কোন বাকরখানি খাবেন? ঝাল, মিষ্টি, নোনতা, পনির, ঘি, ঝুরা!
পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে কিছুক্ষণ পরপরই দেখা মিলবে ছোট ছোট দোকান, আর দোকানের সামনে কাচের বাক্সে রাখা গোল গোল বাকরখানি। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাকরখানিগুলোর মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম পার্থক্য। কোনোটি মোটা, কোনোটি পাতলা, কোনোটি আবার আকারে বড় বাকরখানি। সেদিন আমরা ছিলাম লালবাগের নওয়াবগঞ্জ রোডে বড় মসজিদের পাশে। একটু এগোতেই দেখলাম, খুদে এক ক্রেতা বাকরখানি কিনছে। নাম আব্দুল মোহাম্মদ (১২)। আব্দুল দোকানে এসেছে তার মামীর জন্য বাকরখানি কিনতে। নিজে বাকরখানিপ্রেমী না হলেও তার মামী নাকি সবসময় বিকেলের নাস্তায় চায়ের সঙ্গে বাকরখানি খেয়ে থাকেন।
পনির, কিমা, কালোজিরা আর বাহারি বাকরখানি
যারা নিয়মিত বাকরখানি খান, তাদের কাছে পনিরের বাকরখানি নতুন করে পরিচিত করানোর কিছু নেই। আমরাও পনিরের বাকরখানির নাম শুনেছি আগেই। কিন্তু কখনো খাওয়া হয়নি। লালবাগ যখন চলেই এসেছি ভাবলাম, এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। তাছাড়া ঢাকায় সর্বপ্রথম বাকরখানির দোকান নাকি গড়ে উঠেছিল লালবাগ কেল্লার কাছেই।
রিকশা নিয়ে সোজা চলে গেলাম কেল্লার পাশের চৌরাস্তায়। গিয়ে দেখলাম পরপর দাঁড়িয়ে আছে তিনটি বাকরখানির দোকান। এদের মধ্যে '৭০ এর দশক থেকে সফলতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছে মো. শাহাআলম মিয়ার দোকান। বাকরখানি ব্যবসায় তার যে মুন্সিয়ানা তা যেন শাহাআলম সাহেবের সুরমা মাখা চোখের চাহনিতেই স্পষ্ট। নিজ থেকেই জানালেন তাদের এখানে পাওয়া যাবে তিন ধরনের বাকরখানি। পনির, নোনতা আর মিষ্টি বাকরখানি। এখানে প্রতিদিন ২৫-৩০ কেজি বাকরখানি বানানো হয়। আর পনিরের বাকরখনিগুলো বানানো হয় ঢাকাই পনির দিয়ে।
পাশের দোকানের মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বাকরখানি বানাচ্ছেন গত ৪০টি বছর ধরে। পনিরের বাখরখনি তৈরিতে প্রতিদিন ১-২ কেজি ঢাকাই পনির লাগে বলে জানালেন। তবে মাঝে মাঝে তার দোকানে কাবাবের বাকরখানিও তৈরী হয়ে থাকে। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে দেখা গেল, বেশিরভাগ দোকানেই মোটামুটি তিন-চার রকমের বাকরখানি পাওয়া যায়। নোনতা বাকরখানি, মিষ্টি বাকরখানি, পনিরের বাকরখানি আর ঘি বাকরখানি।
তবে অদূরেই নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত 'নাসু ফারুক এর সেরা বাকরখানি'তে মিলবে সাত রকমের বাকরখানি! অনেকের মতে, এটিই বাকরখানির জন্য এই মুহূর্তে পুরান ঢাকার সর্বোৎকৃষ্ট দোকান। আমাদের পরের গন্তব্য সেখানেই।
পনির, ঘি, খাস্তা, মিষ্টি, নোনতা ঘি, মিষ্টি ঘি আর ঝাল বাকরখানি- এই সাত রকম বাকরখানির স্বাদ পাবেন ৪৫ বছরের পুরনো এই দোকানে। দোকানের কর্মচারী এনামুল হক জানালেন তাদের সাত রকম বাকরখানির আদ্যোপান্ত।
নোনতা ঘিয়ে তৈরী বাকরখানি কিছুটা শুকনো থাকে তবে খুব মচমচে হয়; চা আর দুধ দিয়ে খেতে ভীষণ ভালো এ বাকরখানি। মিষ্টি ঘিয়ের বাকরখানিতে দেয়া হয় তিল আর এলাচের নির্যাস।ঝাল বাকরখানিতে মাংস বা কিমা ব্যবহার করা হয়। এনামুল বলেন, "কুরবানির গোশত জ্বাল দিতে দিতে যখন ঝুরা হয়ে যায় তখন সেটা নিয়ে এলে আমরা তা দিয়ে বাকরখানি বানিয়ে দিই। মুরগির মাংস থেকে হাড় ফেলে দিয়ে নিয়ে আসলে সেটা দিয়েও আমরা কাবাব বা কিমা বাকরখানি বানিয়ে দিই।"
ঈদের মতো বিশেষ উৎসবগুলোতে এ ধরণের বাকরখানির অর্ডার বেশি আসে বলে তিনি জানান। যেহেতু কিমা বা মাংসের বাকরখানিগুলো অর্ডার অনুযায়ী বানানো হয় তাই জানতে কৌতূহল হলো এসব বাকরখানি কীভাবে তৈরি হয়। এনামুল সাহেব সে কৌতূহল মিটিয়ে জিভে জল এনে দিলেন। কথা বলে জানা গেল, ঝাল বাকরখানি মাংসের মসলা, বিট লবণ, নুডুলসের মসলা দিয়ে বানানো হয়।
পুরান ঢাকাবাসীর কাছে বাকরখানি অনেকটা ডালভাতের মতো, প্রতিদিনের আহার। সত্তরোর্ধ্ব হেনা বেগমের দাবি এমনটাই। এই বয়সেও নিজে এসে বাকরখানি কিনছিলেন। দিনে তার দু'বেলা বাকরখানি লাগবেই- সকালের নাস্তায় আর বিকালের চায়ের সাথে। মাংস, তরকারি সবকিছু সহযোগেই বাকরখানি খেয়ে থাকেন। এমনকি দুধ আর চিনির সঙ্গে জ্বাল দিয়েও বাকরখানি খান মাঝেমধ্যে, স্বাদ হয়ে ওঠে অনেকটা শাহী টুকরার মতো।
স্থানীয়দের কাছে বাকরখানির আরেকটি প্রচলিত নামও আছে- 'শুকা' বা নিমশুকা (শুকনা) রুটি। গরম ধোঁয়াওঠা চা আর বাকরখানিতে শুরু হয় পুরান ঢাকাবাসীর সকাল; তবে শুধু তাদের কথা বললেই হবে! যারা ঢাকার স্থানীয় নন, তাদের কাছে এই রুটির কদর কেমন!
কুমিল্লার মেয়ে রাবেয়া খাতুন বিয়ে করে থিতু হন ঢাকাতে। জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়ে দিয়েছেন পুরান ঢাকায়। স্বভাবতই বাকরখানি রয়েছে তার পছন্দের খাবারের তালিকায়।
রাবেয়া বাকরখানি প্রথম দেখেন নারিন্দায়। ভেবেছিলেন এও বুঝি এক রকম পরোটাই! পাতলা রুটি বেলে বড় বড় তন্দুরের ভেতর সেঁকা হচ্ছে, তারপর একের পর এক লোহার শিক দিয়ে তোলা হচ্ছে। অবাক হয়ে রাবেয়া ভাবতেন, তেলছাড়া কীভাবে এমন রুটি বানানো সম্ভব! তন্দুরের গায়ে রুটিগুলো আটকেই বা থাকে কীভাবে!
রাবেয়া খাতুনের বয়স এখন ৬৬। তার সবচেয়ে প্রিয় ঘিয়ের বাকরখানি। তাতে যদি তিল ছিটিয়ে দেওয়া হয়, তবে তার কাছে বাকরখানির স্বাদ বেড়ে যায় বহুগুণ। মিষ্টি বাকরখানি খেতেও ভালবাসেন, তবে ডায়বেটিসের জন্য এখন তাতে চিকিৎসকের মানা।
নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়ির দিকে রাস্তাটিতে ঢুকলেই মসজিদের পাশে প্রথম যে বাকরখানির দোকানটি নজর কেড়ে নেবে তা মোহাম্মদ রুমানদের। পুরনো দোকানটির কোনো 'নাম' নেই। তবু এই নামহীন দোকানই গত ১৫ বছর ধরে ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে আছে। মিষ্টি, পনির, খাঁটি গাওয়া ঘি, শুখারুটি আর খাস্তা (কাচ্ছা)- এই পাঁচ রকমের বাকরখানি মিলবে এখানে। এখানকার ঘিয়ের বাকরখানিগুলো খুব সুন্দর নকশা করা, কিনারায় ছাঁচকাটা।
জানতে চাইলাম, শুখারুটি আর খাস্তা বাকরখানির মধ্যে পার্থক্য কী? রুমান জানালেন, খাস্তা বাকরখানি হয় মুচমুচে, নরম। শুকনো বাকরখানির চাইতে এখানে তেল বা ডালডার পরিমাণ বেশি থাকে।
তাদের দোকানে পনিরের বাকরখানি বিক্রি হচ্ছে গত সাত-আট বছর ধরে। ঠিক কবে থেকে নারিন্দাতে পনিরের বাকরখানি চলছে সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারলেন না রুমান। শুধু জানালেন, ক্রেতার মাঝে ক্রমশ চাহিদা তৈরী হতে থাকায় দোকানগুলো একসময় বাকরখানির ওপর পনিরের টুকরা মেশাতে শুরু করে। হালকা নাস্তা হিসেবে বাকরখানি খাওয়া হলেও এটি তৈরী আর বিকিকিনি চলে সারাদিন। রুমান জানান, সকাল ৬টা থেকেই বাকরখানির তন্দুর জ্বলতে থাকে, চলে বিকেল ৩টা-৪টা পর্যন্ত। এরপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে সন্ধ্যার পর থেকে আবার চলে রাত ১১টা পর্যন্ত।
একই রাস্তায় রয়েছে 'বিসমিল্লাহ বাকরখানি' নামে আরেকটি পুরনো দোকান। এখানেও নিমসুখা, কাচ্ছা, ঘি, পনির আর মিষ্টি- এই পাঁচ রকমের বাকরখানির সমাহার। দোকানের কর্মচারী মো. জুবায়েদ হোসেনের কাছে জানতে চাই পনিরের বাকরখানি নিয়ে। তিনি জানান, আগে পনিরের বাকরখানি এভাবে দেদারসে বিক্রি হতো না। সবাই পছন্দও করতো না, ক্রেতাদের কেউ অর্ডার দিলে তারা বানিয়ে দিতো। কিন্তু এখন প্রায় সব দোকানেই এটি মিলবে।
নারিন্দার সবচেয়ে পুরনো বাকরখানির দোকান হিসেবে জানা গেল 'বাদশাহ বাকরখানি'র নাম। প্রায় ২৫ বছর যাবত তারা পুরান ঢাকার অন্যতম আকর্ষণীয় এই খাবারটি তৈরী করে যাচ্ছে। তাদের দোকানে চার রকমের বাকরখানি তৈরী হয় যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলে মিষ্টি বাকরখানি।
তবে পনির, মিষ্টি, নোনতা, কাবাব, কিমা এসব বাহারি বাকরখানির ভিড়ে লালবাগে আমরা আরও সন্ধান পেয়েছিলাম কালোজিরা বাকরখানির। লালবাগের নওয়াবগঞ্জেই আবু সায়িদের বাকরখানির দোকানে অন্যান্য বাকরখানির সাথে কালোজিরার বাকরখানিও বিক্রি হয়। এখানে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছেন আলী আকবর। বাকরখানির ৩০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, "এটি সম্পূর্ণ ভেজালমুক্ত খাবার। বাকরখানি বানানোর উপকরণগুলোতে যদি কোনরূপ ভেজাল থাকে, তাহলে সে বাকরখানি মুচমুচে ও নরম হবে না, শক্ত হবে, যা খাওয়া যাবে না।"
আলী আকবর জানান, প্রতিদিন ২০-২৫ কেজি বাকরখানি বানান তারা। কাজ করতে করতে গ্রাহকের চাহিদা বুঝে গেছেন। তাই চাহিদা অনুযায়ীই বাকরখানি বানানো হয়। অতিরিক্ত থেকে গিয়ে বাসি বা নষ্ট হবার সুযোগ নেই। তবে বাড়িতে কিনে আনা বাকরখানি এয়ারটাইট বক্সে রেখে খাওয়া যাবে প্রায় মাসখানেক।
উর্দু লেখক হেকিম হাবীবুর রাহমান তার 'ঢাকা পাচাস বারাস পাহলে' গ্রন্থে আরও তিন ধরনের বাখরখানির কথা উল্লেখ করেছেন: গও জোবান, শুকি এবং নিমশুকি। কাইচারুটি এবং মুলামও বাখরখানির অন্যান্য ধরন। আরেক ধরনের বাকরখানি রয়েছে যা 'কাশ্মীরি' নামে পরিচিত। এ বাকরখানি দেখতে গোল নানের মতো, তবে মচমচে, স্তরযুক্ত এবং এটিতে তিলের বীজ দেওয়া হয়। তিনি এই বইয়ে আরেক ধরনের বাকরখানি রুটির কথাও উল্লেখ করেছেন। এটি তার বাল্যকালে তৈরি হতো, যেখানে খামিরের সঙ্গে মোহনভোগ বা সুজির হালুয়া মিশিয়ে বানানো হতো। কিন্তু এই অভিনব পদ বেশিদিন চলেনি।
বাকরখানির পেছনের শ্রম
ইউটিউবের আমলে সুস্বাদু খাবার খেতে এখন আর সবসময় বাইরে পা বাড়াতে হয় না। ঘরে বসেও মনমতো তৈরী করা যায় পছন্দের খাবারগুলো। কিন্তু বাকরখানি ঘরে তৈরী করা সত্যিই 'চ্যালেঞ্জিং'।
এর রন্ধনশৈলী নিয়ে হেকীম হাবিবুর রহমানের বইটিতে লেখা আছে, খামির তৈরির জন্য ডোকে যত ভালোভাবে মথে নেয়া যাবে ততো এর সৌন্দর্য বাড়বে। ময়দার সঙ্গে মাওয়া মিশিয়ে তা এমনভাবে দলন করা হয় যে পৌষ মাসের রাতেও তা দলনকারীরা ঘামে ভিজে যায়।
বর্তমানে বাকরখানি তৈরিতে দরকার হয় ময়দা, ডালডা/তেল, পানি ও একটি তন্দুরের। এগুলোর জোগাড় খুব একটা কঠিন নয়। কিন্তু এরপরের কাজগুলো করতে আপনাকে নিপুণতার পরিচয় দিতে হবে। প্রথমে উপকরণগুলোর সহযোগে খামি তৈরি করা হয়। তৈরিকৃত খামি থেকে কেটে ছোটো ছোটো কোয়া তৈরি করা হয়। এই কোয়াগুলোকে বেলুনে বেলে গোলাকার আকৃতি দেয়া হয়। মাঝখানে ছুরি দিয়ে লম্বা করে তিনটি দাগ কেটে দেওয়া হয়। এরপর এর একপাশে পানির সামান্য প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেয়ালে আটকে দেওয়া হয়। ৫ থেকে ৭ মিনিটে তৈরি হয়ে যায় বাকরখানি। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কিছু বাকরখানির চারপাশে ইদানিং খাঁজকাটা করে দেয়া হয়।
সুস্বাদু বাকরখানির নেপথ্যে করুণ প্রেমকাহিনী
বাকরখানি বানানোর পরিবেশ এবং শীর্ণপ্রায় দোকানগুলোর দিকে তাকালে কারো মনেই আসবে না যে, এটি আদতে এক অভিজাত খাবার। এ খাবারের নামটাই এসেছে খোদ রাজপরিবারের সদস্যের নাম থেকে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে বাংলার বহু আলোচ্য ও বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন আগা মুহাম্মদ বাকের খান। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খানের পালক পুত্র। শুরু থেকেই আগা বাকের খানকে মুর্শিদকুলি খান স্নেহ ও ভরসা করতেন। তিনি তাকে নিজ পুত্রের মতো লালন পালন করেন, শেখান রাষ্ট্রবিদ্যা আর যুদ্ধবিদ্যা। এভাবেই মুর্শিদকুলি খানের স্নেহের ছায়াতলে বড় হতে থাকেন আগা বাকের। পরে মুর্শিদকুলি খান আগা বাকেরকে চট্টগ্রামে তার নিজস্ব সেনাবাহিনীর কমান্ডার প্রধান নিযুক্ত করেন। মুর্শিদাবাদের রাজদরবারে একদিকে রাজা রাজবল্লভ এবং অন্যদিকে আগা বাকের খান ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ।আগা বাকেরের প্রেয়সী ছিলেন আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম। প্রথম দেখায় প্রেম বলতে যা বোঝায় ঠিক তা-ই ঘটেছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু খনির প্রতি আগা বাকেরের এই প্রেমে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উজির আলা জাহান্দার খাঁর পুত্র কোতয়াল জয়নুল খান।
জয়নুল একবার খনি বেগমের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে আগা বাকের সেখান থেকে খনি বেগমকে রক্ষা করেন। জয়নুলও পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু গুজব ওঠে, জয়নুলকে হত্যা করে তার মৃতদেহ গুম করে রেখেছে আগা বাকের। মুর্শিদকুলি খান ছিলেন ন্যায়বিচারক। তাই তিনি শাস্তিস্বরূপ তার স্নেহের পুত্র আগা বাকেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাঘের বদ্ধ খাঁচায় বন্দী করে রাখেন।
কিন্তু বাকের তার সাহস এবং শক্তির জোরে বাঘটিকে মেরে খাঁচা থেকে মুক্ত হন।
এদিকে বাকেরের বন্দিত্বের সুযোগে জয়নুল খনি বেগমকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় দক্ষিণ-পূর্বদিকের ভাটি অঞ্চলের এক গভীর জঙ্গলে। খনি বেগমকে বশে আনতে সেখানে জয়নুল অনেক অত্যাচার চালাতে থাকে তার ওপর। আর এদিকে খবর পেয়ে বাকের সেনাপতি কালা গাজীকে নিয়ে রওনা হন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে। অন্যদিকে জয়নুলের পিতা জাহান্দার খাঁও দুশ্চরিত্র পুত্রের বিরুদ্ধে বাহিনী নিয়ে জায়গাটি ঘিরে ফেলেন। এরপর মুর্শিদকুলি খানের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পিতা জাহান্দার নিজ তরবারি দিয়ে পুত্র জয়নুলকে আঘাত করেন। শুধু তাই নয়, খনি বেগমকে বশে আনার জন্য যে বিষাক্ত সাপ দিয়ে ভয় দেখানো হতো, সে সাপও তাকে মারে এক ছোবল। জয়নুল বুঝতে পারেন, তিনি আর বাঁচবেন না, খনিকেও পাবেন না। তাই তিনি নিজের তরবারি খনির বুকে বসিয়ে দেন। আগা বাকের যখন পৌঁছান ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। তিনি গিয়ে মৃত্যুপথযাত্রীকে ক্ষণিকের জন্য পান।
খনিকে সমাধিস্থ করা হয় বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে (বর্তমান পটুয়াখালী- বরিশাল)। খনির মৃত্যুর পর বাকের ভেঙ্গে পড়েন। তবে তিনি ছিলেন রন্ধনবিলাসী। বাকের-খনি নামে তিনি একটি বিশেষ রুটির রেসিপি বানান। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের অমর প্রেমের স্মৃতি রক্ষার্থেই সে বিশেষ রুটির আয়োজন। প্রথমে এর নাম ছিল বাকের-খনি। সে থেকে অপভ্রংশ হয়ে মানুষের মুখে মুখে একসময় এটিই রূপ নেয় বাকরখানিতে।
দীর্ঘ একটা সময় আগা বাকের বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন। তার নামানুসারেই বাকেরগঞ্জ জেলার নামকরণ হয় (বর্তমান বরিশাল)। তার শাসনামলে বাকেরগঞ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আর্মেনিয়া, পারস্য থেকে তখন বণিকরা আসতেন এ অঞ্চলে। এভাবেই তার রুটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পরে অবশ্য মুর্শিদকুলি খানের মেয়েকে বিয়ে করেন আগা বাকের।কিন্তু খনি বেগমের স্মৃতি কখনোই তিনি ভুলতে পারেননি। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন তার মৃত্যুর কয়েক শতক পরেও সবাই মনে রাখুক তাদের প্রেমকে। আর তাই হয়তো যতদিন বাকরখনি আছে, ততোদিন তাদের এই প্রণয় কাহিনী হয়ে থাকবে অমর ইতিহাস হয়ে।
বাকরখানি নিয়ে এই ইতিহাস লেখা আছে নাজির হোসেনের বিখ্যাত 'কিংবদন্তির ঢাকা' বইয়ে। তবে ইন্টারনেট ঘাঁটলে বাকরখানির উৎপত্তি নিয়ে ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। কারো কারো দাবি, বাকরখানির উৎপত্তি স্থান আফগানিস্তান। আফগানিস্তান ও রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এ রুটির প্রচলন।
বাকরখানি যায় বিদেশ
'ঢাকা পাচাস বারাস পাহলে' গ্রন্থে বাকরখানির পরিচিতির ব্যাপারে বলা হয়েছে, "ঢাকার বাকরখানি এতটাই আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধি লাভ করলো যে ঢাকা একাই এ ব্যাপারে গর্ব অনুভব করতে পারে, ঢাকা ছাড়া সমগ্র হিন্দুস্তানের কোথাও হিন্দু রুটিওয়ালাগণ বাকরখানি তৈরি করে না। বরং এখানে শুধু বাকরখানির জন্যই হিন্দুরাও এ পেশাকে অবলম্বন করেছে। বাকরখানি ঢাকা শহরের এত বিখ্যাত যে সমগ্র বাংলায় এখান থেকে তা সওগাত হিসেবে প্রেরণ করা হয়।"
ইন্টারনেট তথ্যসূত্র বলছে, সে ধারা বজায় রেখে এখনও পুরান ঢাকার বিখ্যাত এই বাকরখানি যাচ্ছে কুয়েত, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তবে নাজিমুদ্দিন রোডের বাকরখানি বিক্রেতা এনামুল হক জানান, বাইরের দেশে ঠিক কী পরিমাণ বাকরখানি রপ্তানি করা হয়, সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। তারা নিজেরাও সরাসরি বিদেশে রপ্তানির সাথে যুক্ত নন। তবে তিনি দাবি করলেন, প্রচুর প্রবাসী রয়েছেন, যারা দেশ থেকে যাবার সময় বাকরখানি নিয়ে যান। অনেকে নিজে না গেলেও প্রবাসী স্বজনকে পাঠিয়ে থাকেন। মজা করে জানালেন, দোকান থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে বাকরখানি ডেলিভারি দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের!
বেকারিতে বাকরখানি
রাত-বিরেতে বাকরখানি খেতে ইচ্ছে হলে কি পুরান ঢাকাতে ছুটতে পারবেন! তার দরকারই হবে না। কারণ বাকরখানি আজকাল মিলছে পাড়ার কনফেকশনারি, বেকারি আর সুপার শপগুলোতেও।
মগবাজারের বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারে দেখা গেল প্যাকেটজাত বাকরখানি। ৫০ টাকা মূল্যের প্যাকেটগুলোর ভেতর ছিল ১০টির মতো পিস। দোকানের কর্মচারীর কাছ থেকে জানা গেল, পুরান ঢাকার কারিগরই এই বাকরখানি বানিয়েছে।
রাস্তার ওপারে সুপার চেইন শপ মীনাবাজারে গিয়েও পেলাম বাকরখানি, তবে পুরান ঢাকার নয়। ১৮০ টাকা দামের সুদৃশ্য প্লাস্টিকের বয়াম দৃষ্টি কেড়ে নিল, লেখা 'ইয়া নবাবি নারিকেল বাকরখানি'। এর প্রস্তুতকারক 'রিলায় ফুডস' নামক একটি কোম্পানি।
পুরান ঢাকার আবুল হাসনাত রোডে অবস্থিত আরেকটি ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান আনন্দ কনফেকশনারি। এখানে বাকরখানি সরবরাহ করে থাকে 'নাসু-ফারুকের বাকরখানি'। তবে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তারা সুপার শপগুলোতে বাকরখানি সরবরাহ করতে পারেন না। দোকানের এক কর্মচারীর ভাষ্যে, "বাকরখানি পুরোটাই বানানো হয় হাতে। এখানে কোনো মেশিনের ব্যবহার নেই। ফলে চাইলেও দিনে একসাথে অনেক বেশি বাকরখানি বানানো যায় না। যে পরিমাণ বানানো হয়, তাও দিনে দিনেই বিক্রি হয়ে যায়।"
জানা যায়, এখন আমরা বাকরখানি প্রস্তুতে যে উপকরণ দেখি, নবাবী আমলে তেমনটি ছিল না। নবাবদের বাকরখানি তৈরি হতো মালাই-মাখন দিয়ে। ময়দার সঙ্গে দুধের মালাই ও মাখন মিশিয়ে খামি তৈরি করে বাকরখানি বানানো হতো। মালাই-মাখনের বাকরখানি এখন আর তৈরি হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে দুধের মালাইয়ের পরিবর্তে বাকরখানিতে ডালডা ও তেল ব্যবহারের প্রচলন হয় বলে জানা যায়। তবে ঢাকার অনেক বনেদি পরিবার বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য অগ্রিম অর্ডার দিলে মালাই-মাখনের বাকরখানি এখনো সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
প্রতি পিস পাঁচ
বাকরখানি মূলত কেজি দরে বিক্রি করা হয়। তবে কিছু কিছু দোকানে প্যাকেটেও বিক্রি হয়। আবার ৫-১৫ টাকায় পিস হিসেবে কিনেও চেখে দেখতে পারবেন বিভিন্ন স্বাদের বাকরখানি।
দোকানভেদে শুখারুটি বা শুকনো বাকরখানি ১৩০ টাকা কেজি, মিষ্টি বাকরখানি ১৪০-২০০ টাকা কেজি, কাচ্ছা বা খাস্তা বাকরখানির দাম ১৪০ টাকা, কালোজিরার বাকরখানি প্রতি কেজি ১৫০ টাকা পড়বে। পনির, ঘি, তিলের বাকরখানির দাম কিছুটা বেশি। যেমন পনিরের বাকরখানি পড়বে কেজিতে ২৫০-৪০০ টাকা, ঘিয়ের বাকরখানি ৩০০-৩৫০ টাকা, মিষ্টি তিল-ঘি দেয়া বাকরখানি ২০০ টাকা কেজি। ঝাল বাকরখানির দাম পড়বে কেজিতে ৩০০ টাকার মত। তবে বিক্রেতারা জানালেন, কিমা বা কাবাব বাকরখানি বানানো হলে তারা শুধু রুটির দামটাই রাখেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাংস বা কিমাটা আসে গ্রাহকের কাছ থেকেই।
বাকরখানির ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে কবি প্রতুল মুখোপাধ্যায় তার কবিতার ভাষায় বলেছিলেন,
'আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি
বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি।
ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে হাজার টাকায় সোনা
হাতের কলম জনম দুঃখী তাকে বেচো না'- এই চরণগুলোই প্রমাণ করে বাকরখানির ইতিহাস অনেক পুরনো আর ঐতিহ্যবাহী। তা নাহলে বিখ্যাত এই কবির চরণে বাকরখানি স্থান পেত কি?