যুদ্ধদিনের প্রেম সহজে হারবার নয়
সেলিনা রহমান প্রত্যেক বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে ঝালকাঠিতে তার মুক্তিযোদ্ধা স্বামীকে শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকা থেকে ঝালকাঠি আসেন।
সেলিনা রহমান নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এবং তার স্বামী হাজার ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছেন। তারা যেমন যুদ্ধ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, তেমিনি তাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজেদের জীবনের জন্য, ভালোবাসার জন্য।
আজকের সেলিনা রহমান ১৯৭১ সালে ছিলেন শিখা রানী দত্ত। শিখা রানী আর বজলু রহমান ছিলেন সহপাঠি। ঝালকাঠি কলেজে পড়তেন তারা। বজলু তখন থেকেই শিখার প্রতি দুর্বল ছিলেন। প্রেম নিবেদনের চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। কিন্তু সফল হননি তিনি। চেনা-জানাতেই আটকে ছিল সব। এরমধ্যে এলো ১৯৭১। দেশের জন্য যুদ্ধের ডাক শুনলেন দুজনেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ছাত্রনেতা শাহনেওয়াজ শিখাকেও উৎসাহী করে তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। প্রথমে ঝালকাঠি খেলার মাঠে, তারপর ঝালকাঠি বালিকা বিদ্যালয়ে অন্যদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন শিখা। আরও পরে পাক বাহিনী ঝালকাঠি শহরে স্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তুললে ঝালকাঠির প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধারা পেয়ারা বাগানে গিয়ে আশ্রয় নেন। বজলুও বাদ পড়েননি সেখানে। তিনিও প্রশিক্ষণ নিয়ে পেয়ারাবাগানেই অবস্থান করছিলেন। তবে দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছিল না।
এলো জুন মাস
পেয়ারা বাগানের সব যোদ্ধা দল এবং আশপাশের আরও কয়েকটি দল রণনীতি ও কৌশল ঠিক করতে প্রতি দশ দিন পর পর পেয়ারা বাগানে মিলিত হতে থাকল একাত্তরের জুনে। ওইসব সভাতেই শিখা আর বজুলর আবার দেখা। এরপর থেকে নিয়মিতই দেখা হতো। সহযোদ্ধাদের মধ্যে তাঁদের প্রেমের খবর ছড়িয়ে পড়ল। যোদ্ধারা সকলেই উৎসাহী- দেশকে যেমন মুক্ত করতে হবে, পরিণতি দিতে হবে এই প্রেমকেও।
তবে, কাজটি সহজ ছিল না; কারণ শিখা ও বজলু দুই ধর্মের মানুষ। কিন্তু যোদ্ধারা ভাবেছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে এসব সমস্যা থাকবে না আর। তাই তারা উৎসাহ দিচ্ছিলেন শিখা ও বজলু দুজনকেই। এরপর বজলু আর শিখার দল যৌথ অপারেশনেও গিয়েছিল। শিখা বোমা ছুড়ে মারায় ছিলেন পারদর্শী। যুদ্ধের মধ্যেই তাদের প্রেম আরো নিবিড় হয়ে ওঠে।
সেলিনা বলছিলেন, 'প্রত্যেক সভার শেষে আমরা যখন একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিতাম, মনে হতো এটাই শেষ দেখা। হয়তো আর দেখা হবে না। তখন সময়টা বসেছিল মৃত্যুর দুয়ারে।'
শিখার সহযোদ্ধারা স্বপ্ন দেখতেন কখন দেশ স্বাধীন হবে আর ওই দুই যোদ্ধাকে চিরস্থায়ী বাঁধনে বাঁধবেন। আশায় দিন গুনতেন শিখা আর বজলুও।
সেলিনা বলেন, 'পেয়ারা বাগানে আমার দুজনেই সহযোদ্ধাদের সাক্ষী রেখে কথা দিয়েছিলাম, যদি যুদ্ধ শেষে আমরা বেঁচে থাকি, যদি দেশকে হানাদার মুক্ত করতে পারি তবে আমরা একে অন্যকে বিয়ে করব।'
দেশ স্বাধীন হলো
'নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। সবাই ফিরল নিজ নিজ বাড়িতে। আমাদের শহর ঝালাকাঠিতে আমি আর বজলুও ফিরলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে যোগাযোগ হচ্ছিল খুবই কম,' যোগ করেন সেলিনা।
যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার অল্প কিছুদিন পরই মারা যান শিখার মা। শিখা ছিল ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। তাই সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। ওদিকে মায়ের মৃত্যুতে বাবাও ছিলেন কাতর। তাই তাঁর শুশ্রূষার ভারও নিতে হলো। শিখা সিদ্ধান্ত নিলেন, ছোট ভাই-বোনগুলো বড় না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিয়ে করবেন না।
তবে বজলুর আগ্রহে একসময় কোর্টেও গিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্ম আলাদা হওয়ায় কোর্ট থেকে নিরাশ হয়েই ফিরলেন তিনি। এর মধ্যে শিখার বাসায় জানাজানি হয়ে গেলো, তিনি একটি মুসলমান ছেলেকে পছন্দ করেন। কারণ শিখা পরিবারের আনা কোনো পাত্রকেই বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিলেন না। তাই শিখার বাবা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করে। পীড়াপীড়ি মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে শিখা ১৯৭৪ সালে বরিশালের বাবুগঞ্জে গিয়ে মাধবপাশা নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় বজলুর সঙ্গে তার যোগাযোগ তুলনামূলক সহজ হয়।
চাকরিতে কেটে যায় প্রায় দুই বছর। এদিকে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে শিখার বাবা সিদ্ধান্ত নেন, বজলুর বিরুদ্ধে মামলা করার। ঝালকাঠি থানায় যে মামলা তিনি দায়ের করেন তাতে বলেন, বজলু নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। মামলা গ্রহণ করে পুলিশ বজলুকে খুঁজতে বের হয়।
বজলু চলে আসেন শিখার বিদ্যালয়ে। শিখা সব ঘটনা শুনে বজলুকে নিয়ে বরিশাল থেকে রওনা হন ঝালকাঠি। তারা ঝালকাঠি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই বাসস্ট্যান্ড থেকে পুলিশ তাদের ধরে থানায় নিয়ে যায়। বজলুকে রাখা হয় হাজতে আর শিখাকে সারাদিন থানার মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়। শিখার বাবা আত্মীয়-স্বজন নিয়ে থানায় আসেন, কিন্তু শিখার সঙ্গে তারা একটুও ভালো ব্যবহার করেননি। উল্টো আরেকটি মামলা দায়ের করেন শিখা ও বজলুর বিরুদ্ধে।
অবশেষে এলো বিজয়
দুজনকেই পরদিন সকালে কোর্টে চালান করে দেয় পুলিশ। তাদের দুজনকেই কোর্ট পাঠিয়ে দেয় জেলে। শিখা মহিলা জেলে আর বজলু পুরুষ জেলে থাকতে শুরু করেন। ২১ দিনে তিনবার তাদের জামিন শুনানি হয়, কিন্তু তারা জামিন পাননি। শেষে ২৮ দিনের মাথায় চতুর্থবারের শুনানিতে ঝালকাঠির প্রায় সব আইনজীবী শিখা ও বজলুর পক্ষে অবস্থান নেন। ফলে তাদের জামিন মঞ্জুর হয়। ওইদিনই আদালতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। শিখার নতুন নাম হয় সেলিনা রহমান। খবর পেয়ে তাদের সহযোদ্ধাদের অনেকেই উপস্থিত হয়েছিল আদালত চত্বরে। সেদিন তারা মেতেছিলেন নতুন বিজয়ের আনন্দে।
'বজলু-শিখার ভালোবাসা জয়ী হলে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আরেকটা যুদ্ধ জয়ের আনন্দ পেয়েছিলাম,' বলেন ঝালকাঠির মুক্তিযোদ্ধা জেলা কমান্ড্যান্টের কমান্ডার দুলাল সাহা।
তিনি আরও বলেন, 'কতটা ভালোবাসা থাকলে এত কষ্ট সওয়া যায়, ওরা প্রেমের নতুন গীত রচনা করেছে। আসলে যুদ্ধদিনের প্রেম সহজে হারবার নয়।'
এখনো সেলিনা সময় পেলে পেয়ারা বাগান ঘুরতে যান আর হারান যুদ্ধের সেই স্মৃতিময় দিনগুলোতে। একসময় সেলিনা শিক্ষকতা ছেড়ে যোগ দেন সোনালী ব্যাংকে। সেখান থেকে ২০১২ সালে অবসর নিয়েছেন তিনি।