কেন গোপন মেয়ের নাম ইন্দিরা রাখেন মার্কেজ? কী ঘটেছে ইন্দিরার ভাগ্যে?
১৯৮৩ সালের মার্চ মাস। মালয়ালম ঔপন্যাসিক এম মুকুন্দান দিল্লির চাঁদনী চকে রিকশায় এক বিদেশিকে দেখতে পেলেন। তাকে দেখে খুব চেনা চেনা মনে হলো তার। "আরে, এটা কলম্বিয়ান লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ না!"
মার্কেজকে চিনে ফেলা মুকুন্দানের জন্য খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। কারণ তখনো ইন্টারনেট নামক জাদুর কাঠি এসে মানবজাতির জীবনযাপনকে খোলনলচে বদলে না দিলেও, সিরিয়াস ফিকশন পাঠকদের মানসপটে ঠিকই স্থায়ীভাবে খোদাই হয়ে গেছে মার্কেজের মুখ। কারণটা অনুমিতই, মার্কেজের কালজয়ী উপন্যাস 'ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড'। তখনকার দিনে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে কোনো সাহিত্যবোদ্ধা এই বই না পড়লে তার সামগ্রিক পাঠকসত্তাই প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য!
যা-ই হোক, মুকুন্দান চাইলেন গাবোকে ডাক দিতে। কিন্তু শেষমেশ আর ডাকলেন না। পা চালিয়ে চলে গেলেন নিজের পথে। কারণ তার মনে তখন সম্ভাব্যতা-অসম্ভাব্যতার দ্বন্দ্ব চলছে। একবার তিনি ভাবছেন, এটা গাবোই। আবার সেই তিনিই ভাবছেন, গেল বছরই নোবেলজয়ী লেখকের তো এই বসন্তকালে দিল্লিতে থাকার কথা নয়।
তবে পরদিন দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতা দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ! সত্যি সত্যিই শহরে পা রেখেছেন জাদুবাস্তবতার ঐন্দ্রজালিক মার্কেজ। কিউবান প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে, দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নন-অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট (ন্যাম) সম্মেলনে অংশ নিতে।
এ ধরনের একটি সম্মেলনে কোনো সাহিত্যিকের আসবার কথা নয়। কিন্তু মাসখানেক আগে মস্কোতে যখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দেখা হয়েছিল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে, তখন নাকি তিনি ক্যাস্ট্রোকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, "পরেরবার ভারতে আসার সময় সঙ্গে মার্কেজসাহেবকে অবশ্যই আনতে হবে!"
ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন মার্কেজের বিশাল ভক্ত। তাই ১৯৮২ সালের অক্টোবরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয়ের পর প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনিই ফোন করে অভিনন্দন জানান মার্কেজকে।
আবার ফিরে আসা যাক ১৯৮৩-তে। সেবার দিল্লিতে 'ভাই' ক্যাস্ট্রোকে স্বাগত জানাতে হাজির হয়েছিলেন গান্ধী। কিন্তু ক্যাস্ট্রোর শিবিরের লোকদের কাছে তার প্রথম প্রশ্নটাই ছিল, "মার্কেজসাহেব কোথায়?" এমন উৎকণ্ঠার কারণ, মার্কেজ তখনো বিমান থেমে নেমে পারেননি!
এরপরের কয়েকটি দিন মার্কেজের প্রতি গান্ধীর আতিথেয়তা ঠিক কেমন ছিল, তা হয়তো পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা সম্ভব নয়। তবে এটুকু জানা যায়, সফরের তৃতীয় দিন নাকি মার্কেজ এক কলম্বিয়ান কূটনীতিককে বলেন, "আমার মনে হচ্ছে ইন্দিরা বুঝি আরাকাটাকাতেই জন্মেছিলেন।" বলে রাখা ভালো, মার্কেজের নিজের হোমটাউন ক্যারিবীয় উপকূলের কাছে আরাকাটাকা শহর, যে শহরের আদলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স'-এর কাল্পনিক ম্যাকন্ডো শহর।
সেবার মার্কেজের ভারত সফরের পরের বছরই অবশ্য আততায়ীরা হত্যা করে ইন্দিরা গান্ধীকে। মার্কেজ তার নিজের জীবনে প্রচুর পরিমাণে সহিংসতার সাক্ষী হয়েছেন, দুহাত ভরে সেগুলোর বিবরণও তিনি লিখেছেন। তবু ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তাকে এতটাই নাড়া দেয় যে, তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসেন, জীবনে আর কখনোই ভারতের মাটিতে পা রাখবেন না তিনি।
আর সত্যিও, পৃথিবীর আলো-বাতাসে এরপর আরো বছর তিরিশেক শ্বাস নিলেও, ভারতমুখো হননি সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সাহিত্যিক।
এতক্ষণ যা বলছিলাম, তা ছিল নিছকই ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি। এবার মূল কথাটা বলা যাক।
মাত্র কিছুদিন আগেই কলম্বিয়ান সংবাদপত্র এল ইউনিভার্সালে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, এবং পরে সেটি মার্কেজের দুই আত্মীয়ের বরাত দিয়ে নিশ্চিত করেছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসও।
সংবাদটি হলো : মার্কেজের একটি কন্যাসন্তান ছিল, যার নাম তিনি রেখেছিলেন ইন্দিরা। ঠিকই ধরেছেন, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামানুসারে।
মার্কেজ-তনয়া ইন্দিরা কাটোর মা লেখক ও সাংবাদিক সুজান কাটো, যিনি মেক্সিকো সিটিতে বাস করেন, এবং ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানান। মার্কেজের সঙ্গেও তিনি দুইটি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট রচনায় কাজ করেছিলেন। ধারণা করা যায়, একসাথে কাজ করতে গিয়েই নিজের চেয়ে ৩৩ বছর কমবয়সি সুজানের প্রেমে পড়েন মার্কেজ, যে প্রেমের ফসল তাদের সন্তান ইন্দিরা।
ইন্দিরার জন্ম ১৯৯০-র দশকে। তাহলে এতদিন বাদে কেন ফাঁস হচ্ছে এই খবরটি? কেন এমনকি ২০১৪ সালে মার্কেজের পরলোকগমনের পরও প্রকাশ্যে আসেনি এই চাঞ্চল্যকর তথ্য?
উত্তরটা শুনে অনেকেই হয়তো অবাক হবেন। কিন্তু নানা সূত্র থেকেই নিশ্চিত হওয়া গেছে সেই কারণ। নিশ্চিত করেছেন এখনো বেঁচে থাকা মার্কেজের সবচেয়ে বয়স্ক বন্ধু গিলের্মো আঙ্গুলোও, যিনি এখন শতবর্ষ থেকে মাত্র ছয় বছর দূরে রয়েছেন।
মার্কেজের পরিবারের অন্যরা এবং কাছের বন্ধু-বান্ধবরা অনেকেই জানতেন সুজান কাটোর সঙ্গে তার প্রণয় এবং ইন্দিরার জন্ম সম্পর্কে। তবু তারা ২০২০ সালে মারা যাওয়া মার্কেজের স্ত্রী মেরসেদেস বার্চার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এ ব্যাপারটি গোপনই রেখেছিলেন।
ব্যাপারটি কতটা গোপনীয় ছিল, এল পাইসে "Indira: Gabriel García Márquez's final secret" শীর্ষক রচনায় সে বর্ণনা দিয়েছেন গুস্তাভো তাতিস গুয়েরা। তিনি লেখেন :
"যখন আমি ইন্দিরার ব্যাপারে কার্টাগেনা দে ইন্ডিয়াসে গার্সিয়া মার্কেজের আত্মীয়দের কাছে জিজ্ঞেস করি, তারা নীরব হয়ে যায়। মাত্র একবারই তারা আমাকে জানায় যে ইন্দিরা হলেন মার্কেজের মেয়ে। কিন্তু মেরসেদেস বার্চার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তারা কেউই রাজি হননি লেখক, সাংবাদিক, ফিল্মমেকার সুজানা কাটোর সঙ্গে মার্কেজের রোমান্টিক সম্পর্কের ব্যাপারে মুখ খুলতে।"
তবে বাইরের দুনিয়ার কাছে যতই গোপন থাকুক, মেরসেদের কাছ থেকে তো আর সত্যটা লুকিয়ে রাখতে পারেননি মার্কেজ। একসময় তাকে ব্যাপারটা জানাতে হয়ই। তখন মেরসেদেসের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
এ ব্যাপারে মার্কেজের জীবনীকার দাসো সালদিভার জানান, খবরটা শুনে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন মেরসেদেস। অবশ্য মার্কেজের পরিবার ইন্দিরার কথা শুনে তাকে বুকে টেনে নেয়। কিন্তু ইন্দিরার প্রতি মার্কেজের পরিবারের এই উষ্ণতাও আবার রাগিয়ে দেয় মেরসেদেসকে। তবে যত যা কিছুই হোক, সেগুলো যথেষ্ট ছিল না ৫৭ বছরের বৈবাহিক সম্পর্কে মেরসেদেস ও মার্কেজের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কে চিড় ধরাতে। বরং মেরসেদেসের কথা ভেবেই মার্কেজ ও তার গোটা পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় ইন্দিরা ও তার মায়ের অস্তিত্ব বিশ্ববাসীর কাছ থেকে গোপন রাখতে।
মার্কেজ যেমন জীবদ্দশায় প্রকাশ্যে কখনো স্বীকার করেননি ইন্দিরার পিতৃত্ব, তেমনই ইন্দিরাও তার জীবনে পড়তে দেননি মার্কেজের ছায়া। তিনি বাবার পদবী নয়, গ্রহণ করেছেন তার মায়ের পদবী, কাটো। তবে তারপরও, ২০১৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মার্কেজের সঙ্গে ইন্দিরার অন্তরঙ্গ উষ্ণ সম্পর্ক কিন্তু সবসময়ই ছিল। পিতা-কন্যার অকৃত্রিম সেই সম্পর্ক।
তাছাড়া একদিক দিয়ে ইন্দিরাও আসলে তার বাবার ভবিতব্যকেই পেয়েছেন উত্তরাধিকারসূত্রে। মার্কেজের বাবা ও দাদা দুজনকেই তাদের মায়ের পদবী গ্রহণ করতে হয়েছিল। কেননা তাদের জনকেরা তাদেরকে স্বীকার করেননি।
বাবার কাছ থেকে আরো কয়েকটি জিনিস পেয়েছেন ইন্দিরা। তার রয়েছে গভীর ও তীক্ষ্ণ চাহনি, যে চাহনির রয়েছে অন্তর্ভেদী ক্ষমতা। শক্তপোক্ত কালো ভুরু পেয়েছেন বাবার মতো।
আট বছর হলো বাবাকে হারিয়েছেন তিনি, তবে তার ঠিকই খেয়াল রাখেন দুই সৎ ভাই রোদ্রিগো গার্সিয়া ও গনজালো গার্সিয়া। এদিকে বিশ্বখ্যাত বাবা ও কৃতী মায়ের সন্তান ইন্দিরা নিজেও কর্মজীবনে বেশ ভালোই সাফল্যের দেখা পাচ্ছেন।
সামাজিক, রাজনৈতিক ও নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেমার উপর রয়েছে তার অগাধ দখল। ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অব মেক্সিকোতে ড্রামাটিক লিটারেচার অ্যান্ড থিয়েটার নিয়ে পড়াশোনা শেষে সিনেমা নিয়েই নানা ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
২০২০ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম ডকুমেন্টারি Llévate mis amores। আর্তুরো গঞ্জালেজ ভিলাসেনরের পরিচালনায় নির্মিত সেই ডকুমেন্টারিতে পরিচালকের পাশাপাশি তিনিও ছিলেন সহ-চিত্রনাট্যকার।
২০১৮ সালে মায়ের চিত্রনাট্য অবলম্বনে একটি শর্ট ফিল্মও বানিয়েছিলেন তিনি। 'হাউ গ্রেট আর ইউ, ম্যাগাজো!' নামের সেই শর্ট ফিল্মে দেখা যায়, একটি বাচ্চা মেয়ে চাইছে যেন "খারাপ সরকারের পতন হয়", এবং এক জাদুকর এসে সেই ইচ্ছাপূরণ করেও দেয়!