পুরোনো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের সকল কাজের কাজী যারা
সদরঘাটে মো. চিন্টুর আগমন ঘটে আজ থেকে ৩০ বছর আগে। কাজের সন্ধানেই নিজ এলাকা বরিশাল ছেড়ে ঢাকায় আসেন। কিন্তু কাজের সেভাবে সুবন্দোবস্ত হয়নি। তাই বলে তো অলস সময় কাটানোরও উপায় ছিল না। কারণ সংসারে টাকা না দিলে উপোসে থাকবেন স্ত্রী-সন্তানেরা। তাই সাহস করে সে সময়ে নষ্ট বা ভাঙাচোরা লাইট, ফ্যান, ঘড়ি এসব মেরামতের কাজ করা শুরু করেন। আগে থেকেই টুকটাক এ কাজে পটু ছিলেন চিন্টু। ফলে তার ওপর নির্ভর করে পুরোদমে এই কাজে নেমে পড়েন।
চিন্টুর দোকানটি সদরঘাট রাস্তার পাশেই। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে একটু সামনে এগোলেই সারিবদ্ধ এসব পুরোনো যন্ত্রপাতির দোকান চোখে পড়বে সহজেই। এসবের মধ্যে প্রথম যে দোকানটি, সেটিই হলো চিন্টুর। এলাকায় তার বেশ চেনাজানা, নামডাম। অনেকেই এই কাজ করলেও চিন্টুকে বেশ সমীহের চোখে দেখেন। একবাক্যে স্বীকার করেন, 'আমরা না পারলেও চিন্টু পারবো। অয় এসব ভালা পারে।'
এই কাজে চিন্টুর আয় ভালো বলা চলে। তার দৈনিক আয় হাজার টাকার মতন। এতে বেশ ভালোভাবেই জীবন চলে তার। তাই কোনোরকম অভিযোগ বা অনুযোগ নেই তার। দিনশেষে যা আয় করেন, তাতে বেশ সন্তুষ্টই তিনি। সকাল ৮-৯টা হতেই কাজে আসেন চিন্টুরা। চলে রাত ১০ টা অবধি।
চিন্টুরা কয়েকজন মিলে মেস করে থাকেন সদরঘাটের আশেপাশেই। সেখানে তাকে থাকার জন্য ২,০০০ হাজার টাকা গুণতে হয়। তবে তাতে বেশ একটা সমস্যা হয় না। দিনে তার ১,০০০-১,২০০ মতো আয় হয়। কখনো সখনো আবার কমেও যায়। তবে দিনে যা আয় করেন, তার বেশিভাগ পাঠানো হয় বাড়িতে। তাদের দিয়ে যেটুকু রয়ে যায় সেটুকু দিয়ে নিজের খাবার-দাবার চালিয়ে নেন।
২০ টাকায় লাইট মেরামত
পুরোনো নষ্ট যন্ত্রিপাতি ঠিক করেন চিন্টুরা। আশপাশের মানুষেরা তাদের লাইট, ফ্যান, রিমোট, ঘড়ি নষ্ট হলে ঠিক করিয়ে নেন তাদের কাছে। মূল্য হিসেবে গুণতে হয় নামমাত্র টাকা। মাত্র ২০ টাকায় লাইট ঠিক করে দেন চিন্টু। ৭০-৮০ টাকায় বাটন ফোন। ঢাকার কোথাও কি এত কম মূল্যে যন্ত্র 'রিপেয়ার' হয়? ঠিক জানা নেই।
চিন্টুর সাথে আলাপকালে জানতে চাইলাম তাদের ঠিক কী বলে ডাকেন এলাকাবাসীরা? চিন্টুর সোজাসাপ্টা উত্তর, 'ভাঙ্গাচোরার দোকানদার'। কথাটি বলার সময় চিন্টু হাসলেন না। তার কাছে এই উপাধি খুব স্বাভাবিক। অবশ্য এই নামের পেছনের যে গল্প, সেটিও বেশ মজার। চিন্টুদের সাথে আলাপ দিতে সে রহস্যও বেরিয়ে এলো।
ভাঙ্গারীর মালামাল
শহরের অলিগলিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কম দামে পুরোনো যন্ত্রপাতি কিনে নেন ভাঙ্গারীরা। তা হতে পারে পুরোনো মোবাইল ফোন, ফ্যান, লাইট, চার্জার, ফোনের তার, ট্রিমার, আয়রন মেশিন, হেডফোন, রাউটার, ঘড়ি, হেয়ার ড্রায়ার, হেয়ার স্ট্রেইটনার, খেলনা গাড়ি, টিভি বা এসির রিমোট। সংগৃহীত এসব পুরনো বা নষ্ট যন্ত্রপাতি খুব অল্প দামে বিক্রি করে দেন চিন্টুদের কাছে।
তবে সবটা ক্রয় করেন না চিন্টুরা। যেসব ঠিক করার মতো অবস্থা আছে বা দেখতে ভালো সেগুলোই কিনে নেন। খুব কম দামেই ভাঙ্গারীরা এসব বিক্রি করেন চিন্টুদের কাছে। চিন্টুরা সেসব পুরনো যন্ত্র ঠিকঠাক করে বিক্রি করেন সাধারণ মানুষের কাছে। দামও রাখা যায় বেশ অল্প লাভে। এইতো ২০-৩০ টাকা! ফলে দেখা যায়, নতুন যন্ত্র কেনার সামর্থ্য নেই যাদের, বিশেষ করে ছাত্র বা নিম্নবিত্তরা এসে এখান থেকেই কিনে নেন পছন্দের পণ্য।
হাজার টাকার রাউটার ২০০ টাকা!
এই যেমন রাউটারের কথাই ধরা যাক। ভালো মানের একটি রাউটার কিনতে গেলে যে কাউকে গুণতে হবে হাজার-দেড় টাকা। কিন্তু এই ক্রয়ক্ষমতা কতজনেরই বা থাকে? তবে চিন্টুদের দোকানে এমন একটি রাউটার কিনতে পাওয়া যাবে ২০০-২৫০ টাকায়।
একইভাবে, কোনো ক্যাবল বিশেষ করে টাইপ 'সি' এখানে কিনতে পাওয়া যাবে ১০০ টাকার মধ্যে। লাইট কিনতে পাওয়া যায় ৩০-৫০ টাকায়৷ এতে সাধারণ মানুষ যেমন সাধ্যের মধ্যে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসটি কিনতে পারেন, তেমনি চিন্টুদেরও রোজগারের একটি পথ তৈরি হয়।
তবে শুরুর দিকে আশেপাশের মানুষ যখন তাদের নষ্ট যন্ত্রপাতি দিয়ে যেতেন, তার কিছু কিছু ঠিক করতে পারলেও কিছু পারতেন না চিন্টু। যেসব পারতেন না সেসব আবার ফিরিয়ে দিতেন তাদের কাছে। তবে বিপত্তিটা হতো অন্য জায়গায়। মাঝেমধ্যে ঠিক করতে গিয়ে একেবারে নষ্টই করে ফেলতেন। এক্ষেত্রে তাকে জরিমানা গুনতে হতো। দেখা গেলো, যে লাইটটি ঠিক করে ২০-৩০ টাকা পাওয়া যেতো সেটি করতে না পেরে তাকে জরিমানা গুনতে হয়েছে তার দ্বিগুণ। ব্যাপারটি বেশ যন্ত্রণাদায়ক ছিল তার জন্য। তবে যে ভুলটি হতো পরে আর সেটি করতেন না। এভাবে হাত বেশ ভালোভাবেই পাকা হয় তার। আশেপাশের অন্য দশ দোকানদারেরও একই কথা।
তবে এক্ষেত্রে চিন্টু বেশ বিনয়ী। তার ভাষ্যে, 'মামা আগে তো কম ভুল করি নাই। শিখতে শিখতেই আইজগের অবস্থা। শুরুর দিকে কত ভুল করসি তার হিসাব আছে?'
এই ব্যবসায় আছেন ১০-১৫ জন
চিন্টু ছাড়াও এই কাজে পুরোদমে নেমেছেন মো. রাকিব এবং মো. শাহেদ মির্জা। তারা ছাড়াও এই ব্যবসায় জড়িত আছেন আরও ১০-১৫ জন। তবে তাদের এলাকা আবার আলাদা।
সদরঘাটে বেশ পুরোনো পেশা এটি। তাদের সবাই একই কাজে যুক্ত। মজুরিরও হেরফের নেই। সবাই প্রায় একই পরিমাণ টাকা নিয়ে থাকেন। যেমন– একটা বাটন ফোন ঠিক করে দিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে নেন ৭০-৮০ টাকা। ঘড়ি ঠিক করিয়ে নিতে পারবেন ৫০-৬০ টাকায়। ঘরের লাইট ঠিক করানো যাবে ২০-৩০ টাকায়। আবার টিভির রিমোট বা এসির রিমোট ঠিক করাতে তারা নেন ৫০ টাকা। একইভাবে মাল্টিপ্ল্যাগ কিংবা ফোনের চার্জার ঠিক করাতেও নেন ৩০-৮০ টাকা।
তাছাড়া, এই দাম ওঠানামা করে ২০-৮০ টাকার মধ্যে। তবে মাঝেমধ্যে ১০০ টাকাও হয়। যদিও তা খুবই ব্যতিক্রম। অর্থাৎ, আপনি যদি ১০০ টাকা বাজেট করেন, তবে উল্লিখিত যেকোনো পুরাতন যন্ত্রপাতি যেমন– লাইট, হেডফোন, খেলনা, ইলেকট্রিক স্ট্রেইটনার, রাউটার, বাটন ফোন, চার্জার, ক্যাবল ঠিক করিয়ে নিতে পারবেন।
এসব যন্ত্রপাতি ঠিক করতে যেসব জিনিসপত্র লাগে চিন্টুরা সেসব নিয়ে আসেন পাটুয়াটুলী থেকে। কম দামে পাওয়া যায় বলেই সেখান থেকে কিনে নেন তারা। "ওখান থেকে যে দামে কিনি তার চেয়ে ২০-৩০ টাকা লাভ হয় আমাদের," বললেন চিন্টু।
কেমন লাভজনক এটি? জানতে চাইলে মো. রাকিব বলেন, "লাভ না হইলে তো এই ব্যবসা করি না। দিনে আমি ৪০০-৫০০ টাকাও পাই, আবার মাঝেমধ্যে ১,০০০ টাকাও হয়। আগে আমি চায়ের দোকানদারী করতাম। এত পাইতাম না। অইডার চাইতে এইটা ভালা। কম-বেশি লাভ আছেই।"
রাকিব এই ব্যবসায় নেমেছেন পাঁচ-ছয় বছর হলো। বয়সও বেশি নয়। ৩০ বা ৩৫ হবে। এরমধ্যে বেশ ভালোভাবে বুঝেও গেছেন কোন জিনিসের চাহিদা বেশি। সেগুলোই বেশি কেনেন ভাঙ্গারীদের কাছ থেকে। "আমি সবসময় মাল বাইছ্যা লই," বলেন রাকিব।
তবে রাকিব আবার চিন্টুর মতো নিজে ঠিক করেন না। তার ধরণ কিছুটা আলাদা। "আমি শুধু বিক্রি করি। ঠিক করি না। আমার কাছে যেসব মালামাল আসে সেগুলো মিস্ত্রির কাছ থেইকা ঠিক কইরা নিয়ে আসি। ধরেন, আপনি আমারে নষ্ট কিছু দিলেন, আমি সেটা আপনারে কম ট্যাহায় ঠিক কইরা দেব। এইডার জন্য আমার মিস্ত্রি আছে," বললেন রাকিব।
রাকিবের ভাষ্যে তাদের প্রায় সবাই এভাবেই কাজ করেন। চিন্টুর মতো কম লোকই আছে যারা একই সাথে এসব পুরাতন জিনিস বিক্রি করা এবং মিস্ত্রির কাজ– দুটোই করেন।
কথাপ্রসঙ্গে রাকিব জানালেন, অনেক ক্রেতা এমনও আছেন, যারা সাজিয়ে রাখা পুরাতন জিনিস থেকে মেরামত করা হয়নি এমন পণ্য কিনে তারপর ঠিক করিয়ে নেন।
চিন্টুর মতোই ৩০ বছর আগে ঢাকায় আসেন মো. শাহেদ মির্জা। বাড়ি লক্ষীপুর। এই কাজে তার অভিজ্ঞতা ১০-১৫ বছরের। অনেক আগে থেকে টুকটাক এসব কাজ করতেন। তবে সদরঘাটের মোড়ে দোকান দিয়ে এই পেশায় স্থায়ী হয়েছেন বছর দুয়েক আগে।
কিছু জিনিস শাহেদ ঠিক করতে পারেন। আবার কিছু পারেন না। যেগুলো পারেন না সেসবের জন্য দ্বারস্থ হন অভিজ্ঞ কারো কাছে। তারপর মানুষের কাছে সেসব বিক্রি করেন। শাহেদের কাছে রাউটারের বিশাল ভাণ্ডার। পুরাতন এসব রাউটার ভাঙ্গারীদের কাছ থেকেই কেনা। এগুলো তিনি ঠিক করে আবার ব্যবহার উপযোগী করে তোলেন। একটা রাউটারে শাহেদ লাভ করেন ১০০-১৫০। অর্থাৎ, তারা কিনে আনেন ৪০-৫০ টাকায়।
শাহেদের দোকানেই এক ক্রেতাকে দেখা গেলো ফোনের ক্যাবল কিনতে এসেছেন। কথা হয় তার সাথে। জিজ্ঞেস করলাম, পুরাতন জিনিস কিনতে ভয় লাগে না? যদি নষ্ট হয়ে যায় আবার?
"আমি প্রায়ই এখান থেকে চার্জার, হেডফোন কিনে নিয়ে যাই। দাম তো বেশি না। হেডফোন ৩০-৪০, ক্যাবল ৮০-১০০ টাকা। অনেকদিন যায়। নষ্ট হয়ে গেলে আবার কিনে নিই। আমাদের মতো ছাত্রদের জন্য এই দোকানগুলো বেশ ভালো। কারণ পকেটের অবস্থা অনুযায়ী জিনিস কিনতে পারি," বললেন তিনি।
শাহেদেরও একই ভাষ্য। তিনি বলেন, "স্টুডেন্ট ক্রেতাই বেশি আসেন এইখানে। আবার ধরেন, যাদের বেশি টাকা দিয়ে কেনার সামর্থ্য নাই তারাও আসে। এই যে রিমোটগুলা দেখতাসেন, মনে করেন সবাই তো স্মার্ট টিভি চালাইতে পারে না। আবার অনেকের তো স্মার্ট টিভিও নাই। গরিবরা যেমন ২০-৩০-৪০ টাকায় এখান থেইকা রিমোট কিইন্যা নিয়া যায়।"
মূলত খুব অল্প দামে, সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক জিনিস কিনতে আর পুরাতনগুলো সহজে ঠিক করিয়ে নিতে পারার কারণেই চিন্টু-শাহেদ-রাকিবদের দোকানে ভিড় থাকে সাধারণ মানুষের। যেমনটা চিন্টু জানালেন, "এত কমে কোনোহানে কিছু দেয় কিনা জানিনা।"
ছবি: জুনায়েত রাসেল/দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড