কেমন যাবে প্রযুক্তিজগতের নতুন বছর
করোনাকালে একটা দীর্ঘ সময়ে গৃহবন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছে আমাদের। এতে করে অন্য আর যে খাতই ক্ষতির সম্মুখীন হোক না কেন, প্রযুক্তি কিন্তু এগিয়ে গেছে তার আপন গতিতে। এভাবেও বলা যায় যে, মহামারির মধ্যে প্রযুক্তিই হয়ে উঠেছে মানুষের পরম বন্ধু।
যেহেতু করোনার প্রকোপ এখনো পুরোপুরি কমেনি, বরং ওমিক্রন নামের এক নতুন ভ্যারিয়েন্ট চোখ রাঙাচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছুর, তাই অনেকের মনেই কৌতূহল -- প্রযুক্তিজগৎ কী উপহার দেবে আমাদের ২০২২ সালে?
চলুন, জেনে নেওয়া যাক একে একে প্রযুক্তি জগতের সম্ভাব্য সেরকমই কিছু উপাদান সম্পর্কে, যারা আলো ছড়াতে পারে নতুন বছরে।
জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স
বাজারে আসন্ন সবচেয়ে শক্তিশালী আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৌশলগুলোর একটি হলো জেনারেটিভ এআই। এতে রয়েছে একগুচ্ছ মেশিন লার্নিং মেথড, যারা কোনো বস্তু বা কনটেন্ট সম্পর্কে তাদের ডেটা থেকেই সবটা জেনে নেয়, এবং সেই জ্ঞানকে পরবর্তীতে কাজে লাগায় সম্পূর্ণ নতুন ও আরো বাস্তবসম্পন্ন প্রোডাক্ট তৈরিতে।
কানেকটিকাট-ভিত্তিক প্রযুক্তি গবেষণা ও পরামর্শকারী কোম্পানি গার্টনার আশা করছে জেনারেটিভ এআই-এর মাধ্যমেই ২০২২ সালে বৈশ্বিক যাবতীয় ডেটার ১০ শতাংশ তৈরি হবে। জানিয়ে রাখা ভালো, বর্তমানে জেনারেটিভ এআই থেকে উৎপন্ন ডেটার পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম।
এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নানা ধরনের কাজ করা যাবে, যেমন সফটওয়্যার কোড নির্মাণ, নতুন ধরনের ওষুধ আবিষ্কার এবং টার্গেটেড মার্কেটিং। তবে বিশ্লেষকরা আগে থেকেই সাবধান করে দিয়েছেন যে স্ক্যাম, রাজনৈতিক ভুয়া প্রচারণা কিংবা জাল পরিচয় তৈরির মতো কাজে জেনারেটিভ এআর-এর অপব্যবহার হতে পারে।
মূলধারায় চলে আসবে ডিজিটাল ফিন্যান্স
ইতোমধ্যেই প্রযুক্তিজগৎ আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বেশ কিছু পুরোদস্তুর ডিজিটাল ফিন্যান্স উদ্ভাবনের সঙ্গে। এদের মধ্যে রয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং সেন্ট্রাল ব্যাংক-ব্যাকড ডিজিটাল কারেন্সি (সিবিডিসি)। এগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত হয়েছে, এবং ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট প্রক্রিয়ায়ও আরো উন্নতি আসছে।
গেল অক্টোবরে ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড (আইএমএফ) জানিয়েছে, তারা গভীর আগ্রহের সঙ্গে ডিজিটাল কারেন্সির সম্ভাব্য ঝুঁকি ও সম্ভাবনা দুই-ই পর্যবেক্ষণ করছে।
বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও ডিজিটাল কারেন্সির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে, কেননা ক্রিপ্টোকারেন্ট এবং অন্যান্য অনলাইন পেমেন্ট চ্যানেলের জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছে।
মুডি'স ইনভেস্টর্স সার্ভিসের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ভোক্তারা ডিজিটাল পেমেন্টের দিকে ঝোঁকায় অনেক নতুন দেশই সিবিডিসি তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছে। ২০২২ সালেও অব্যাহত থাকবে নতুন আগ্রহীদের অংশগ্রহণ।
অটোমেশন আরো সহজ করবে জীবন
ইতোমধ্যেই নানাভাবে অটোমেশন প্রযুক্তির প্রবেশ করে ফেলেছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। এবং মজার ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ মানুষ সচেতনভাবে এ ব্যাপারটি কখনো বুঝে উঠতেও পারেনি! সেলফ-ড্রাইভিং যানবাহন থেকে শুরু করে আপনার স্মার্টফোন বা অন্যান্য ডিভাইসের ডেটা ক্লিনিং সিস্টেম, এগুলোকে অটোমেশন ছাড়া আর কী-ই বা বলা চলে!
ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই মানুষের বিদ্যমান সকল কাজের অর্ধেকটাই হয়ে যাবে অটোমেটেড। তখন নেক্সট-লেভেল প্রসেস অটোমেশন কিংবা ভার্চুয়ালাইজেশন প্রযুক্তির ব্যাপারে নিতান্ত বকলম ব্যক্তিদের কাছেও ডালভাত ব্যাপার হয়ে উঠবে।
সাম্প্রতিককালে আইটি ও প্রকৌশলী নেতাদের নিয়ে করা এক জরিপের ফলে দেখা গেছে, ৭৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারীই বলেছেন অটোমেশন তাদেরকে কর্মক্ষেত্রে আরো কার্যকর ও সক্রিয় হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। এছাড়া ৫৯ শতাংশ বলেছে, দলীয় কাজে অটোমেশনের প্রয়োগে খরচের পরিমাণ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
গড়ে উঠবে ক্লাউড প্রযুক্তির বিশাল বাজার
বিগত দুই বছরে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের অবিশ্বাস্য উন্নতি ঘটেছে। যেহেতু বিভিন্ন সংস্থাই ভার্চুয়াল জগতে আরো বেশি সক্রিয় হয়েছে এবং ডিজিটাল পরিষেবা প্রদানে মনোনিবেশ করেছে, তাই ক্লাউড কম্পিউটিং পরিণত হয়েছে তাদের অন্যতম ভরসার জায়গায়।
ম্যাককিনসে প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ কোম্পানিই হাইব্রিড-ক্লাউড অথবা মাল্টি-ক্লাউড প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করতে শুরু করবে। এর ফলে ক্লাউডে ডেটা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ আরো অনেক বেশি সহজ তো হবেই, পাশাপাশি যেকোনো ডিভাইস থেকে চোখের পলকে সেগুলোর অ্যাকসেসও পাওয়া যাবে।
এদিকে ডেলয়েট টেকনোলজি ট্রেন্ডসের আরেক প্রতিবেদন বলছে, আগামী ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যেই প্রচুর সংখ্যক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইন্ডাস্ট্রি ক্লাউডের সম্ভাবনা যাচাই করতে শুরু করবে। আর ২০২৬ সাল নাগাদ ক্লাউডকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে ৬৪০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল বাজার।
বিপ্লব আসবে জৈব প্রযুক্তির
এআই, অটোমেশন ও ডিএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের হাত ধরে আসতে চলেছে জৈব বিপ্লব। এতে করে সম্ভব হবে জিন-থেরাপি, হাইপার-পারসোনালাইজড ওষুধ উৎপাদন এবং খাদ্য ও শরীরচর্চার ক্ষেত্রে জিনভিত্তিক দিক-নির্দেশনা।
ম্যাককিনসের মতে, "জৈব বিজ্ঞানে এমন অগ্রগতি সাধিত হবে যার ফলে তাৎপর্যময় প্রভাব পড়তে অর্থনীতি থেকে শুরু করে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে। তাছাড়া এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে, ভোক্তা পণ্যে, শক্তি ও কাঁচামাল সংরক্ষণে।"
ঘুচবে বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জের ঝামেলা
বৈদ্যুতিক গাড়ির উদ্ভাবন হয়তো ইতোমধ্যেই অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে, তবু গণপরিসরে ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিকল) চার্জিং নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়া এখনো ঢিমেতালে এগোচ্ছে। তবে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক জুনিপার রিসার্চ আশ্বস্ত করেছে, ২০২২ সালে এসে বদলাবে পরিস্থিতি।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক টেসলা এরই মধ্যে নিজেদের সুপারচার্জার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছে। অন্যান্য কোম্পানিগুলোও বসে নেই হাত গুটিয়ে। অচিরেই তারাও নিশ্চিতভাবেই আদায় করবে নিজস্ব ক্রেতাদের সন্তুষ্টি। ফলে খুব শিগগিরই এই প্রযুক্তি চলে আসবে মূলধারার স্রোতে।
জমবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের লড়াই
বিশ্বের প্রধানতম অর্থনীতিগুলো, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও জাপান, এছাড়াও প্রযুক্তিজগতের বাঘা বাঘা খেলোয়াড় যেমন আইবিএম, আলিবাবা, গুগল ও মাইক্রোসফট – এরা সবাই মিলে এখন মেতে উঠেছে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং খাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের এক অভূতপূর্ব লড়াইয়ে।
ভিসা, জেপি মরগান ও ভক্সওয়াগনের মতো কোম্পানিগুলোও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের কোয়ান্টাম প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।
নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জাগছে, কী এই কোয়ান্টাম কম্পিউটিং? আসলে এটি হলো এমন এক অতি-উন্নত প্রযুক্তি, যা কোয়ান্টাম মেকানিকসের সূত্র মেনে এমন সব সমস্যারও অনায়াস সমাধান বের করে ফেলে, যেগুলো ক্লাসিকাল কম্পিউটারের পক্ষে দুঃসাধ্য বা প্রায়-অসম্ভব।
গত মে মাসে গুগল জানিয়েছে, তারা ২০২৯ সালের মধ্যেই একটি কমার্শিয়াল-গ্রেড কোয়ান্টাম কম্পিউটার নির্মাণকে পাখির চোখ করেছে। তাদের নির্মিত কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে যেগুলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশেও যেকোনো জটিল-কঠিন হিসাবকে সেকেন্ডের ব্যবধানে সমাধান করে ফেলা যাবে।
তারও আগে মার্চ মাসে আবুধাবি জানিয়েছে, তারাও তাদের নিজস্ব কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করবে, যেটি যেকোনো তথ্যকেই বর্তমানে বিদ্যমান প্রযুক্তির চেয়ে দ্রুত গতিতে প্রক্রিয়াজাত করতে পারবে।
বলাই বাহুল্য, ২০২২ সালে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংকে কেন্দ্র করে জমে ওঠা লড়াই আরো বেগবান হবে, সেই সঙ্গে যুক্ত হবে আরো অনেক নতুন নতুন দেশ ও কোম্পানি।
- সূত্র: দ্য ইকোনমিক টাইমস ও দ্য ন্যাশনাল নিউজ