ডাচরা কেন এত লম্বা
রটারডামের বন্দরে যাওয়ার পথ লাল ইটে বাঁধানো। পথে পড়বে সার বেধে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো বাড়ি, স্বচ্ছ জলের খাল আর সাবেকি ধাঁচের সুরিনামি রেস্তরাঁ। চোখ কাড়বে গরুর পাল, ঘাস চিবুচ্ছে। বন্দরে দাঁড়াতেই সমুদ্রের বাতাস এসে গা জুড়িয়ে দেবে। ক্রেনে মাল উঠছে আর নামছে, না চাইলেও সেটি আপনার চোখে পড়বে। গরুর পাল কিন্তু এখানেও আরামে চড়ে বেড়াতে দেখবেন। রটারডামের ভাসমান খামার যেটি বিশ্বে প্রথম বলেই ধরা হয়, এমনভাবে গড়া হয়েছে যেন সমুদ্রের পানির হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে এখানে গরুর পানীয় জলের প্রয়োজন মেটানো হয়। চালু হওয়ার পর থেকেই খামারটি অনেক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে প্রতিদিন। সাগর পাড়ি দেওয়া ও গবাদিপশু পালন ডাচদের ঐতিহ্য।
ল্যান্ড অব জায়ান্টস
নেদারল্যান্ডসকে অনেকে 'ল্যান্ড অব জায়ান্টস' বলতে ভালোবাসে। কারণ ডাচ পুরুষদের গড় উচ্চতা ১৮২.৫ সেন্টিমিটার মানে ৬ ফুটের সামান্য কম। ওদিকে নারীদের উচ্চতা ১৬৮.৭ সেমি। সবসময় কিন্তু ডাচরা এতটা দীর্ঘকায় ছিল না। ডাচ মিলিটারি রেকর্ডস ঘেঁটে রয়্যাল সোসাইটি অব লন্ডন খবর দিচ্ছে, উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে ইউরোপের খাটো লোকদের মধ্যে ডাচদের নামও কম ছিল না। তারা বলছে, '১৮৬০ সালে ডাচ সেনাদের গড় উচ্চতা ছিল ১৬৫ সেমি। ওইসময় আমেরিকানরা তাদের চেয়ে ৫ সেমির মতো বেশি লম্বা ছিল।'
তারপর কেটে গেছে ১৬০ বছর। এই সময়ে প্রায় ২০ সেমি বেড়েছে ডাচদের গড় উচ্চতা। অথচ তুলনায় আমেরিকানদের উচ্চতা বেড়েছে মাত্রই ৬ সেমি। কানাডার লেথব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুই ব্যারেট বলছেন, 'জেনেটিক প্রভাবকে নিয়ামক ধরলে এটা বেশি দ্রুত বলতে হয়। যদিও প্রকৃতির কিছু মারপ্যাঁচ আছেই। আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে নেদারল্যান্ডসের বিশ্বসেরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা। তারপর আছে আয়ের সাম্যের বিষয় এবং কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা। আমেরিকা এই সবগুলোতেই ডাচদের থেকে পিছিয়ে। আমার অনেকবার মনে হয়েছে, নেদারল্যান্ডসে সবকিছুই ধাবিত হয় সুন্দর সন্তান জন্মদানের বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখে। তারপর ডাচদের খাদ্যাভ্যাসের কথাও এসে পড়ছে। ডাচরা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারের বিরাট ভোক্তা আর গবেষণাও বলছে এটা তাদের উচ্চতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। সবারই জানা ক্যালসিয়াম হাড় গড়ে এবং হাড়ের বৃদ্ধি দুগ্ধপণ্যের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।'
'হোয়াই দ্য ডাচ আর ডিফারেন্ট: আ জার্নি ইনটু দ্য হিডেন হার্ট অব দ্য নেদারল্যান্ডস' গ্রন্থের লেখক বেন কোটস বলছেন, দুধের প্রতি ডাচদের ভালোবাসা দেশটির চিত্রই বদলে দিয়েছে। তাইতো বলা হয়ে থাকে, বিশ্ব গড়েছেন বিধাতা তবে নেদারল্যান্ডস গড়েছে ডাচরা। গোটা দেশটাই বলতে গেলে জলাভূমি; ডাচরা শত শত বছর সমুদ্র স্রোতের সঙ্গে লড়েছে, জলসেচের জন্য গড়েছে উইন্ডমিল এবং খুঁড়েছে খাল। বিশ শতকের গোড়ায় ডাচরা জুইডারজি ওয়ার্কস নামে একটি প্রকৌশল প্রকল্প হাতে নেয়। খাল, বাঁধ আর নালা নিয়ে এ প্রকল্প এত বড় এবং এত দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে যে, যারা শুরু করেছিল তাদের প্রায় কেউই এর ফলাফল দেখে যেতে পারেনি। শেষে এটি সমাপ্ত হয় ১৯৯৭ সালে।
'পনির উপত্যকা' হিসেবে পরিচিত উয়েরডেন শহরের অবসরপ্রাপ্ত পনির বিজ্ঞানী মেউয়িস হেটিঙ্গা। তিনি বলেন, 'আমাদের এখানকার জমি শাকসবজি আর শস্যের জন্য একটুও ভালো ছিল না তবে ঘাস জন্মাত প্রচুর। আমাদের হোলস্টাইন-ফ্রিজিয়ান গরুর দিকে তাকিয়ে দেখুন, ভালো লাগে দেখতে। এতো মাংসল আর দুধেল গরু পৃথিবীতে আপনি কম পাবেন। পতিত জমি আমরা আবাদ করেছি। কতটা কষ্ট করতে হয়েছে ভাবুন দেখি। এখন তাই ফলও পাচ্ছি ভালো।'
আরো যারা দীর্ঘকায়
এগিয়ে আছে ইরানি ও কোরিয়ানরা। ইলাইফ জার্নাল ১৮৭টি দেশে গবেষণা চালাচ্ছিল ১৯১৪ সাল থেকে।
তারা জানিয়েছে, ইরানী পুরুষদের গড় উচ্চতা বেড়েছে ১৬ সেমি আর কোরিয়ান নারীদের বেড়েছে ২০ সেমি। জাপান, চীনের লোকদেরও উচ্চতা বাড়ছে। ১০০ বছর আগের সময়ের তুলনায় এখন তারা অনেকটাই দীর্ঘকায়। অপরদিকে আমেরিকান পুরুষ ১৯১৪ সালেও উচ্চতার দিক থেকে বিশ্বে ছিল তৃতীয় অবস্থানে। আজকে তারা নেমে গেছে ৩৭তম স্থানে।
এখন ইউরোপই হাইট চার্টে ওপরের দিকে। সাব-সাহারান দেশ যেমন উগান্ডা, সিয়েরা লিয়নও তালিকায় পিছিয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, জিন এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক নয়। তাদের মতে, এ পরিবর্তন প্রকৃতিগত নয় বরং পরিবেশগত। ভালো স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা আর পুষ্টিই এখানে ভূমিকা রাখছে বেশি। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের স্বাস্থ্য আর পুষ্টির ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ।
দীর্ঘকায় মানুষের দেশের তালিকায় নেদারল্যান্ডসের পরে আছে বেলজিয়াম, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, ডেনমার্ক, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, আইসল্যান্ড ও চেক রিপাবলিক।
লম্বা নারীর তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে লাটভিয়া। তারপর নেদারল্যান্ডস, এস্তোনিয়া, চেক রিপাবলিক, সার্বিয়া, স্লোভাকিয়া, ডেনমার্ক, লিথুয়ানিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেন।
- সূত্র- বিবিসি