লক্ষ্মীপুর হাঁসপার্টি!
শীতে হাঁস ও ছিটরুটি খাওয়ার চল আছে মোটামুটি সারা দেশেই। কিন্তু সেটা রীতিমতো উৎসবে পরিণত হওয়ার নজির সব জায়গায় নেই। তবে উপকূলীয় অঞ্চল লক্ষ্মীপুর এ ব্যাপারে আলাদা।
এই অঞ্চলে যত দিন যাচ্ছে, ততই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হাঁসের মাংস। সপরিবারে, কিংবা একসঙ্গে তরুণরা মিলে অথবা কোনো মাহফিলে অনুষ্ঠানে হৈচৈ করে হাঁসের মাংস খাওয়া হয়।
অনেকে শুধু শীতে হাঁসের মাংস খাওয়ার জন্যই বছরে একবার বাড়ি আসছেন। আবার হাঁসের মাংস পাঠানো হচ্ছে দেশের বাইরের আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও।
কাজেই ধীরে ধীরে শীতকালে হাঁসের মাংস খাওয়া ঐতিহ্যে পরিণত হচ্ছে বলা যায় অনায়াসেই। হাঁস বেচাকেনা, প্রতিপালন—এসব মিলে এ অঞ্চলে হাাঁসকেন্দ্রিক ব্যবসাও গড়ে উঠেছে।
প্রতি শীত মৌসুমের ২-৩ মাসে ২০ কোটি টাকার হাঁস কেনাবেচা চলে। ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে পাশের জেলা নোয়াখালী আর চাঁদপুর থেকেও হাঁস নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা।
কমলনগরের আব্দুস সাত্তার বলেন, 'আমাদের বাবা-দাদাদের দেখেছি শীতে হাঁসের গোশত খেতে। মানে বয়স্ক লোকেরা শীতে হাঁস খেতই। এখন দেখি তরুণ-যুবারাও হাঁস খায় অনেক। অনেকটা উৎসবের মতো হয়ে গেছে ব্যাপারটা। শীত যত বাড়ে, হাঁস পার্টিও বাড়ে লক্ষ্মীপুরজুড়ে। সাধারণত হাঁস খাওয়ার ধুম পড়ে রাতের বেলায়।'
আটান্ন বছর বয়সী আবদুস শহীদেরও লক্ষ্মীপুরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তিনি জানাচ্ছেন, তার পরিবারের বয়স্কদের শীতে হাঁস খেতে দেখেছেন। শহীদ বলেন, 'মূলত ঠান্ডা আর বাতের রোগ থেকে রেহাই পেতে অনেক মশলা দিয়ে হাঁস খাওয়া হতো। বেশি খেত হাঁসা, মানে পুরুষ হাঁস।'
এখনকার তরুণদের হাঁস খাওয়ার ধুমকে তিনি নতুনই মনে করছেন। তিনি মন্তব্য করেন, আগের মতো আয়োজন করে তরুণরা হাঁস রাঁধতে পারেন না। হাঁস রান্নারও বিশেষ মশলা ছিল তখন।
শহীদ বলেন, 'এখনকার তরুণ-যুবারা আগের মতো হাঁস রাঁধতে পারে বলে আমার মনে হয় না। আগে তো একজনই একটা খেয়ে ফেলত। এক হাঁসে হতো না, এত স্বাদ ছিল। এখন দেখি দু-চারজন মিলে একটা হাঁস খায়।'
ছড়িয়ে পড়ছে হাঁসজ্বর
লক্ষ্মীপুর যেন পথপ্রদর্শক, লক্ষ্মীপুরের দেখাদেখি হাঁসপার্টি এখন আশপাশের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক সব অনুষ্ঠানে হাঁসের মাংস থাকা নিয়মে পরিণত হয়েছে এসব জায়গায়। সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও বিভিন্ন দিবসে হাঁস পার্টির আয়োজন করছে। জামাই এলে শ্বশুরবাড়িতেও ধুম পড়ে যায় হাঁস খাওয়ার।
আবার অন্যদিকে হাঁসপার্টিকে উপলক্ষ করে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন হচ্ছে ইদানীং। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানেও হাঁস এখন বাধ্যতামূলক আইটেম। অনেকে পদ-পদবির তদবির হিসেবেও হাঁস পার্টির আয়োজন করেন। পদ পাওয়ার পরও হয় পার্টি।
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের ছাত্র আরিফুল ইসলাম জানান, লক্ষ্মীপুর জেলার এমন কোনো তরুণ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এ শীতে কোনো একটি হাঁসপার্টিতে অংশ নেয়নি।
তিনি আরও জানান, 'এখন ব্যাপক চাহিদার কারণে ফার্মের হাঁসই বিক্রি হচ্ছে বেশি। আর স্ত্রী-হাঁসেরও গুরুত্ব বেড়েছে। অনেকে তো নারী-পুরুষ হাঁসের ফারাকই বোঝে না।'
শীতে হাঁস রান্নায় জায়ফল, জয়ত্রী এবং গোলমরিচ বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। আর খাওয়া হয় পরোটা বা রুটি দিয়ে।
ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরি করেন মো. সিরাজুল ইসলাম। তোরাবগঞ্জ বাজারে তার দেখা পেলে তিনি জানালেন, 'গত একমাস বাড়ি আসিনি। এবার এসেছিই হাঁস খাওয়ার জন্য।' তিনি বাজার থেকে দুইটি হাঁস কেনেন ১ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে।
সিরাজের মতো অনেকে যারা ঢাকা বা চট্টগ্রাম থাকেন, তারাও সময় করে শীতে বাড়ি এসে হাঁস খেয়ে যান। কাশেম নামের এক যুবক বলেন, 'হাঁস রান্না করে বাবার জন্য ওমানে পাঠিয়েছি।'
বাণিজ্যিক উৎপাদন
এখন লক্ষ্মীপুরে হাঁসের বাণিজ্যিক উৎপাদনও কয়েকগুণ বেড়েছে। কমলনগর উপজেলার চর পাগলা গ্রামের মাসুদ আলম বলেন, 'একটি হাঁসের খামার দিয়েছিলাম ডিম উৎপাদনের জন্য। কিন্তু গত বছর ডিমপাড়া ১২০০ হাঁস বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এতে আমার প্রায় ৩ লাখ টাকা আয় হয়। এখন তো হাঁসই চাষ করছি।'
প্রাণীসম্পদ বিভাগের কর্মচারী মো. আলাউদ্দিন বলেন, বিগত ৩-৪ বছর ধরে শীতে হাঁসের চাহিদা এতই বেড়েছে যে অনেকসময় হাঁসই পাওয়া যায় না। এ হাঁস উৎসবকে কেন্দ্র করে মৌসুমে লাখ লাখ হাঁস বেচাকেনা হচ্ছে।
জেলার কমলনগর উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান জানান, প্রায় প্রতি বাড়িতে হাঁসপালন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খামারি সংখ্যাও বাড়ছে। এতে করে কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী এ রীতি এখন উৎসবে পরিণত হয়েছে। জেলায় হাঁস বেচাকেনা হয়, এমন বাজার আছে ৫০টি। ওসব বাজারে হাটের দিন গড়ে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ হাঁস বিক্রি হয়। বাজার ইজারাদাররা দাবি করেন, মৌসুমে এসব বাজারে প্রায় ২০ কোটি টাকার হাঁস বেচাকেনা হয়।
হাঁস উৎপাদন হয় মূলত জেলার উপকূলীয় এলাকা রামগতি ও রায়পুরায়। বাজারে পুরুষ হাঁসের জোড়া ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। অন্যদিকে খামারের হাঁস প্রতিজোড়া ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা দামে বিক্রি হয়।
জেলা পশু সম্পদ কার্যালয় জানিয়েছে, ২০০ থেকে ৩ হাজার হাঁস পালন হয় এমন খামার এ জেলায় আছে ১৭০টি। এছাড়া প্রায় সব বাড়িতেই নারীরা হাঁস পালন করেন।