মাওলানা বকরই কি উপমহাদেশের প্রথম শহিদ সাংবাদিক?
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার অনেক বীরের ব্যাপারে আমরা জানি। সমাজের সর্বস্তর থেকে উঠে এসেছিলেন তারা। নির্ভীক চিত্তে দাঁড়িয়ে গেছেন সশস্ত্র ব্রিটিশ বাহিনীর সামনে। তবে এই বিদ্রোহের অনেক বীরের নামই হারিয়ে গেছে লিখিত ইতিহাস থেকে। মাওলানা মোহাম্মদ বকর সেই হারিয়ে যাওয়া বীরদের একজন। তিনি ছিলেন দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া উপমহাদেশের প্রথম সাংবাদিক।
মাওলানা বকর ছিলেন উর্দু সাপ্তাহিক 'দিল্লি উর্দু আখবার'-এর সম্পাদক। ধারণা করা হয়, এটিই দিল্লির প্রথম উর্দু সংবাদপত্র। ব্রিটিশদের অত্যাচার-নিপীড়নের তীব্র সমালোচনায় সর্বক্ষণই সরব থাকত 'দিল্লি উর্দু আখবার'। আর ব্রিটিশ অনাচারের বিরুদ্ধে রীতিমতো আগুন ঝরাত পত্রিকাটির সম্পাদক মাওলানা বকরের কলম।
'দিল্লি উর্দু আখবার' প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৩৬ সালে। তবে ১৮৫৭ সালের জুলাইয়ে সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েন মাওলানা বকর। এই করতে গিয়ে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তিনি। ঘনিষ্ঠতা এতই বাড়ে যে, মাওলানা বকর তার পত্রিকার নাম বদলে রাখেন 'আখবার আল জাফর'।
১৮৫৭ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহ পর্যন্ত দিল্লির দখল থাকে বিদ্রোহী সিপাহিদের হাতে। বিদ্রোহ দমনের পর ১৮৫৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশদের হাতে গ্রেপ্তার হন মাওলানা বকর। এর কদিন পরই তাকে দিল্লি গেটের বাইরে কামানের মুখে বেঁধে গোলার বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় ব্রিটিশ সৈন্যরা। এই ঘটনার অনেক বছর পর রুশ শিল্পী ভাসিলি ভেরেশচ্যাগিনের ছবিতে একজন বয়স্ক মাওলানাকে কামানের সঙ্গে গোলায় উড়িয়ে দেওয়ার পূর্বমুহূর্তের ছবি আঁকেন। এই বয়স্ক ব্যক্তিকে মাওলানা বকর বলেই ধারণা করা হয়।
তবে অনেক ইতিহাসবিদই দাবি করেছেন, মাওলানা বকরকে কামানের গোলায় উড়িয়ে দেওয়া হয়নি। তাদের দাবি, ১৬ সেপ্টেম্বর মেজর উইলিয়াম হাডসন তাকে গুলি করে হত্যা করেন।
তবে যেভাবেই হত্যা করা হোক না কেন, মাওলানা বকর যে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া উপমহাদেশের প্রথম সাংবাদিক তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রথম জীবন ও পড়াশোনা
মাওলানা বকরের জন্ম ১৭৯০ সালে। তার পড়াশোনার শুরু বাড়িতে বাবা মাওলানা মুহাম্মদ আকবরের কাছে। মাওলানা আকবর ছিলেন ওই সময়ের প্রখ্যাত শিয়া পণ্ডিত। বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকানোর পর ১৮২৫ সালে মাওলানা বকর দিল্লি কলেজে (পরবর্তীতে অ্যাংলো-অ্যারাবিক স্কুল) ভর্তি হন। সেখানেই তিনি ইংরেজি শেখেন।
বাড়ি ও দিল্লি কলেজে পাওয়া শিক্ষার সুবাদে মাওলানা বকর ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এই শিক্ষার কল্যাণে তার মধ্যে সব মানুষকে সমান চোখে দেখার মতাদর্শ গড়ে ওঠে। মাওলানা বকর একাধারে আরবি, ফার্সি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় পারঙ্গম ছিলেন।
ব্রিটিশদের চাকুরি
পড়াশোনা শেষ করে মাওলানা বকর দিল্লি কলেজেই ফার্সি শেখানোর কাজ নেন। তবে পরে, ১৮৩০-এর দশকে, তিনি চার্লস মেটক্ল্যাফের অধীনে ব্রিটিশ রাজস্ব বিভাগে যোগ দেন। কিন্তু লেখালেখির প্রতি গভীর অনুরাগের জন্য ওই চাকরিতে মন বসাতে পারেননি। এ কারণে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৮৩৬ একটি লিথোগ্রাফিক প্রেস কিনে নেন।
পত্রিকার জন্ম
১৮৩৬ সালে দিল্লির প্রথম উর্দু সংবাদপত্র প্রকাশ করেন মাওলানা বকর। পত্রিকাটির নাম দেন 'দিল্লি উর্দু আখবার'। এর আগে দিল্লিতে প্রকাশিত সমস্ত পত্রিকাই ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত হতো। ভারতের প্রথম উর্দু পত্রিকা 'জাম-ই-জাহান নুমা', যা ১৮২২ সালের ২৭ মার্চ কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়।
পত্রিকার যাত্রা
জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আজিজউদ্দিন হুসেইন লিখেছেন, মাওলানা বকর ১৮৫৭ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্রিটিশ অরাজকতার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা চালান তার পত্রিকার মাধ্যমে।
বকরের লেখায় ১৮৫৭ সালের শাহজানাবাদ ও তৎসংলগ্ন লক্ষ্ণৌ, আগ্রা, কোল, বুলন্দ, শহর, আম্বালা, গোয়ালিয়র, ঝাঁসি সম্পর্কে বিস্তর তথ্য জানা যায়।
১৮৫৭ সালের মে মাসে আগে খবরের মূল উৎস ছিল সরকারি গেজেট, অন্যান্য পত্রপত্রিকা ও বিনাবেতনের লেখকরা।
মাওলানা বকর ছিলেন বিখ্যাত কবি ইব্রাহিম জওক-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইব্রাহিম জওক ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারের সভাকবি। মাওলানার পত্রিকায় 'হুজুর-এ-ওয়ালা' কলামে সম্রাটের দরবারের খবর ছাপা হতো। আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খবর ছাপা হতো 'সাহি-এ-কালান-বাহাদুর' কলামে।
খবর সংগ্রহের জন্য মাওলানা বকর দিল্লিসহ অন্যান্য বড় শহরে সংবাদদাতা নিয়োগ করেন। এই সংবাদদাতাদের নাম ছিল ওয়াকা-এ-নিগার।
যে আমলে ভারতে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্মই হয়নি, সে সময়ই সাধারণ জনগণের দাবিদাওয়া তুলে ধরা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে গেছে 'দিল্লি উর্দু আখবার'। এবং সে কাজে সফলও হয়েছে অনেকাংশে।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৮৪৭ সালে গ্যাগিং অ্যাক্ট নামে এক আইন চালু করে। এ আইনের উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। আর ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল উর্দু ও ফারসি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো। কেননা এ দুটি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলোই কেবল ভারতে ব্রিটিশদের অন্যায় নীতি ও জুলুম-অত্যাচারের সমালোচনা করত।
কোম্পানি সরকারের ১৮৫৩ সালের এক প্রতিবেদনে 'দিল্লি উর্দু আখবার'কে বলা হয়েছে 'অসংযত ও বিরক্তিকর' পত্রিকা।
বিদ্রোহী সৈনিকদের অভ্যর্থনায় আখবার
বিদ্রোহের সূচনা হয় ১০ মে। এর পরদিন বিদ্রোহী সৈনিকরা দিল্লি পৌঁছে বাহাদুর শাহকে নিজেদের নেতা ঘোষণা করে। মাওলানা বকরের পত্রিকা বিদ্রোহী সৈনিকদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৈনিকদের মনোবল জোরদার করার জন্য কাজ করতে থাকে 'দিল্লি উর্দু আখবার'।
পত্রিকাটির ২৪ মে ১৮৫৭ সংখ্যার এক লেখায় বলা হয়, সম্রাট সলোমন, আলেকজান্ডার, চেঙ্গিজ খান, নাদির শাহদের মতো পরাক্রমশালী শাসকরা যেভাবে হারিয়ে গেছে, ঠিক সেভাবেই ইতিহাসের বুক থেকে মুছে যাবে ব্রিটিশরাও। এ ধরনের উদ্দীপক নিবন্ধ ও কাহিনি বিদ্রোহী সৈনিকদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস চাঙা করে তোলে। সিপাহিদের মনে বিশ্বাস জন্মায়, ব্রিটিশদের হারাতে পারবে তারা।
ওই সময়ের আরেকটি অত্যাবশ্যকীয় দাবি পূরণেও কাজ করে 'দিল্লি উর্দু আখবার'। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য নিরলস কাজ করে পত্রিকাটি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে হিন্দু, মুসলিম, ব্রাহ্মণ, শূদ্র সবাই একসঙ্গে রুখে দাঁড়াতে পারে, মাওলানা বকরের পত্রিকা এই বিশ্বাস প্রচার করেছিল।
পত্রিকার নাম বদল
দিল্লির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিদ্রোহ যখন তুঙ্গে, মাওলানা বকর তখন তার পত্রিকার নাম বদলে রাখেন 'আখবার-উজ-জাফর'। দিল্লির পতন ও মাওলানাকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত সংবাদপত্রটির আরও ১০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সে সময় এর মাসিক চাঁদার হার ছিল দুই রুপি, ছয় মাসের জন্য ১১ রুপি এবং এক বছরের জন্য ২০ রুপি।
ওই সময় ব্রিটিশরা নানা অপপ্রচার চালিয়ে পত্রিকাটির সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। সেইসঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রীতিতে চিড় ধরানোর জন্য চালিয়ে যেতে থাকে নানা প্রোপাগান্ডা।
বিদ্রোহ জমে উঠেছে, সে সময় ব্রিটিশরা পত্রিকাটির সঙ্গে আলাদা কাগজে একটা করে বিজ্ঞাপন ঢুকিয়ে দিতে থাকে। ওই বিজ্ঞাপনে হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয় মুসলমানদের। বিজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, মুসলিম শরিয়া অনুসারে খ্রিষ্টানরা মুসলিমদের বন্ধু।
দিল্লির পতন ও মাওলানার মৃত্যুদণ্ড
চার মাস দিল্লি দুর্গের দখল ধরে রাখে বিদ্রোহীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখে ব্রিটিশরা দিল্লিতে প্রবেশ করতে পারে। ওই দিনই ব্রিটিশ সৈনিকদের হাতে গ্রেপ্তার হন মাওলানা বকর। তারপর ব্রিটিশরা কামানের সঙ্গে বেঁধে উড়িয়ে দেয় তাকে।
মাওলানা আবু বকর উপমহাদেশের সাংবাদিকতাকে দিয়ে গেছেন মজবুত বুনিয়াদ। আজীবন তিনি ব্রিটিশদের অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে এবং জনগণের অধিকার ও বাক-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে গেছেন। ব্রিটিশদের কূটচালে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিমদের সম্প্রীতিতে যখন চিড় ধরেছিল, সে সময় মাওলানা বকর তার সংবাদপত্রের মাধ্যমে দুই সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে চেষ্টা করেন। সংগ্রামী সাংবাদিক-জীবনে লড়াকু এই সম্পাদক ধর্মনিরপেক্ষতা ও সম্প্রীতির জন্য যেভাবে কাজ করে গেছেন, বর্তমান সময়েও তা অনুপ্রেরণাদায়ক।
- সূত্র: ইন্ডিয়াটাইমস ডটকম