নারী হওয়ায় যখন আপনাকে বস হিসেবে ভাবতে পারে না কেউ
ব্যবসায়িক মিটিংয়ে অদ্রিতাকে সবসময়ই একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। মিটিংয়ে একা প্রবেশ করলে রুম ভর্তি মানুষের প্রথম প্রশ্ন হয়, "বস কখন আসছেন?", কিংবা "বসের কি লেট হবে?"
যে কাল্পনিক বসের জন্য তারা অপেক্ষা করছেন, তিনি আর কেউ নন, অদ্রিতা নিজেই।
ক্লায়েন্টরা ধরেই নেন, অদ্রিতা কারো সহকারী বা অন্য কিছু। নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় একজন নারীকে কল্পনাই করতে পারেন না তারা।
"আলোচনার টেবিলের আপনি মুখ খোলার আগেই যদি অন্য লোকজন আপনাকে ছোট করে দেখা শুরু করে, এবং সরাসরি সেটা বলেও বসে, এরচেয়ে হতাশাজনক আর কিছু হতে পারে না," বলেন অদ্রিতা।
অদ্রিতার এই হতাশা নতুন না। উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত নারীরা প্রতিনিয়তই এরকম নিগ্রহের মধ্য দিয়ে যান।
গতানুগতিক পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় কর্মক্ষেত্রে এক ধরণের লিঙ্গগত পক্ষপাত দেখা যায়, যার কারণে মানুষ সাধারণত ধরে নেয় নারীদের পেশা ও পদবি হবে পুরুষদের নিচে। মানুষ ধরে নেয় সেক্রেটারি, প্রশাসনিক সহকারী, নার্স, স্ত্রী, গার্লফ্রেন্ড; এসব ভূমিকাতেই শুধু দেখা যাবে নারীকে। আর সিইও, অধ্যাপক, আইনজীবী, ডাক্তার বা প্রকৌশলীর মতো পেশাগুলো বরাদ্দ থাকবে পুরুষদের জন্য।
এরকম পুরুষ শাসিত পদগুলোতে অধিষ্ঠিত নারীদের প্রতিনিয়তই কটু কথা শুনতে হয়- 'আপনাকে দেখলে তো ইঞ্জিনিয়ার মনে হয় না', 'আপনি ডাক্তার না নার্স?'
এক্ষেত্রে নিজের পদগত যোগ্যতা প্রমাণ করতে প্রায় সময় বাড়তি সময় ও শ্রম দিতে হয় নারীদের।
এ ধরণের বৈষম্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। নিজের আবেগ লুকিয়ে ও বাড়তি সময় এবং প্রচেষ্টা দিয়ে নিজপদে কর্তৃত্ব স্থাপন করতে না পারলে এক্ষেত্রে নারীদের ক্যারিয়ারই বিপদগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু নারীদের যদি কোনো নেতৃস্থানীয় পদ, প্রকৌশলী বা ডাক্তার হিসেবে দেখাই না হয়, তাহলে এসব পদে তাদের নিয়োগ পাওয়ার ও পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কমে যায়।
আর প্রতিষ্ঠানের ভিতরে এই মানসিকতা থাকলে তা লিঙ্গ বৈষম্য শুধু বাড়িয়েই যায়, যার ফলে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মশক্তির সুবিধাগুলো পায় না সে প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠান নেতৃস্থানীয় পদগুলোতে পুরুষদেরকেই শুধু কল্পনা করতে পারে, তারা নারীদের প্রজ্ঞা ও দৃষ্টিকোণ থেকে বঞ্চিত হয়, যা তাদের সাংগঠনিক কর্মক্ষমতাও কমিয়ে দেয়।
তবে এই বৈষম্য প্রতিরোধ ও সংশোধনের জন্য পদক্ষেপ নিতে পারেন সাংগঠনিক নেতৃবৃন্দ, কর্মক্ষেত্রের সহযোগী এবং নারী কর্মীরা।
এরকম কিছু পদক্ষেপ বাতলে দিয়েছে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের চিন্তাবিদরা-
নীতিমালা তৈরি করুন
প্রথমত, এই বৈষম্য দূর করতে সাংগঠনিক নেতারা কিছু সমতা ভিত্তিক নীতিমালা তৈরি করতে পারেন। যেমন:
- কর্মক্ষেত্রে যেসব জায়গায় কর্মীরা একে অপরকে নাও চিনতে পারেন, যেখানে কর্মীদের নাম এবং পদবি ভালোভাবে লেবেল করে দিতে পারেন।
- কোম্পানির ইমেইল সিস্টেমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি স্বাক্ষর ব্যবহার করতে পারেন যেখানে কর্মীর নাম ও পদবি পরিষ্কারভাবে লেখা থাকবে।
- যে কারো পদোন্নতির ক্ষেত্রে ইমেইলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সবাইকে তা জানিয়ে দিতে পারেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সকল মিটিংয়ে পদোন্নতি পাওয়া কর্মীকে তার নতুন পদবিসহ পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন।
- এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলতে পারেন যেখানে প্রত্যেকে তাদের নাম ও পদবি সম্বলিত আইডি ব্যাজ পরে কর্মক্ষেত্রে অবস্থান করবেন।
- ওয়েব কনফারেন্সে নামের সঙ্গে পদবি প্রদর্শন করা এবং শারীরিক অফিসে ডেস্ক এবং দরজার লেবেলের জন্য নাম-পদবিসহ নেমপ্লেট রাখা বাধ্যতামূলক করতে পারেন।
নিজেকে মিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুন
একজন বস বা সহকর্মী হিসেবে আপনার অফিসে নারী সহকর্মীদের পদবির উপর জোর দিন। নারী সহকর্মীদের কারো সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় তাদের পদের নামও বলুন। যেমন- "আমাদের প্রধান অপারেটিং অফিসার অদ্রিতা চৌধুরীর সঙ্গে পরিচিত হোন।"
যদি শুনতে পান আপনার সহকর্মীকে ভুলভাল পদে শনাক্ত করছে কেউ, তাহলে নিজে থেকে তা সংশোধন করিয়ে দিন- "অর্পা আসলে এই প্রকল্পের প্রধান স্থপতি হিসেবে কাজ করছেন।"
অন্যের ভুল ধরিয়ে দিতে শুরুতে বিব্রত বোধ করতে পারেন। কিন্তু থেমে যাবেন না। পরিচিতি পর্ব না হলে দোষ নিজের উপর চাপান- "সরি, আমাদের কোম্পানি প্রেসিডেন্ট সুস্মিতা সাহাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম আমি।"
নারী হিসেবে যদি প্রায়শই আপনাকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে এক কাজ করতে পারেন। আপনার একজন নারী সহকর্মীকে নিয়ে 'বাডি সিস্টেম' গড়ে তুলুন। কোনো মিটিংয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে পরিচয় করি দিন- "ইনি ড. রেশমিন, আমাদের বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির ডিন", "এবং ইনি ড. সেন, আমাদের রসায়ন বিভাগের চেয়ারপারসন।"
নিজের ভুল স্বীকার করুন
কারো পদবী নিয়ে যদি আপনি ভুল করে থাকেন, তাহলে সেটা ঠাট্টাচ্ছলে উড়িয়ে দিবেন না, বা উপেক্ষা করবেন না। ভুল স্বীকার করুন এবং নিজেকে সংশোধন করুন।
শুধু 'সরি' বলেই থেমে যাবেন না। পরবর্তীতে যেন এরকম ভুল না হয়, তাই সহকর্মীদের পদবী ও যোগ্যতা জানতে আগের চেয়ে দ্বিগুণ পরিশ্রম করুন।
মিটিং, কনফারেন্স কল, বা ইভেন্টের আগে আপনার হোমওয়ার্ক করুন। কে কে উপস্থিত হবে এবং তাদের পদবী ও অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নিন।
সক্রিয়ভাবে আপনার ভূমিকা চিহ্নিত করুন
নারী হিসেবে এরকম বৈষম্যের স্বীকার আপনি প্রায়ই হবেন। এক্ষেত্রে অন্য কারো জন্য অপেক্ষা না করে নিজের পরিচয় নিজেই দিন- "হ্যালো, আমি আপনার সার্জন, ডা. রিয়া", "হাই, আমি নাদিয়া রহমান, কোম্পানির চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার। আজকে আমি বর্তমান বাজেটের পরিমাণ ও আগামী বাজেটের অনুমান উপস্থাপন করব।"
যদি কেউ আপনাকে ভুল পদে চিহ্নিত করে, তাহলে তাকে ভদ্রভাবে সংশোধন করিয়ে দিন- "আসলে, আমি একজন আইনজীবী/চিকিৎসক/সভাপতি/পরিচালক।" এখানে হাস্যরস বা হালকা হিউমার সহায়ক হতে পারে- "আমি ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই পেশায় আছি, নিজের কাজে ভালো না হলে কী আর এতদিন থাকতাম!"
এধরণের বৈষম্য প্রায়শই অনিচ্ছাকৃতভাবে করে থাকে মানুষ। তাদেরকে সংশোধন করে দেওয়ার মাধ্যমে আপনি এই লিঙ্গ পক্ষপাত এবং ভুয়া অনুমানগুলো কমাতে সাহায্য করছেন।
পদবী নিয়ে মানুষের এই অবিশ্বাস মূলত একটি সিস্টেমিক সমস্যা, এবং উপরোক্ত সমাধানগুলো আপনার কাছে "বেশি বেশি" মনে হতে পারে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নিয়ম জারি ও পরিবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল আমরা ধীরে ধীরে এসব বৈষম্যমূলক মনোভাব এবং পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে পিছনে ফেলে লিঙ্গ সমতার দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
সূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ।