অটিজমের চিকিৎসায় গাঁজার ব্যবহার: 'আমার সন্তান ধীরে ধীরে সুস্থ-স্বাভাবিক হচ্ছে' এক মায়ের উক্তি
১৭ মাস বয়স পর্যন্ত আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতোই বেড়ে উঠছিল জোয়ান ফুকেটের সন্তান এজরা। কিন্তু হঠাত করেই এজরার মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখতে পান তার মা। শিশুটি কথা বলা কমিয়ে দেয়, কানে হাত দিয়ে চেপে ধরতো হঠাত, প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে নিজের মাথা ফ্লোরে বাড়ি দেওয়ার মতো সেলফ হার্মিং আচরণও দেখা যায়।
এর পাঁচ মাস পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে তারা জানতে পারেন এজরা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৪৪ জনে একজন শিশু এই নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হয়। জীবনের প্রাথমিক দিকেই এর উপসর্গগুলো দেখা দিতে থাকে। অটিজমের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য বাচনিক-অবাচনিক যোগাযোগ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একই কাজ বারবার করা বা বারবার একই কথা পুনরাবৃত্তির প্রবণতা দেখা যায়। তবে অটিজমের কারণে এরচেয়েও গুরুতর সমস্যা যেমন সেলফ হার্ম করার প্রবণতা দেখা যেতে পারে।
বিহেভিওর থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি ও স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে এর চিকিৎসা চলে। তবে অটিজমের প্রধান উপসর্গগুলো নিরাময়ে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) অনুমোদিত কোনো চিকিৎসা নেই। বাইপোলার ডিজঅর্ডার ও সিজোফ্রেনিয়া চিকিৎসার জন্য এফডিএ অনুমোদিত দুটি অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ আছে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে গুরুতর উপসর্গ দেখা গেলে বা সেলফ হার্ম করার প্রবণতা বেশি থাকলে এসব ওষুধ ব্যবহারের অনুমতি আছে।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক মন্টেফিওরে হেলথ সিস্টেমের অটিজম অ্যান্ড অবসেসিভ কমপালসিভ স্পেকট্রাম প্রোগ্রামের পরিচালক ডা. এরিক হলান্ডার সিএনএনকে জানান, এসব ওষুধ ওই উপসর্গগুলো প্রশমনে কাজ করলেও এসব ওষুধের গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই অটিজম স্পেকট্রামের প্রধান উপসর্গগুলোর জন্য নতুন চিকিৎসা প্রয়োজন।
এজরার উপসর্গ প্রশমনে সব চিকিৎসাই চালায় তার মা জোয়ান। তবে এজরা আরও বেশি আক্রমণাত্মক হতে থাকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে তাকে সাইকোট্রপিক ওষুধ দিতে চাচ্ছিলেন না জোয়ান। এজরার পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে দিন দিন, তার মায়ের সারা শরীরেও ছিল তার আঘাতের ক্ষত।
তখনই স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমে তিনি দেখতে পান অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় গাঁজার নন-সাইকোঅ্যাক্টিভ উপাদান সিবিডি ব্যবহার করে ক্লিনিকাল ট্রায়াল হবে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া স্যান দিয়েগোর সেন্টার ফর মেডিসিনাল ক্যানাবিস রিসার্চ এই ক্লিনিকাল ট্রায়ালটি চালায়।
সে সময় এজরার বয়স ছিল ৯ বছর। জোয়ান সিদ্ধান্ত নেন ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মাধ্যেম এজরার আক্রমণাত্মক আচরণ প্রশমনের শেষ চেষ্টা করবেন।
মৃগী রোগসহ নানা রোগের চিকিৎসায় সিবিডির ব্যবহারের সুফল দেখে আশাবাদী হন তিনি। কিন্তু সিবিডি'র মাধ্যেমে কীভাবে অটিজমের গুরুতর উপসর্গ প্রশমন হবে? মস্তিষ্কে কী প্রভাব ফেলে এটি?
মেডিক্যাল ট্রায়ালটির প্রধান গবেষক, পেডিয়াট্রিক নিউরোলজিস্ট ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া স্যান দিয়েগোর নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড পেডিয়াট্রিকসের ডিসটিঙ্গুইশ প্রফেসর ডা. ডরিস ট্রনার সিএনএন-কে জানান, অটিজম আক্রান্তদের ব্রেইন কেমিস্ট্রিতে অন্যান্যদের চেয়ে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। ডোপামিন ও সেরেটোনিন- দুটি নিউরোট্রান্সমিটার সিস্টেমেই পরিবর্তন দেখা যায়। এর কারণেই বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা যায়।
ডোপামিন ও সেরেটোনিন এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার যা মস্তিষ্কের এক স্নায়ু থেকে অন্য স্নায়ুতে সিগন্যাল বহন করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা খুব কম বা খুব বেশি হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের কিছু অংশ স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন আচরণের পুনরাবৃত্তি ও সামাজিক যোগাযোগে বাধা সম্মুখীন হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
সেরেটোনিনের মাত্রায় প্রভাব রাখতে পারে এই সিবিডি। যার প্রভাবে সামাজিক যোগাযোগের বাধা প্রশমিত হতে পারে।
মন্টেফিওরে হেলথ সিস্টেমের অধীনে নিউইয়র্কেও শিশু-কিশোরদের ওপর ক্যানাবিওয়েড ক্যানাবিডিভারিনের (সিবিডিভি) প্রভাব নিয়ে এ ধরনের একটি ট্রায়াল চলছে।
অটিজম একটি ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার যার উপসর্গ জীবনের প্রাথমিকদিকে মস্তিষ্ক গঠনের সময়েই দেখা যায়।
ডাবল ব্লাইন্ড প্লেসিবো কন্ট্রোলড গবেষণাটির ডা. হলান্ডারের মতে, সিবিডিভি মস্তিষ্কের প্রচন্ড উত্তেজনা কমিয়ে প্রশান্ত হয়ে চিন্তা করতে সাহায্য করে। এ কারণেই অটিজমের চিকিৎসায় এটি ভূমিকা রাখতে পারে।
অটিজমের আক্রান শিশুদের মসিষ্ক প্রচন্ড উত্তেজনা প্রশমন করতে ব্যর্থ হলে রেগে যাওয়া, সেলফ-ইনজুরি, আক্রমণাত্মক ব্যবহার ও আচরণ এবং ব্যবহারে পুনরাবৃত্তি দেখা যেতে পারে।
এ প্রবণতা প্রশমন করা গেলেই এসব গুরুতর উপসর্গ কমে আসে বলে জানান হলান্ডার।
দুটি গবেষণাই এখনো চলমান, কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়েই এর অনেক সুফল দেখা গেছে। হলান্ডার জানান, ক্যালিফোর্নিয়া ও নিউইইয়র্কে ট্রায়ালে অংশ নেওয়া অনেক শিশুর মা-বাবা জানিয়েছেন তাদের সন্তানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আচরণগত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন তারা।
ডা. ট্রনার জানান, অনেক শিশুর মধ্যে আশাবাদী হওয়ার মতো পরিবর্তন দেখা গেছে। আগে যেসব শিশুরা প্রতিদিনই আক্রমণাত্মক আচরণ করতো তাদের মধ্যে তা এখন আর একদমই নেই। অনেকের সেলফ হার্ম করার প্রবণতাও অনেক কমে এসেছে। নিজদের আঘাত করতো যারা, তাদের অনেকে এসব আচরণ বন্ধ করে দেওয়ায় তাদের শরীরের ঘা-ক্ষত শুকিয়ে এসেছে। অনেক শিশুর যোগাযোগ দক্ষতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
তবে ট্রনার জানান, এ নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন। প্রাথমিক এ ফলাফল আশা জাগালেও এখনো নিজেই কিনে চিকিৎসা শুরু করার সময় আসেনি।
ট্রায়ালের সময় জোয়ানের ছেলে এজরাকে কখনো প্লেসিবো দেওয়া হতো, কখনো সিবিডি। ট্রায়ালের শুরুর দিকেও এজরা সবসময় চুপচাপ থাকলে একদিন হঠাত তার মা খেয়াল করেন, এজরা গান গাইছে। সে আগে কখনোই গান গায়নি, কিন্তু সেদিন প্রথমবারের মতো পুরো গান গাইছিল।
তার মা জানান, এজরা এখন বেশ হাসি-খুশি থাকে। আমার সঙ্গে কথা বলতে পারছে। আগের মতো আক্রমণাত্মক আচরণও করে না।
এখনো গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত না হওয়ায় ঠিক কী কারণে এজরার পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব হলো তা পুরোপুরি পরিষ্কার না। তবে কারণ যাই হোক, নিজের সন্তানকে হাসি-খুশি দেখে কথা বলতে দেখে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন জোয়ান।
এই গবেষণার ফলাফলের উপরেই তাই নির্ভর করছে ভবিষ্যতে এমন আরও অনেক এজরার মা'র মুখে হাসি ফুটবে কিনা। সফল হলে হয়তো এজরার মতো অনেক শিশুর জন্য কথা বলা, যোগাযোগ করা সহজ হয়ে উঠবে।