হাঁসের রোস্ট আর কবুতরের পোলাওয়ের জন্য মুক্তাই সেরা!
খিলগাঁও তিলপাপাড়া হাড়ভাঙা মোড়ে যখন পৌঁছেছি তখন বেলা প্রায় ৩টা। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিরিয়ানির দোকান। আমরা এসেছি মুক্তা বিরিয়ানির খোঁজে। কিন্তু এখানে মুক্তা বিরিয়ানি ঘরই আছে দুটো! তাহলে কোনটায় যাব? আশেপাশে জিজ্ঞেস করে জানা গেল দুই ভাই এখন দুই হোটেল চালাচ্ছেন। আমরা পুরোনো হোটেলটায় ঢুকে পড়লাম।
মুক্তা বিরিয়ানির সিগনেচার আইটেম গরুর চাপ হলেও, শীতের দুপুরে আমাদের ইচ্ছা হাঁসের রোস্ট আর আস্ত কবুতর ভুনা খাওয়ার। এতবেলাতেও ভেতরে অনেক মানুষ। খাবার কেমন হবে সে সম্পর্কে তখনো আমাদের ধারণা নেই। খেতে আসা মানুষদের মধ্যে প্রথমেই চোখ গেল এক বিদেশিনীর দিকে। এবার একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সাত সমুদ্দুর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসা অতিথির পা যখন পড়েছে, তার মানে অবশ্যই এই দোকানের বিশেষত্ব আছে!
কিন্তু এত বেলায় কি হাঁস আর কবুতর পাওয়া যাবে? আমাদের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। হাঁসের রোস্ট আর কবুতর দুটোই ছিল।
খাবারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা না করে আমরা এগিয়ে গেলাম বিদেশি অতিথির টেবিলের দিকে। দলবেঁধে খেতে এসেছেন সাতজন। তাদের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। জানা গেল পুরো দলটি তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ করছে। কাজের ফাঁকে এখানে খেতে আসা। তাদের নিয়ে এসেছেন সোহেল নামের স্থানীয় একজন।
প্রায় ১৩ বছর ধরে এই এলাকায় থাকেন সোহেল। তার কাছেই প্রশ্ন রাখলাম- খিলগাঁওয়ে এত বিরিয়ানির দোকান রেখে এখানে কেন আসা? তিনি জানালেন এই দোকানের খাবারের স্বাদ তার কাছে অন্যান্য দোকানের চেয়ে ভালো মনে হয়েছে। প্রায়ই এখানে খেতে আসেন তিনি। তার তাই অন্যদের নিয়েও মুক্তা বিরিয়ানিতেই এসেছেন।
নেদারল্যান্ডস থেকে আসা ভি-র দিকে তাকিয়ে দেখা গেল তার প্লেটে তখনো প্রায় অর্ধেক খাবার রয়ে গেছে। খাবার ভালো লাগেনি ভেবে জিজ্ঞেস করায় হাসতে হাসতে জানালেন উল্টো কথা। এখানকার খাবারে ঝাল কম হাওয়ায় তার কাছে বেশ ভালো লেগেছে।
খাবার যেমন লাগল
মুখে মুখে খাবারের সুনাম শুনে ততক্ষণে আমাদের পেটেও ইঁদুর দৌড়াতে শুরু করেছে। অবশেষে চলে আসে গরম পোলাওয়ের সঙ্গে হাঁসের রোস্ট আর আস্ত কবুতর ভুনা। সাথে আছে জর্দা, বোরহানি আর সালাদ।
মুক্তা বিরিয়ানির বিশেষত্ব হলো দোকানে কোনো রান্না হয় না। বাসা থেকে রান্না করে এনে রাখা হয়। আর তাই পরিবেশনেও খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না।
বড় বড় মাংসের টুকরো দেখে শুরুতেই মন ভালো হয়ে গেল। গত মাসেই খাবারের দাম বাড়ায় মুক্তা বিরিয়ানি। দাম বাড়ার পরেও দুর্মূল্যের এই বাজারে আস্ত কবুতর আর পোলাওয়ের দাম প্লেট প্রতি ২০০ টাকা। আমাদের কাছে এই দাম খুব একটা খারাপ মনে হয়নি।
হাঁসের রোস্ট আর কবুতরের ঝোলের টকটকে রঙ দেখেই জিভে জল চলে আসছিল। কষানো ঝোলে ভাসছিল তেল। স্বাস্থ্য নিয়ে যারা সচেতন তারা একটু দ্বিধা বোধ করতে পারেন। কষানো মাংসের এই ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া গেলেও মন্দ হতো না।
গরম গরম পোলাওয়ের থালে মাংস ঝোল মেখে সামান্য মুখে দিতেই মনে হলো অমৃত। খুব বেশি ঝাল লাগেনি। হাঁসের মাংস সাধারণত একটু শক্ত হলেও এখানকার রান্না করা রোস্ট বেশ নরমই ছিল। পোলাও ছিল সাদা ঝরঝরে। কবুতর ভুনা দেখতে কিছুটা কালচে। কবুতরের স্বাদও দারুণ ছিল।
কেউ বেশি ঝাল খেতে চাইলে আলাদা কাঁচামরিচ নিয়েও খেতে পারেন। মরিচ, লেবু, শসা কেটে সাথেই পরিবেশন করা হয়েছিল সালাদ।
খাবারের পরিমাণও বেশ ভালো ছিল। বাড়তি পোলাও নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।
বোরহানি বেশি পাতলা মনে হয়েছে। তবে পোলাও-রোস্ট খেয়ে মিষ্টি জর্দাটা খেতে অসাধারণ লাগছিল।
অতিথি আপ্যায়নে হোটেলের কর্মীদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ভিড়ের মধ্যেও নিরলসভাবে সবার অর্ডার নিয়ে তারা সচেতন।
মুক্তা বিরিয়ানির ইতিহাস
৩৫ বছর আগে 'মুক্তা বিরিয়ানি ঘর' প্রতিষ্ঠা করেন মো. নিজামউদ্দিন খান ওরফে খান সাহেব। মুক্তিযুদ্ধের আগে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে 'নিজামউদ্দিন হোটেল' নামে তার ভাতের হোটেল ছিল। সেখানে সাদা ভাতের সাথে মাছ, মুরগি, আর গরুর নানা পদের পাশাপাশি থাকত ঘরোয়া সব বাংলা খাবার। গরুর মাংস রান্নায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন খান সাহেব। অল্প সময়েই বেশ জমে উঠেছিল নিজামউদ্দিন হোটেল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের দখল নেয়। পরিবার নিয়ে পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেও দোকান আর ঘরবাড়ি হারান নিজামউদ্দিন খান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্য চাকরি শুরু করলেও সেখানে মন বসাতে না পেরে ফিরে আসেন আগের কাজেই। খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায় রানি বিল্ডিংয়ের নিচে এক ছোট্ট দোকানে ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে ছোট মেয়ে মুক্তার নামে নতুন করে শুরু করেন 'মুক্তা বিরিয়ানি ঘর'। শুধু গরুর চাপ-পোলাও দিয়ে শুরু করে অল্প সময়েই গোপন রেসিপির গুণে মুক্তা বিরিয়ানি জিতে নেয় ক্রেতাদের মন।
প্রথম থেকেই নিজামউদ্দিন খানের ব্যবসার সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী। অনেকদিন পর্যন্ত রান্নার দিকটা একাই সামলেছেন খান সাহেব। পরবর্তীতে একজন সহকারী বাবুর্চী নিযুক্ত করেন। এখন পর্যন্ত সেই বাবুর্চী হোটেলের রান্নার কাজে নিযুক্ত আছেন। তবে এখন রান্নার মূল তদারকি করেন ছোট ছেলে আরমান খান। ছেলেকে সঙ্গী করে রান্না থেকে শুরু করে ব্যবসার সব কিছু শেখান খান সাহেব।
হোটেলের কর্মীদের কখনো নিজের পরিবারের চেয়ে আলাদা ভাবেননি তিনি। তাই কর্মীরাও নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করে গেছেন।
২০১৪ সালে নিজামউদ্দিন খানের মৃত্যুর পর থেকে ছেলে আর নাতিরা মিলেই দেখাশোনা করে মুক্তা বিরিয়ানি ঘর। আরমান খান এখন একই জায়গায় আরো বড় করে হোটেল সাজিয়েছেন।
নিজামউদ্দিন খানের আরেক ছেলে আকরাম খান পাশের রাস্তায় মুক্তা বিরিয়ানি ঘর নামেই আলাদা দোকান শুরু করেন। তবে তার দোকানের বিশেষত্ব গরুর তেহারি।
বর্তমান চিত্র
মুক্তা বিরিয়ানি ঘরের প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে গরুর চাপ-পোলাওয়ের দাম ১৬০ টাকা, হাঁসের রোস্ট-পোলাও ২০০ টাকা, আস্ত কবুতর-পোলাও ২০০ টাকা, স্পেশাল কাচ্চি ১৮০ টাকা, বোরহানি প্রতি গ্লাস ৩০ টাকা, জর্দা প্রতি বাটি ৩০ টাকা।
দোকানে কথা বলে জানা চায়, এখানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় গরুর চাপ।
রোজকার খাবার মেন্যুর জন্য প্রায় প্রতিদিনই দোকানে একটি আস্ত গরুর দরকার হয়। স্থানীয় কসাইয়ের দোকান থেকে আনা হয় গরুর মাংস। মুরগি আনা হয় খিলগাঁও বাজার থেকে। হাঁস, কবুতর আর খাসির মাংস আনা হয় কাপ্তান বাজার থেকে। কারওয়ান বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয় অন্যান্য উপকরণ।
সকাল ৮টার মধ্যেই মাংসের ব্যবস্থা করে ফেলা হয়। রান্নার মূল আয়োজন হয় হোটেলের বাইরে। হোটেল কর্মীরা আসেন ৯টার দিকে। এরপর দুই-তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে পুরো হোটেল পরিষ্কার করা হয়।
দুপুর ১২টায় শুরু হয় খাবার পরিবেশন। রাত ১১টা পর্যন্ত হোটেল খোলা থাকে। দুপুর আর রাতের খাবারের জন্য দিনে দুইবার রান্নার আয়োজন হয়।
বর্তমানে হোটেলে ১০ জন কর্মী কাজ করেন। হোটেলের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে থাকে তাদের বিশেষ নজর।
গত ডিসেম্বর মাস থেকে সব খাবারের দাম বাড়ানোয় অভিযোগ করেন এখানকার নিয়মিত কাস্টমার জান্নাত। তিনি বলেন, "মুক্তা বিরিয়ানির গরুর চাপ-পোলাও খেতে এখানে আমার রেগুলার আসা হতো। কিন্তু ইদানিং খাবারের দাম অনেক বাড়ানো হয়েছে।"
দাম বাড়ানোর কারণ নিয়ে কথা বলেন আরমান খান। "লাভ একদমই কমে যাওয়ায় দুই বছর পর দাম বাড়ালাম। এই দুই বছরে সব ধরনের দ্রব্যমূল্য বাড়ার পাশাপাশি আমার হোটেলের ভাড়া, কর্মীদের বেতন সবই বাড়াতে হয়েছে। খরচ এত বাড়লে খাবারের দাম বাড়ানো ছাড়া তো উপায় থাকে না," বলেন তিনি।
মুক্তা বিরিয়ানির সুনাম শুনে ধানমণ্ডি থেকে প্রথমবার খেতে আসা ফাহিম হাসান বলেন, "এখানের খাবার অনুযায়ী আমার কাছে দাম ঠিকঠাক মনে হয়েছে। খাবারের স্বাদও অনেক ভালো।"
আরমান খান জানান, খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা বাংলাদেশ জাতীয়দলের সাবেক ক্রিকেটার আশরাফুল এখানে প্রায়ই খেতে আসেন।
"বাংলা ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তী আইয়ুব বাচ্চু আমাদের গরুর চাপ খেয়ে বলেছিলেন এর টেস্টটা অন্য জায়গা থেকে বেশ ব্যতিক্রম," বলেন আরমান।
বাসা বা অফিসের নানা অনুষ্ঠানের জন্য খাবারের অর্ডার নিয়ে থাকে মুক্তা বিরিয়ানি ঘর। সেজন্য কয়েকদিন আগে থেকেই তাদের জানিয়ে রাখতে হয়।
রোজকার রান্নায় যেন খাবারের অপচয় না হয় তাই একটু 'শর্টেজ' রেখেই রান্না করেন তারা। মাঝেমধ্যে বেঁচে যাওয়া খাবার এলাকার গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার কথাও জানান আরমান।