বিশ্ব-ভ্রমণকারী দম্পতির গল্প
ব্রিটিশ-বাংলাদেশি দম্পতি শারমিন বাহার ও রেজাউল বাহার। ২০০৮ সাল থেকে বেড়ানো শুরু করেছেন। তারপর থেকে মোট ৮১টি দেশ তাদের বেড়ানো হয়ে গেছে। এর মধ্যে চাকরি-বাকরি আর ঘর-গেরস্থালিও সামলাচ্ছেন। আর যতদিন বাঁচবেন, ইচ্ছে আছে বাকি রাখবেন না পৃথিবীর কোনো দেশই। ভবঘুরে পরিচয়েই পরিচিত হতে চান তারা, দেখতে চান নানান সংস্কৃতি আর বাঁচতে চান ফুল স্পিডে। গেল ১৫ বছর ধরেই তারা একসঙ্গে আছেন আমেরিকায়। রেজাউল একজন যন্ত্র প্রকৌশলী, কাজ করেন ইউএস মিলিটারি আর কোস্ট গার্ডের জন্য। আর শারমিন কাজ করেন সিগনার জন্য, যেটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সেবা দেয়।
প্রথমবার বাহামায়
দেখব এবার জগৎটাকে- ইচ্ছাটা তাদের জাগে ২০০৮ সালে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বাহামায় গিয়ে। ফিরে এসেই তারা সেনজেন ভিসার জন্য আবেদন করে আর ইউরোপ ঘুরতে থাকে। ২০১৩ সালে পাকাপোক্ত আমেরিকান নাগরিক হওয়ার পরে বেড়ানোয় তাদের সুবিধাই হয় বেশি।
রেজাউল তারপর স্বল্প সময়ের জন্য (মার্চ ২০২১) বাংলাদেশে এলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলছিলেন, 'যখনই সময় পাই, নতুন জায়গা সন্ধান করি। আমরা জায়গা নির্বাচনে সেখানকার সংস্কৃতি ও নান্দনিকতার ওপর গুরুত্ব দিই। সেভাবেই আমরা ৮১টি দেশ ঘুরে ফেলেছি।'
তাদের জন্য কতটা দেশ ঘুরলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং কতগুলো সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সব কাজকর্ম সেরেও তারা বছরে কমপক্ষে ১০টি দেশ ঘোরেন।
কেমন করে সম্ভব হয় জানতে চাইলে রেজাউল বলেছিলেন, 'বছরে থাকে ২০টি ছুটি, সেসঙ্গে মেলাই সরকারি ছুটিগুলো। আর যদি কোনো একটা ছুটি সোমবারে পড়ে তবে আমরা চারদিনের ছুটি নেই আর পুরো সপ্তাহ বেড়াই। ওই নয়দিনে আমরা দুটি দেশ বেড়িয়ে নেই।'
পছন্দের দেশ কোনটা জানতে চাইলে বলেন, 'এটা সহজ প্রশ্ন কিন্তু উত্তর জটিল। সবার ওপরে কোনো জায়গাকে স্থান দেওয়া ভারী মুশকিল। তবু বলা যায়, মিশর, মঙ্গোলিয়া, আইসল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চিলি, জর্ডান আমাদের পছন্দের তালিকায় ওপরের দিকেই আছে। মিশর বেড়ানো সত্যি অতীত বেড়ানোর মতোই ব্যাপার। আর বিস্তীর্ণ শূণ্যতা অনুভবের জন্য মঙ্গোলিয়ার তুলনা হয় না। আইসল্যান্ডেরও আছে নিঃসঙ্গতার সৌন্দর্য। প্রতি ১০-১৫ মিনিট পর পর সেখানকার প্রকৃতি বদলায়।'
রেজাউল আরও বলছিলেন, 'সংস্কৃতির উচু নীচ, বড় ছোট বলে কিছু নেই। আমরা যদিও ভিন্ন ভাষাভাষী, সীমানা আলাদা, কিন্তু এক পৃথিবীরই সন্তান। আমরা সমতায় বিশ্বাসী। পৃথিবী আসলে আমাদের জন্য বড় খোলা ডালা নিয়ে বসে আছে কিন্তু আমরা নিতে পারছি না, নিজেদের তুচ্ছ চাহিদা আর প্রয়োজনের কাছে বন্দি থাকছি। কোথা থেকে এসেছেন আর কোথায় থাকেন – তা কোনো ব্যাপার নয়, ব্যাপার হলো আপনি কেমন জীবন যাপন করেন। জীবনকে নেক্সট লেভেলে নেওয়ার চাইতে নেক্সট জার্নিতে যাওয়ার আগ্রহই আমাদের বেশি।'
টাকার সংস্থান কিভাবে হয় জানতে চাইলে তারা বলেন, 'আমরা দুজনেই ফুল টাইম ওয়ারকার। টাকা আমরা একসঙ্গে রাখি। আর তা আমাদের প্রয়োজন মেটায়।'
এন্টার্কটিকায় বাহার দম্পতি
১৫ ডিসেম্বর রেজাউল ফেসবুকে লিখছেন- 'আমাদের শেষ মহাদেশ, আমাদের শেষ প্রান্ত-এন্টার্কটিকা। আর ৪ দিন পরেই আমাদের এই ট্রিপ; প্ল্যান-প্রোগ্রামিং শুরু আরো বছর পাঁচেক আগে। প্লানিংয়ের মূল অংশ-ফাইনান্সিং, টাকা। বছরে অনেক দেশ ঘুরলেও এন্টার্কটিকা যাবার মতো এতগুলো টাকা খরচের সাহস বছর দুই আগেও ছিলো না, শাম্মী আর আমি দুইজন মানুষ আমরা, মূলত শাম্মীর ইচ্ছা আর জমানো টাকা থেকেই বছর দুই আগে বেশ কিছু টাকা জমে গেলো।'
'কী আছে জীবনে- এই ধারণা মাথায় বছর দুই আগে কেটে ফেললাম এন্টার্কটিকা ট্রিপ। ট্রিপ কাটা হলো সিলভার-সী এক্সপেডিশন এর সঙ্গে। একটু বলে রাখা ভালো, এন্টার্কটিকা রিমোট কন্টিনেন্ট, এখানে সামার বলতে ডিসেম্বর, এ সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা শূণ্য ডিগ্রি। ১৯৫৯ সালে একটা ট্রিটি এগ্রিমেন্ট হয়, মোট ৫৪টা দেশ এই ট্রিটির আওতায়। ট্রিটির মূল উদ্দেশ্য এই রিমোট মহাদেশকে প্রটেক্ট করা সারা মানব জাতির জন্য। ট্রিটির একটা অংশ- এই পুরো মহাদেশে কখনোই একশর বেশি লোক একসঙ্গে পা ফেলতে পারবে না (রিসার্চ ছাড়া), ট্রিটির এই অংশের জন্যই এন্টার্কটিকা ব্যয়বহুল।'
'বড় কোনো ক্রুজ শিপ এখানে যাবে না, গেলেও মানুষ শিপ থেকে নামতে পারবে না। কাজেই এন্টার্কটিকার জন্য আছে অল্প কিছু এক্সপেডিশন শিপ, মাঝারি আকারের। ১০০ থেকে ২৫০ জন যাত্রী বহন করতে পারে। খুব কম মানুষই এন্টার্কটিকার দিকে যায়, যারা যায় তারাও জীবনে একবার। আমাদেরও একবারের জন্য যাওয়া, কাজেই সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে ভালো এক্সপেডিশন কোম্পানী সিলভার-সীর সাথেই আমাদের বুকিং।'
'এই গ্রুপের সাথে আছি অনেক দিন, মাঝে মাঝে ভ্রমণের পোস্ট দেই এখানে, ভ্রমণ আমাদের নেশা, ভয়ঙ্কর নেশা।…. কদিন পরেই শেষ মহাদেশটিতে পা ফেলবো, এ যে কি ভয়ঙ্কর আনন্দ সেটা কিভাবে বলা যায়, আমার জানা নেই।'
ডিসেম্বর ২৪: এন্টার্কটিকা ডে ওয়ান
রেজাউল তাদের ওয়েবসাইটে লিখছেন – দুইদিন লাগল ভয়াল ড্রেক প্যাসেজ পাড়ি দিতে। শেষে চোখ মেললাম অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলার দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপে। আমি স্যুট ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই ঠান্ডায় ধরল, নিঃশব্দতাও জেঁকে বসল। ভিতরে ভিতরে আমি কিন্তু উত্তেজিত। অনেক শ্রম আর সাধনার পরে আমরা এখানে আজ। এটা কি পরীরাজ্য? স্বপ্নে দেখা কোনো জগত? কোনো কিছুর সঙ্গেই এর তুলনা হয় না। আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না বলে সিলভারসীর জাহাজের ওপরে থাকলাম সকালটা, নামলাম না।
বিকালে আমরা নামলাম স্বপ্নভুমিতে। দ্বীপটা গোলাকার, পানির নীচে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে, বড়জোড় আধা মাইল প্রস্থে। কিছু পরে আমাদের জাহাজ সাবধানে জ্বালামুখের কাছে গেল আর জায়গাটিকে তখন এন্টার্কটিকা লাগল না মানে কোনো বরফ নেই এখানে বরং কালো লাভার ছড়াছড়ি। এদিক ওদিক কিছু পরিত্যক্ত স্থাপনা দেখলাম। মনে হলো অন্য কোনো গ্রহে এসেছি। ১৯৭০ সাল অবধি এখানে একটা তিমি শিকারের ব্রিটিশ স্টেশন ছিল। আগ্নেয়গিরির ঘুম ভাঙলে ওরা পালায়। ব্রিটিশ সম্পদের লোভে কোথায় যায়নি বলতে পারেন? ডিকশনারিতে লোভী শব্দটি ব্রিটিশ শব্দের পাশেই থাকা দরকার।
ডে টু
গুড মর্নিং অ্যান্ড মেরি ক্রিসমাস। মিকেলসন হারবার যাচ্ছি আজ সকালে। পেঙ্গুইনদের স্বর্গরাজ্য এটা। আমরা জেনেছিলাম, এটা পেঙ্গুইনদের ডিম পাড়ার মৌসুম কিন্তু আবহাওয়া খারাপ, ওরা খুব সুবিধা করতে পারছে না। ডিমে তা দেওয়ার জন্য ওদের শুষ্ক পাথুরে জায়গা দরকার। অতীতে এখানে তিমি শিকারীদের খুব দাপট ছিল। প্রথমে তারা ছোট ছোট জাহাজ এনেছিল পরে বড় বড়। আগামীকাল আমরা একটা জায়গা দেখব যেখানে তারা জাহাজ তৈরির কারখানাও বানিয়েছিল। বিকালে আমরা কিয়েরভা গুহার দিকে গেলাম। কিন্তু নামতে পারলাম না। এখানে বড় বড় আইসবার্গ ছিল, আর পেঙ্গুইন। আসলে মহাদেশটা তো পেঙ্গুইনদেরই।
উল্লেখ্য এন্টার্কটিকায় বাহারদের চতুর্থদিন ছিল ২৭ ডিসেম্বর। পুরো সময়টার বিবরণই বাহার দিয়েছেন তাদের ওয়েবসাইটে। মোট পনেরো দিনের ট্যুর ছিল তাদের এন্টার্কটিকায়।
- মূল প্রতিবেদন: Tale of a globe-trotting couple
- ভাষান্তর: সালেহ শফিক