নিরামিষাশী খাদ্যাভ্যাস কি দুধ-মাংস খাওয়ার চেয়ে স্বাস্থ্যকর?
হুগো ও রস টার্নার — জিনগতভাবে অভিন্ন চেহারার দুই যমজ ভাই। গত এক দশক ধরেই তারা অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস অ্যাথলেট হিসেবে কাজ করে আসছেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী বেশ সুনামও কুড়িয়ে ফেলেছেন তারা।
টার্নার ভাইদের কাজের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন কঠিন চ্যালেঞ্জের জন্য নিজেদের শরীরকে প্রস্তুত করে তোলা। যেহেতু তাদের শরীর জিনগতভাবেই সাদৃশ্যপূর্ণ, তাই তারা খুব সহজেই বিভিন্ন কৌশল ও নিয়মের মধ্যে তুলনা করে নির্ধারণ করতে পারেন, কোনগুলো তাদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
সেই তুলনারই অংশ হিসেবে তাদের মাথায় খেলা করে যায় এই প্রশ্ন — কোন ধরনের খাদ্যাভ্যাস তাদের জন্য হতে পারে সর্বোৎকৃষ্ট? পশুজাত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকা কি তাদের পারফরম্যান্সে কোনো পার্থক্য গড়ে দিতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য তারা স্বেচ্ছায় গিনিপিগ বনে যান যুক্তরাজ্যের কিং'স কলেজ লন্ডনের ডিপার্টমেন্ট অব রিসার্চ অন জেমিনির এক দল বিশেষজ্ঞের করা গবেষণায়।
গবেষণার শুরুর আগে যমজ গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ড. টিম স্পেকটর জানান, "আমরা অভিন্ন চেহারার জিনগত যমজদের মডেল ব্যবহার করে খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চার প্রভাব যাচাই করতে চাই, এবং জানতে চাই প্রত্যেক ব্যক্তিবিশেষ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের খাবারে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়।"
এরপরই বারো সপ্তাহের জন্য টার্নার ভাইরা খাদ্যাভ্যাসের দিক দিয়ে আলাদা হয়ে যান : হুগো ভেগান ডায়েট বা নিরামিষাশী খাদ্যাভ্যাস শুরু করেন, অন্যদিকে রস বরাবরের মতোই মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার খেতে থাকেন।
সব মিলিয়ে দুই ভাই-ই প্রতিদিন সমপরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করতে থাকেন, এবং দুজনেই একই ধরনের শরীরচর্চাও চালিয়ে যান।
কী পার্থক্য দেখা গেল?
হুগো স্বীকার করেন যে শুরুর দিকে তাকে নতুন ধরনের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বেগ পেতে হয়।
"প্রথম কয়েক সপ্তাহে আমার খুবই মন চাইত মাংস, দুগ্ধজাত খাবার ও চিজ খেতে। অথচ আমার ডায়েটে ছিল শুধুই ফলমূল আর বাদাম," তিনি বলেন।
"তবে অন্যদিকে, আমি প্রতিদিন আগের তুলনায় বেশি আস্ত খাবার খাচ্ছিলাম, যার ফলে আমার রক্তে সুগার লেভেল স্থিতিশীল ছিল, এবং সারাদিন ধরেই আমি ভেতরে ভেতরে পরিপূর্ণ অনুভব করছিলাম। এমনটিও মনে হচ্ছিল যে আমার শরীরে শক্তি বেড়ে গেছে।"
এদিকে রস তার চিরাচরিত খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখলেও সব দিন তার জন্য সমান যায়নি, "কোনো কোনো দিন আমি অনেক চাঙ্গা ও সতেজ বোধ করেছি। আমার কিছু দিন এমনও ছিল, যখন আমার দীর্ঘসময় ধরে ক্লান্তি ও অবসাদ অনুভব হয়েছে।"
অধ্যাপক স্পেকটরের বিশ্বাস, দুই ভাইয়ের এই ভিন্নধর্মী ও পরস্পরবিরোধী অভিজ্ঞতা তাদেরকে সাহায্য করেছে আরও ভালোভাবে বুঝতে যে শরীরের অভ্যন্তরে খাবার কীভাবে প্রক্রিয়াজাত হয়, এবং কীভাবে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে — এমনকি জিনগতভাবে যমজ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও — এগুলোর প্রভাবে উল্লেখযোগ্য তফাৎ দেখা যেতে পারে।
শুধু টার্নার ভাইয়েরাই নয়, এই ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়েছে কিং'স কলেজ থেকেই হওয়া আরেকটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারী যমজদের ক্ষেত্রেও।
"আমরা বিশ্বাস করি জেনেটিকসের বাইরেও সম্ভবত আরও কিছু ব্যাপার রয়েছে, যেগুলো প্রভাবিত করে আমাদের দেখা ফলাফল, অন্ত্রীয় ফ্লোরাকে," স্পেকটর বলেন।
এই অন্ত্রীয় ফ্লোরা বা মাইক্রোবায়োটা হলো কয়েক ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীবের গুচ্ছ, যারা আমাদের পরিপাকতন্ত্রে বাস করে এবং আমাদের শরীরের নানাবিধ প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয়।
"যদি তাদের [অণুজীবদের] সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয়, তবে তারা হাজারো কেমিক্যাল উৎপন্ন করে, যার মাধ্যমে আমাদের শরীর সঠিক আকৃতিতে থাকবে," অধ্যাপক বলে যান।
"এই কেমিক্যালগুলো রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সাহায্য করে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং মস্তিষ্ক পর্যন্ত যেতে, যেখানে গিয়ে তারা আমাদেরকে আরও বেশি তৃপ্ত ও উৎফুল্ল অনুভব করায়, অথবা আমাদের স্ট্রেস ও ডিপ্রেশনের মাত্রা কমায়।"
অধ্যাপক স্পেকটরের হিসাব অনুযায়ী, অভিন্ন চেহারার যমজদের অন্ত্রীয় ফ্লোরাতেও মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মিল থাকে। হয়তো এটিই কারণ খাদ্যাভ্যাসের প্রতি তাদের আলাদা আলাদা প্রতিক্রিয়া দেখানোর।
কীভাবে পাওয়া যাবে স্বাস্থ্যকর ফ্লোরা?
শরীরের অণুজীবদের ভারসাম্যপূর্ণ অথচ বৈচিত্র্যময় রাখার ক্ষেত্রে স্পেকটর চারটি মৌলিক ধাপের কথা জানান।
"প্রথম ধাপ হলো সপ্তাহে ৩০টি উদ্ভিদ খাওয়া।" এর অর্থ হলো, প্রতিদিন চার থেকে পাঁচবার সবুজ শাকসবজি বা ফলমূল খেতে হবে।
"দ্বিতীয়ত, এমন সব উদ্ভিদ বেছে নেওয়া খুবই জরুরি, যেগুলোতে পলিফেনল রয়েছে। পলিফেনলের কারণেই এসব খাবারের উজ্জ্বল রঙ হয় বা স্বাদ খানিকটা তিক্ত হয়।"
এ ধরনের খাবারের অপশনের মধ্যে রয়েছে লাল বাঁধাকপি, গাজর, লাল ফল (স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি, ব্লুবেরি...), সাইট্রাস (লেবু, কমলা, মাল্টা...), চেস্টনাট, কফি, এমনকি অল্প মিষ্টি চকলেটও।
স্পেকটরের বলা তৃতীয় ধাপটি হলো প্রোবায়োটিকস গ্রহণ। এটি হলো এমন এক ধরনের খাবার যার গঠনে ইতোমধ্যেই রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব, যেগুলো অন্ত্রে বাস করে এবং মাইক্রোবায়োটার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
এ ধরনের প্রোবায়োটিকসের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দই ও কম্বুচা চা।
"সর্বশেষ, অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার বর্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ," অধ্যাপক জানান।
অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার হলো এমন একটি ক্যাটাগরি, যার অন্তর্ভুক্ত শিল্পকারখানায় উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের খাবার, যেগুলো তীব্র যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ায় তাদের প্রকৃত গঠন, রঙ ও স্বাদ হারিয়েছে।
স্টাফড কুকি, সস, সফট ড্রিংক, চিপস, স্ন্যাকস, আইসক্রিয়, চুইং গাম হলো এ ধরনের খাবারের উদাহরণ।
ফলাফল ও শিক্ষা
রস অনুধাবন করেন যে তার ভাইয়ের কয়েক সপ্তাহের জন্য ভেগান হয়ে ওঠা তাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে।
"আমি দেখতে পেলাম প্রতিনিয়ত আমি কী পরিমাণ প্রক্রিয়াজাত খাবার খাচ্ছিলাম, এবং সেটি আমাকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলল।"
তবে অধ্যাপক স্পেকটর ব্যাপারটিকে আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলেন যে, ভেগান ডায়েট মানেই যে সেটি সাধারণ খাদ্যাভ্যাসের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকর, তা কিন্তু নয়।
"এটি নির্ভর করছে আপনার খাওয়া খাবারের গুণগতমানের উপর। বিষয়টি শুধু আপনার প্লেটে মাংস আছে কি নেই, তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। কেননা অনেক ভেগানও তো বিপুল পরিমাণ অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার খেতে পারে।"
বারো সপ্তাহ শেষে দেখা যায়, একদমই ভিন্ন ধরনের খাদ্যাভ্যাস সত্ত্বেও হুগো ও রসের ফলাফল কিন্তু খুব একটা ভিন্ন নয়।
তবে ভেগান ডায়েট মানা হুগোর মধ্যে কিছু স্বাস্থ্যগত উন্নতি দেখা যায়, যেমন কোলেস্টেরলের মাত্রা ও চর্বি শতাংশ হ্রাস, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের প্রতিরোধী ক্ষমতা সৃষ্টি ইত্যাদি।
অবশ্য এসব ফলাফলকে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর জন্যই প্রযোজ্য হবে বলে ধরে নেওয়া যাবে না। হাজার হোক, টার্নার ভাইয়েরা তো অনেক আগে থেকেই হাই-পারফরম্যান্স অ্যাথলেট, যারা বরাবরই গড়পড়তা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি কঠোর শরীরচর্চার রুটিন ও খাদ্যাভ্যাস মেনে এসেছে।
কিন্তু প্রসঙ্গ যদি হয় আমাদের মতো 'সাধারণ' মানুষ, সেক্ষেত্রে স্পেকটরের মতে আমাদের উচিত নিজেদের খাদ্যাভ্যাসে এমন ধরনের পরিবর্তন আনা, যাতে করে আমাদের অন্ত্রীয় ফ্লোরা বা মাইক্রোবায়োটা উপকৃত হবে, ফলে হ্রাস পাবে আমাদের ক্ষুধা, ক্লান্তি ও ওজন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত, যমজ ভাইদের নিয়ে এই গোটা গবেষণা আবারও নতুন করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে এমন কোনো 'পারফেক্ট ডায়েট'-ই আসলে নেই, যা সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর হবে—এমনকি সেইসব মানুষদের ক্ষেত্রেও, যাদের জিনোম একদমই একই ধরনের।
এবং টার্নার ভাইয়েরা নিজেরাও তাদের বারো সপ্তাহের এক্সপেরিমেন্ট থেকে এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
"আমি আমার খাদ্যাভ্যাসে খানিকটা রদবদল ঘটাতে পেরেছি। এখন আমি চেষ্টা করি আমার প্লেটে আরও বেশি রঙ যোগ করতে (রঙিন ফলমূল, শাকসবজি খেতে) এবং সবকিছুই পরিমিত পরিমাণে খেতে," হুগো জানান।
আর রসের মতে, "কেউ যদি বলে যে একটি নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাস সবার জন্য সবসময় একই ধরনের ফলাফল দেবে, সেই কথাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করবেন না, সেটিকে প্রশ্ন করুন। প্রত্যেকেরই প্রয়োজন এক্সপেরিমেন্টকে উপভোগ করা, এবং জানার চেষ্টা করা যে আসলেই কোন খাবারটি তার জন্য কার্যকর হবে।"
- সূত্র: বিবিসি রিল