১,০০০ বছর পুরনো হাতে তৈরি কাগজশিল্প আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে
আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী 'মনপা হস্তনির্মিত কাগজ শিল্প'। এক হাজার বছর পুরানো বিলুপ্তপ্রায় এই শিল্পের পুনরুজ্জীবনে নিরলসভাবে কাজ করেছে দেশটির খাদি ও গ্রামীণ শিল্প কমিশন (কেভিআইসি)।
হাতে কাগজ তৈরির এই শিল্প অন্তত এক হাজার বছর আগে উদ্ভূত হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে শিল্পটি অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং এলাকার স্থানীয় প্রথা ও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। একসময় তাওয়াংয়ের প্রতিটি বাড়িতেই উৎপাদিত হত হাতে তৈরি এই কাগজ। স্থানীয়দের জীবিকার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছিল এটি। তবে বিগত প্রায় ১০০ বছর যাবত শিল্পটি প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছিল। অবশেষে, কেভিআইসি'র তৎপরতায় আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে প্রাচীন এই কাগজশিল্প।
শুক্রবার তাওয়াংয়ে একটি 'মনপা হস্তনির্মিত কাগজ' তৈরির ইউনিট চালু করেছে কেভিআইসি। এর উদ্দেশ্য কেবল শিল্পটিকে পুনরুজ্জীবিত করা নয়; স্থানীয় যুবকরা যেন পেশা হিসেবেও এই শিল্পকে বেছে নেন এবং উপার্জনের সুযোগ পান, সে উদ্দেশ্যেটিও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে এখানে। স্থানীয় লোকজন ও কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কেভিআইসি'র চেয়ারম্যান বিনয় কুমার সাক্সেনা ইউনিটটির উদ্বোধন করেন। ঐতিহ্যবাহী এই কাগজশিল্প ইউনিটের উদ্বোধন স্থানীয়দের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
সূক্ষ্ম টেক্সচারযুক্ত হস্তনির্মিত কাগজ স্থানীয়দের কাছে 'মোন শুগু' নামেই বেশি পরিচিত। তাওয়াং এলাকার স্থানীয় আদিবাসীদের প্রাণবন্ত সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই শিল্পের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্বও রয়েছে। কারণ মঠগুলোতে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ও স্তোত্র লেখার জন্য ব্যবহার হতো হাতে তৈরি এই কাগজ।
মনপা হস্তনির্মিত কাগজ 'শুগু সেং' নামক স্থানীয় গাছের ছাল থেকে তৈরি করা হবে, যার ঔষধি গুণও রয়েছে। তাই কাঁচামাল পেতে সমস্যা হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের পিআইবি'র ওয়েবসাইটে।
একসময় তাওয়াং অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী এই কাগজের উৎপাদন এত বেশি ছিল যে, স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে মনপারা তিব্বত, ভুটান, থাইল্যান্ড ও জাপানের মতো দেশগুলোতেও কাগজ বিক্রি করত। তখনকার দিনে এসব দেশে কাগজ তৈরির কোনো শিল্প তখনও গড়ে ওঠেনি। যাহোক, ধীরে ধীরে স্থানীয় এই শিল্পের উৎপাদন কমে আসতে শুরু করে। কারণ চীনের তৈরি সস্তা নিম্নমানের কাগজ স্থানীয় বাজার করে নিতে থাকে।
১৯৯৪ সালে তাওয়াংয়ে মনপা হস্তনির্মিত কাগজ শিল্পের পুনরুজ্জীবনের আরেকটি প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই এলাকার ভৌগোলিক চ্যালেঞ্জ ও নানাবিধ সমস্যার সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল অল্প বিস্তর সেই প্রচেষ্টা।
তবে, কেভিআইসি'র উচ্চতর ব্যবস্থাপনা ও দৃঢ় সংকল্পের ফলে হাজারও চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও নতুন ইউনিটটি সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেভিআইসি'র চেয়ারম্যানের নির্দেশে জয়পুরের কুমারাপ্পা ন্যাশনাল হ্যান্ডমেড পেপার ইনস্টিটিউটের (কেএনএইচপিআই) বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের একটি দলকে তাওয়াংয়ে ইউনিট স্থাপন এবং স্থানীয়দের প্রশিক্ষণের জন্য নিযুক্ত করা হয়। কেভিআইসি'র একটি অংশ হল কেএনএইচপিআই। শুরুতে স্থানীয় গ্রামের ১২ জন নারী ও ২ জন পুরুষকে মনপা হস্তনির্মিত কাগজ তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে কঠোর পরিশ্রমের ফল হিসেবে তাওয়াংয়ে এখন চালু হয়েছে কাগজ তৈরির নতুন এই ইউনিট।
প্রাথমিকভাবে ইউনিটটিতে ৯ জন কারিগরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ শিট মনপা হস্তনির্মিত কাগজ তৈরি করতে পারবেন। এছাড়া, কারিগররা দিন প্রতি মজুরি পাবেন ৪০০ রুপি।
ইউনিট স্থাপনে কেভিআইসি কর্মকর্তাদের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজটি ছিল তাওয়াং-এর দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ও প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে মেশিনগুলোকে যথাযথ স্থানে পরিবহন করা। এক্ষেত্রে অরুণাচল প্রদেশ সরকারের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছে কেভিআইসি। এমনকি ইউনিট স্থাপনের জন্য নামমাত্র ভাড়ায় একটি ভবনের প্রস্তাবও দিয়েছিল প্রদেশ সরকার।
কেভিআইসি চেয়ারম্যান বলেন, মনপা হস্তনির্মিত কাগজ শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা ও এর বাণিজ্যিক উৎপাদন বৃদ্ধি করা কেভিআইসি'র মূল লক্ষ্য।
তিনি আরো বলেন, "এর বিশেষত্বের কারণে হাতে তৈরি এই কাগজটির উচ্চ বাণিজ্যিক মূল্য রয়েছে, যা অরুণাচল প্রদেশে স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া মনপা হস্তনির্মিত কাগজের উত্পাদন বৃদ্ধি ও বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে গত কয়েক দশকে চীনের দখলকৃত বাজার আবারও ফিরে পাওয়া সম্ভব।"
বৈশ্বিক গুরুত্ব উল্লেখ করে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পপণ্যটিকে তিনি মোদি সরকারের 'লোকাল টু গ্লোবাল' নীতির সঙ্গেও সংযুক্ত করেন।
হস্তনির্মিত কাগজ ছাড়াও তাওয়াং আরও দুটি স্থানীয় কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এরমধ্যে একটি হস্তনির্মিত মৃৎশিল্প এবং আরেকটি হস্তনির্মিত আসবাবপত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্পগুলোও বিলুপ্ত হওয়ার পথে। তবে কেভিআইসি'র চেয়ারম্যান বিনয় কুমার এই দুটি স্থানীয় শিল্পের পুনরুজ্জীবনে আগামী ছয় মাসের মধ্যেই পরিকল্পনা তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, "খুব শীঘ্রই 'কুমার শক্তিকরণ যোজনা'-এর অধীনে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে হস্তনির্মিত মৃৎশিল্পের পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।"
মনপা হস্তনির্মিত কাগজ ইউনিট স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করবে। কেভিআইসি বিপণন সহায়তা দেবে এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি হস্তনির্মিত এই কাগজের জন্য বাজার অনুসন্ধানের কাজ করবে। কেভিআইসি ভারতের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের আরও কয়েকটি ইউনিট স্থাপনেরও পরিকল্পনা করছে।
এছাড়া, কেভিআইসি তাওয়াংয়ে অভিনব উপায়ে প্লাস্টিক-মিশ্রিত হাতে তৈরি কাগজের উৎপাদন শুরু করবে বলেও জানান বিনয় কুমার। এর মাধ্যমে ওই অঞ্চলের প্লাস্টিক বর্জ্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে বলে আশা করছেন তিনি।
- সূত্র: পিআইবি ওয়েবসাইট