনতে চান পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, হলুদ এবং মরিচের গুঁড়া। মাত্র ১০ টাকা দামে প্রতিটি পণ্যই কিনতে পারবেন তেজগাঁওয়ের 'ফকিন্নি বাজার' থেকে।
না, আপনি শায়েস্তা খানের আমলে ফিরে যাননি, আর দ্রব্যমূল্যও হঠাৎ করে কমে যায়নি। এ বাজারের বিশেষত্বই এমন। আশপাশের নিম্ন আয়ের মানুষ এখানে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেন তুলনামূলক অনেক কম দামে।
শরিফা বেগম এ বাজারের একজন পুরোনো ক্রেতা। প্রায় ১৯–২০ বছর ধরে এখান থেকেই কেনাকাটা করেন তিনি। তার বাসা ফকিন্নি বাজারের পাশেই, ব্রিজতলায়। গত ২৪–২৫ বছর ধরে তিনি এ এলাকাতেই থাকছেন।
তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা বড়—স্বামী, দুই মেয়ে, তিন ছেলে। স্বামী পেশায় ভ্যানচালক। একসময় গার্মেন্টসে কাজ করলেও বয়সের ভারে শরিফা আর সে কাজ করতে পারেন না। স্বামী ও ছেলেরা ভ্যান চালিয়ে যা উপার্জন করেন, তা দিয়েই কোনোমতে চলে সংসার।
আগে কাওরান বাজার থেকে কেনাকাটা করতেন শরিফা। তবে দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকায় সেখান থেকে কেনাকাটা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। এরপর থেকে ফকিন্নি বাজারেই নিয়মিত আসা শুরু করেন। এতে কিছুটা সাশ্রয় হয়।
তার ভাষায়, 'এ বাজার আছে বইলা আমরা অহনো বাঁইচা আছি। আমগো কথা কেউ ভাবে না। দাম বাড়লে বাড়তেই থাহে। এহানে অহনো আমরা কম দামে পাই জিনিস। এর লাইগা এত বছর ধইরা খাইবার পারতেসি।'
ফকিন্নি বাজার
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের পূর্ব নাখালপাড়ায় রেললাইনের পাশে অবস্থিত এ বাজার। স্থানীয়রা এটিকে ফকিন্নি বাজার নামেই ডাকেন। নামটি শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিম্ন আয়ের মানুষের বেঁচে থাকার গল্প।
পূর্ব নাখালপাড়ার প্রধান সড়ক থেকে সরু একটি গলি। সে ধুলো-মাখা গলি পেরিয়ে দেখা মেলে একটি খোলা মাঠ, যার ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। বাজারটি মূলত এ রেললাইনের পাশে। ওপরে ফ্লাইওভার ব্রিজ এবং তার নিচেও বাজারের আরেকটি অংশ।
বাজারে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে ছোট ছোট দোকানের ব্যস্ততা। প্রায় শতাধিক দোকান, যেগুলো বাঁশের খুঁটি দিয়ে বানানো এবং ওপরে টিন কিংবা পলিথিন দিয়ে ছাওয়া।
বাজারের শুরুটা নিয়ে নানা গালগল্প শোনা যায়। কেউ বলেন, এটি ৪০ বছরের পুরোনো, আবার কেউ দাবি করেন ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে বিকিকিনি চলছে।
৭৮ বছর বয়সি মো. আলাউদ্দিন বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তিনি নরসিংদী থেকে ঢাকায় আসেন এবং এখানে বসতি গড়েন। শুরুর দিকে তার চায়ের দোকান ছিল। ৩৫ বছর ধরে তিনি এ বাজারে ব্যবসা করছেন। তার মতে, বাজারটি ৪০–৪৫ বছরের পুরোনো।
আরেক দোকানি ষাটোর্ধ রিজিয়া বেগম ৩০ বছর ধরে এ বাজারে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, 'এ পুরা এলাকায় বড় একখান বস্তি আছিল। অহন ফ্লাইওভার হইসে, বস্তি উঠায়ে দিসে। বস্তির মহিলারা কাওরান বাজার থেইকা মাল টুকায়ে আনতো। আইন্না এহানে বিক্রি করতো। আমার হিসাব মতে, এ বাজার ৪০ বছরের তো পুরান হবোই।'
বাজারের নাম নিয়েও রয়েছে নানা গল্প। মো. আলাউদ্দিন বলেন, 'আগে ফকিন্নিরা এখানে ভিক্ষা কইরা এহানে আইসা বাজার করতো। দামে কম আছিলো বইলা ফকিররাই বেশি আইতো। সেহান থেইকাই নাম হইছে ফকিন্নি বাজার।'
রিজিয়া জানান, টোকাই নারীরা কাওরান বাজার থেকে কুড়িয়ে আনা সবজি এখানে ভিক্ষুকদের কাছে বিক্রি করতেন। সেখান থেকেই নামটি চালু হয়।
তবে মুদি দোকানি নূর আলম বলেন, 'অনেক আগে এ এলাকার ভিক্ষুকরা তাদের ভিক্ষার চাল-ডাল আর পাইকারি বাজার থেকে পাওয়া সবজি এখানে এনে বিক্রি করত। কম দামে এসব পণ্য নিম্নবিত্তরা কিনত। এজন্য বাজারের নাম লোকমুখে ফকিন্নি বাজার হয়ে যায়।'
ভাগা আর খুচরা মাপে বেচাকেনা
বাজারের প্রতিটি দোকানের সামনে কিছু কাটাছেঁড়া সবজি, ভাঙা ডিম, নেতিয়ে পড়া শাকের আঁটি সাজিয়ে রাখা। আবার কিছু কিছু দোকানে সবজি রাখা হয়েছে ভাগ ভাগ করে। এসব নাকি বিক্রি হয় ভাগা হিসেবে। সবজির অবস্থা অনুযায়ী দাম হয় কম-বেশি। এক ভাগা করলা, কাঁচকলা, শসা, আলু, মুলা, বেগুনের দাম ১০ টাকা করে। সবজির মান একটু ভালো হলে ১৫–২০ টাকা পর্যন্ত হয় দাম।
এ ভাগার পরিমাণে প্রায় কেজি খানেক সবজি থাকে। ডিম বিক্রি হয় পলিথিনে। আধ ভাঙা ডিমগুলো ফাটিয়ে নিয়ে পলিথিনে করে দেওয়া হয়। হালি প্রতি দাম রাখা হয় ৩০–৩৫ টাকা।
বাজারজুড়ে দেখা মেলে মুদির দোকানেরও। সেখান থেকে সাধ্যমতো কিনতে পারা যায় যাবতীয় মশলা, তেল, চাল, শুটকি। ১০ টাকায় কেনা যাবে ডাল, জিরা, সরিষা, ধনেগুঁড়া, মরিচগুঁড়া, হলুদগুঁড়া, দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, গোলমরিচসহ অন্যান্য মসলা। ছোট ছোট প্যাকেট আকারে সাজিয়ে রাখা থাকে সেসব।
কেউ যদি ছটাকে তেল কিনতে চান, বিক্রি হয় সেভাবেও। তাই ক্রেতারা এসে দুই ছটাক, চার ছটাক (২৩৩ গ্রাম) যেটুকু সামর্থ্য, সেটুকুই কিনে নেন। একই নিয়ম চালের ক্ষেত্রেও। যদি কেউ আধা কেজি চাল কিনতে চায়, সে ব্যবস্থাও আছে এখানে।
অর্থাৎ, এ বাজারের আসল আকর্ষণ হলো জিনিসপত্রের 'দাম' এবং 'পরিমাণ'। আপনি যতটুকু কেনার সামর্থ্য রাখবেন, ঠিক ততটুকুতেই দেওয়া হবে পণ্য।
এ বিষয়ে কথা হলো বাজারের আলু-পেঁয়াজ-রসুনের দোকানী নূর আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'এমনও হয় কেউ যদি আইয়া কয়, ভাই, দুইডা পিঁয়াজ দাও, আমরা দেই। মাপে যা আসে ওই দাম লই। কেউ দুইডা আলু লইতে চাইলেও দিই। কারণ হইলো গিয়া এহানে গরিবরা আহে বেশি।'
কোথা থেকে আসে এসব কাঁচামাল? নূর আলম সে প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'ভোর ৪–৫টার দিকে কাওরান বাজারে গিয়া এসব জিনিসপাতি নিয়া আসি আমরা। অইসব আইন্না গুছাইয়া ফেলি। সকাল ৭টা থেইকা রাত ৭–৮টা পর্যন্ত বেচাকেনা করি।'
সপ্তাহের সাতদিনই জমজমাট থাকে এ বাজার। সকাল ৭–৮টার দিকে শুরু হয় বাজারের সমস্ত কর্মযজ্ঞ। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
ক্রেতা কারা?
এ বাজারের বর্তমান ক্রেতা কারা? কোন শ্রেণির মানুষ? মুখে স্মিত হাসি নিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ আলাউদ্দিন বললেন, সব শ্রেণির মানুষই আসেন আজকাল।
'এ যে আশেপাশে বিল্ডিং দেখতেসেন, ওদের সবাই এহান থেইকাই কিনে। গাড়ি লইয়াও লোকজন আসে, যা লাগে বস্তা ভর্তি কইরা কিনা লয়। উলটা আমাদের মতো কাঙ্গালরাই কম আসে।'
তবে রিজিয়ার ভাষ্য অন্য। তার মতে নিম্ন আয়ের মানুষেরাই বেশি ভিড় জমান এ বাজারে। বিকেল হলেই খেটে খাওয়া লোকেদের আগমন বাড়ে। হাতভর্তি বাজার নিয়ে ঘরে ফেরেন তারা। তবে অন্যান্য শ্রেণির (রিজিয়ার মতে বড়লোক আর মধ্যবিত্ত) আসা-যাওয়া বাড়ার কথাও শোনা গেলো তার মুখে।
অবশ্য তার কথার সত্যতা পেতে অপেক্ষা করতে হয়নি বেশিক্ষণ। কথা হলো ক্রেতা খাদিজা আক্তারের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। প্রতি শুক্রবার এ বাজারে সবজি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে ঢু মারেন খাদিজা। কম দামে ভালো সবজি পাওয়া যায় বলে প্রায় আসা হয় তার।
তিনি বলেন, 'আপনি যদি বেছে নিতে পারেন, তবে অনেক ভালো সবজি কম দামে কিনে নিতে পারবেন। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত যারা, তারা চাইলেই এখান থেকে কম দামে অনেক জিনিস কিনতে পারে। ওদেরও লাভ হইলো, আমাদেরও টাকা বাঁচলো কিছু।'
একটা সময় এ বাজার বিস্তৃত ছিলো অনেক জায়গাজুড়ে। এখন বাজার ভাগ হয়েছে চার ভাগে। রয়েছে আলাদা আলাদা নামও—পাগলাপুর, বাউলবাগ, খেলাঘর মাঠ এবং ব্রিজতলা নিয়েই ফকিন্নি বাজারের চারটি শাখা।
তবে বাজার ছোট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে এসেছে বাজারের দোকানীদের আয়ও। অনেকটা আক্ষেপের সুরে রিজিয়া জানালেন, 'আইজ থেইকা ২০ বছর আগে লাভ করতাম বেশি। আগে ২০০ ট্যাহায় ২০–২৫ কেজি গাজর আনলে এহন ৬০–৭০ টাকা কেজিদরে আনি।'
মানুষ কমে যাওয়ার কারণেই লাভ নাই বলে মত তার। আগে বস্তির বাসিন্দারা সবাই এখান থেকেই কিনে নিতেন প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এমনকি তাদের একমাত্র বাজার করার জায়গা ছিল এটি। পরে বস্তি ভেঙে ফেললে কমে যায় তাদের বেচাকেনাও।
কিন্তু এত কিছুর পরেও জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার এ লড়াই থেমে নেই তাদের। খানিক ভালো থাকার আশায় এ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন রিজিয়ার মতো ফকিন্নি বাজারের বিক্রেতারা।
অন্যদিকে ক্রেতারাও একটু সাশ্রয়ের পথ হিসেবে এ বাজারে ঢু মারেন নিয়ম করে।
যেমন রিকশাচালক রফিকের ভাষ্যে, 'এ বাজার না থাকলে অনেক লোক না খাইয়া মরতো, মামা। এডা আছে বইলা অহনো খাইতে পারতেসি। আশি–নব্বই টিয়া দিয়া আমরা কি সবজি কিন্না খাইতে পারমু? এহানে তো ১০–১৫ ট্যাহায় কিনতে পারি। আমাগো লাইগা এডাই ভালো।'
ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা/টিবিএস