বিমানবন্দরবিহীন ফিলিস্তিন: পরিত্যক্ত বিমানই যেখানে শখ পূরণের উপায়!
একটি রেস্টুরেন্ট তৈরি করতে সময় লেগেছে দুই দশক, খরচ হয়েছে ৮৫ লাখ ৫১ হাজার টাকা, যুদ্ধের সর্বনাশা আঘাতে জর্জরিত হয়েছে বারবার; তবুও নিভে যায়নি ফিলিস্তিনের দুই ভাইয়ের আশার প্রদীপ। পাহাড়ের চূড়ায় একটি পরিত্যক্ত বোয়িং বিমানকে রেস্টুরেন্টে রূপ দিতে জীবনের অনেকটা সময় পার করেছেন তারা। কিন্তু এটা কি নিছকই একটা রেস্টুরেন্ট নাকি আরও বেশি কিছু?
আতা ও খামিস, দুই ভাইয়ের বয়সই এখন ৬০ বছর। ১৯৯৮ সালে দুজনে মিলে কিনেছিলেন পরিত্যক্ত একটি বোয়িং বিমান। আসছে বসন্তেই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্যে দিয়ে, ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টসহ নতুন রূপে উদ্বোধন করা হবে তাদের বিমান। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই বিমান কখনো আকাশে উড়বে না। কারণ যুদ্ধ-সংঘাতে বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের নেই কোনো বিমানবন্দর!
বিমানকে রেস্টুরেন্টে পরিণত করার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। কোস্টারিকা, কলোরাডো এবং যুক্তরাজ্যেও রয়েছে এমন রেস্টুরেন্ট। কিন্তু আতা-খামিস ভাতৃদ্বয়ের এই রেস্টুরেন্ট নির্মাণের পটভূমিতে রয়েছে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ এবং একই সাথে এটি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাসের প্রতীকও বটে!
গাজার পশ্চিম তীর নিয়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের কথা কারো অজানা নয়। পশ্চিম তীরকে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের বলে দাবি করলেও তাদের নেই কোনো বিমানবন্দর। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলাকালীন ফিলিস্তিনের শেষ বিমানবন্দর ইয়াসির আরাফাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও ২০০০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ইসরায়েলি সৈন্যরা বিমানবন্দরের রাডার স্টেশন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় এবং পরবর্তী দুই বছরে বুলডোজার দিয়ে রানওয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়।
তাই দুই ভাইয়ের 'বিমান-রেস্টুরেন্ট'-এ খেতে আসা বহু ফিলিস্তিনির কাছে এটিই হবে প্রথম কোনো বিমানে পা রাখার সুযোগ।
নিজেদের স্বপ্নের রেস্টুরেন্টকে পছন্দসই রূপ দিতে কোনো কার্পণ্য রাখেননি আতা ও খামিস। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এবং জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহর পোস্টার দিয়ে বিমানকে সাজিয়েছেন তারা। জানিয়েছেন, এই দুজনকে জাতীয় হিরো মানেন তারা।
আতা আল-সাইরাফি বলেন, "এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে আমাদের ২০ বছর লেগেছে। মানুষ এই আইডিয়াটা পছন্দ করেছে। একদিনের জন্য ঘুরে বেড়াতে এটা দারুণ জায়গা!"
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বি'সেলেম-এর ভাষ্যে, পশ্চিম তীর এলাকায় ঢোকা এবং বের হওয়ার পয়েন্টগুলো ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ফিলিস্তিনিরা সারাক্ষণ এখানে আতঙ্কে থাকেন এবং চাইলেই ইচ্ছামতো কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেন না।"
এদিকে ইসরায়েলের দাবি, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা এসব বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু কোনো ফিলিস্তিনির যদি অনুমোদন থাকে তাহলে সে তেল আবিবের কাছাকাছি অবস্থিত বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর থেকে প্রতিবেশি দেশ জর্ডানে যেতে পারবে।
কিন্তু তবুও বহু ফিলিস্তিনির জন্য পরিত্যক্ত বিমানে বসে খাবার খাওয়াই আকাশে ওড়ার স্বপ্ন পূরণের শামিল।
সাইরাফি আরও বলেন, "লোকে এখানে তাদের সন্তানদের নিয়ে আসে দেখাতে যে কিভাবে বিমান ভ্রমণ করা হয়। কারণ ফিলিস্তিনিরা এসব সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমাদের বিমানবন্দর নেই, কিন্তু মানুষ মনে করে আমাদের বিমান তো থাকা উচিত; সেটা বিমানবন্দরে না ই হোক। এটা মানুষকে আকাশপথে ভ্রমণের উতসাহ-উদ্দীপনা জোগায়।
সাইরাফি জানালেন, দ্বিতীয় ইন্তিফাদার কারণে বিশৃঙ্খলা, আর্থিক সংকট এবং মহামারি; সব মিলিয়ে তার রেস্টুরেন্টের কাজ পিছিয়ে যায়।
ইসরায়েলের কিরিয়াত শমোনা শহরে বিমানটি কেনেন সাইরাফি ভাতৃদ্বয়। কিন্তু সেখান থেকে এটিকে নাবলুস অঞ্চলের শহরতলীতে বয়ে আনা ছিল মহা ঝামেলার কাজ। আলাদা আলাদা অংশ খুলে ট্রাকে করে এটিকে পাহাড়ের উপর নিয়ে আসা হয়।
এদিকে উদ্বোধনের দিন এগিয়ে এলেও, রেস্টুরেন্টের খাবারের মেন্যু ঠিক করতে গলদ্ঘর্ম হচ্ছেন দুই ভাই। তবে তাদের ইচ্ছা হুম্মুস, ফালাফেল, কফি এবং সিসা পাইপের মতো খাবার মিলিয়ে মেন্যু তৈরি করা।
সূত্র: ট্রাভেলার