নতুন বছরের কাউন্টডাউন কেন করা হয়?
আর মাত্র অল্প কিছু সময়ের অপেক্ষা। ঘড়ির কাটা ১২র ঘর পেরোলেই শুরু হবে নতুন এক বছর, ২০২২ সাল। নতুন বছরের কাউন্টডাউন মানেই যেন অন্য রকম উত্তেজনা। নতুন বছরকে স্বাগতম জানানোর জন্য সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সবার সমস্বরে উল্লাস-চিৎকার এক নতুন আশার আলো জ্বালে আমাদের মনে। কিন্তু এই কাউন্টডাউন প্রথা আসলে এলো কোথেকে? আর কেনই বা আমরা কাউন্টডাউনের মাধ্যমেই নতুন একটি বছর উদযাপন আরম্ভ করি?
সত্যি বলতে ষাট ও সত্তরের দশকের আগপর্যন্ত কোনোকিছুর জন্যই মানুষ কোনো কাউন্টডাউন করতো না। ৩১ ডিসেম্বরের উৎসব-উদযাপন এবং মাঝরাতে প্রিয়জনকে উষ্ণ ভালোবাসা জানানো চলতো ঠিকই, কিন্তু তখন কাউন্টডাউনের কোনো বালাই ছিল না। তাহলে হুট করে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে কি করে কাউন্টডাউন নামক উত্তেজনাকর বিষয়টি চলে এলো আমাদের জীবনে?
আমাদের চোখে যা নিছকই একটি সংখ্যা গণনা, তার পেছনে রয়েছে বেশকিছু কারণ ও উদ্দেশ্য। নতুন বছরের কাউন্টডাউনকে আমরা 'জেনেসিস কাউন্টডাউন' বলে অভিহিত করতে পারি; সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর যা নতুন করে শুরু হয়। নতুন একটি বছরের জন্য অপেক্ষা, অনুমান, প্রত্যাশা, নিউ ইয়ার রিসল্যুশন, জমিয়ে পার্টি করা...এই সবকিছুই নব উদ্যম ও আশার প্রতীক হিসেবে থাকে জেনেসিস কাউন্টডাউনে।
কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত আরেকটি কাউন্টডাউন আছে যার অর্থ সময় ফুরিয়ে যাওয়া এবং দুর্যোগ ঘনিয়ে আসা। এটিকে বলা হয় 'অ্যাপোক্যালিপ্টিক কাউন্টডাউন'। আজ পৃথিবীর এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমরা হয়তো ভাবছি, কোভিড-১৯ এর নতুন ভ্যারিয়ান্ট আঘাত হানার আগে কিংবা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়ার আগে ঠিক কতদিন বেঁচে থাকবো আমরা! এই দুই ধরনের কাউন্টডাউনেরই জন্ম হয়েছে পারমাণবিক বছরের সময়টায়।
পারমাণবিক বছরের প্রসঙ্গে আমেরিকানদের জীবন সম্পর্কে বলতেই হয়। মার্কিন নাগরিকদের জীবনে দুর্যোগের ঘনঘটা সবসময়ই ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের ভয়াবহতা মানুষের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ১৯৪৭ সালে 'বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস' ডুমসে ক্লক উদ্ভাবন করে যা আমাদেরকে পৃথিবীর ধ্বংসের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর কয়েক বছর পরেই একই বিজ্ঞানীরা 'কাউন্ট ডাউন' শব্দদ্বয়ের সাথে পৃথিবীকে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৫৩ সালে আমেরিকার নেডাডা মরুভূমিতে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার সময় বোমা ফেলার শেষ মুহূর্তে 'মাইনাস ১০ সেকেন্ড, মাইনাস ৫ সেকেন্ড এবং মাইনাস ৪ সেকেন্ড' ধরে কাউন্টডাউন করা হয়।
তবে ১৯৬১ সালের ৫ মে প্রথমবারের মতো কাউন্টডাউন প্রথা জনসম্মুখে ব্যাপক পরিচিতি পায়। আর এখানেও ছিল মার্কিনিদের কসরত। সেদিন আমেরিকার প্রথম মানুষ বহনকারী মহাকাশযান চালু হয় কাউন্টডাউনের মাধ্যমে এবং সেই অনুষ্ঠান টিভিতে একযোগে দেখে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক। মহাকাশযান উৎক্ষেপণের ঠিক আগমুহূর্তে শোনা যায় নভোচারী অ্যালান শেফার্ডের কন্ঠ, 'রজার, লিফটঅফ এবং ঘড়ি চালু হয়ে গেছে!' এভাবেই অ্যাপোক্যালিপটিক কাউন্টডাউনের অবসান ঘটে, শুরু হয় নতুন এক সময় গণনা।
তবে মার্কিনিদেরও আগে রকেটযান লঞ্চের সাথে কাউন্টডাউনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি চলচ্চিত্রে দেখান জার্মান পরিচালক ফ্রিটজ ল্যাং। ১৯২৯ সালে 'ওম্যান ইন দ্য মুন' ছবিতে মুন রকেট লঞ্চের সময় একটি কাউন্টডাউনের দৃশ্য দেখান তিনি। সে সময় কাউন্টডাউন নামক কোনো শব্দের কথা কেউ জানতোই না। কিন্তু সায়েন্স ফিকশন ঘরানার এই ছবিটি জার্মানির রকেট বিজ্ঞানীদের ওপর প্রভাব ফেলে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তারা আমেরিকান মহাকাশ প্রোগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। ফ্রিটজ ল্যাং-এর ছবির একজন উপদেষ্টা উইলি লি ছিলেন শুরুর দিকের একজন মহাকাশ ভ্রমণপ্রেমী ব্যক্তি। পরবর্তীতে লি নিজেই আমেরিকায় অভিবাসিত হন এবং নাসায় কাজ শুরু করেন।
ষাটের দশকে টেলিভাইজড রকেট লঞ্চিং এর পাশাপাশি কাউন্টডাউন প্রথার সাথে আরও ইতিবাচকভাবে যুক্ত হতে থাকে মানুষ। তারই ফলাফল হিসেবে অ্যাপোলো-১১ মহাকাশযান লিফটঅফের ঐতিহাসিক কাউন্টডাউন দেখতে পায় বিশ্ব। নবজাগরণের প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বেড়ে যায় এই জেনেসিস কাউন্টডাউনের মাধ্যমে।
সত্তরের দশকে পারমাণবিক বোমা বা মহাকাশযান মিশন থেকে বেরিয়ে নতুন নতুন ক্ষেত্রে জায়গা করে নিতে থাকে কাউন্টডাউন প্রথা। ১৯৭৪ সালে চালু হয় জনপ্রিয় অস্ট্রেলিয়ান মিউজিক শো 'কাউন্টডাউন'। এই শো-এর অনুকরণে ইউরোপ-আমেরিকায়ও বিভিন্ন শো চালু হয়। বিভিন্ন গ্রেটেস্ট হিট গানের কাউন্টডাউনের মাধ্যমের সময়কে ধীর করে দেয় এবং এদের সাম্প্রতিক অতীতকে সীমাবদ্ধ করে দেয় এসব শো। এখানে সময় নয়, বরং শীর্ষ গান বা সবচেয়ে জনপ্রিয় গানই মুখ্য বিষয়।
অন্যদিকে সময়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ভিন্ন ধরনের টিভি শো গুলো। ব্রিটিশ গেম শো 'কাউন্টডাউন'-এ দেখানো হয়, প্রতিযোগীরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খেলা শেষ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। খুব অল্প সময়েই জটিল জটিল খেলা ও ধাঁধার সমাধান করে প্রতিযোগীরা দেখিয়ে দেন, সময়কেও হারিয়ে দেওয়া সম্ভব!
তবে একথা অস্বীকারের উপায় নেই যে অ্যাপোক্যালিপ্ট এবং জেনেসিস কাউন্টডাউন প্রথার নানা বিবর্তনের হাত ধরেই আজকের উদযাপনমূলক কাউন্টডাউনের জন্ম। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর এই কাউন্টডাউনকে ঘিরে নানা উৎসব পালন করে বিশ্ববাসী। ষাটের দশকে নতুন বছরের কাউন্টডাউনকে টিভির পর্দায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন ব্রডকাস্টার বেন গ্রাউয়ের। ১৯৭৯ সালের দিকে নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে লাখো জনতার উপস্থিতিতে নতুন বছরের কাউন্টডাউনের রেওয়াজ চালু হয়। ঠিক ওই মুহূর্তেই সবার বোঝা হয়ে যায় যে কাউন্টডাউন রীতি খুব শীঘ্রই বিশ্ব সংস্কৃতিতে প্রবেশ করবে।
এরপর আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। আশির দশকের শেষ দিকেই টাইমস স্কয়ারে বসানো হয় কাউন্টডাউন ক্লক। মধ্যরাত পর্যন্ত টিভি গ্রাফিকের মাধ্যমে দেখানো হয় নতুন বছরে পা রাখতে কতটা সময় বাকি।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশককে জেনেসিস এবং অ্যাপোক্যালিপ্টিক কাউন্টডাউন, অর্থাৎ শুভ ও অশুভ সময়ের মাঝামাঝি রাখা যায়। উদাহরণ হিসেবে অলিম্পিক গেমসের ঘড়ি এবং জলবায়ু ঘড়ির কথা বলা যায়। তবে যাই হোক না কেন, বর্তমান সময়ে বড় কোনো আয়োজ়নে কাউন্টডাউন ঘড়ি থাকবেই। সামাজিক-আন্তর্জাতিক নানা ইভেন্ট থেকে শুরু করে নিজের জন্মদিন পর্যন্ত কাউন্টডাউনের আওতায় ফেলে দেওয়া যায়!
জনসাধারণের জন্য হোক কিংবা ব্যক্তিগত, কাউন্টডাউন ঘড়ির উদ্দেশ্যই আপনার ধৈর্য পরীক্ষা করা এবং অনিশ্চয়তাকে সরিয়ে দিয়ে ইতিবাচক আভাস দেওয়া। তবে ২০২২ সালকে ঘিরে ঠিক কি প্রত্যাশা তা অনুমান করা একটু কঠিন। টালমাতাল সময়কে পেছনে ফেলে ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা থাকবে অবশ্যই, কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সন্দেহও থাকবে সমানে সমানে। তবু বহু মানুষই যে কাউন্টডাউনের সাথে সাথে উল্লাসে মেতে উঠে নতুন সূচনা করতে চাইবেন, সেকথা নিশ্চিত।
সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন