৩৩ বছর ধরে শহুরে বাঙালির শাড়ি পরার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে নাম...
উৎসব-পার্বণের জন্য বিশেষ শাড়ি হোক বা রোজকার পরার জন্য সাদাসিধে শাড়ি, দেশীয় তাঁতের শাড়ি বলতে একসময় শুরুতেই মাথায় আসতো প্রবর্তনার নাম। ৩৩ বছর ধরে শহুরে বাঙালির শাড়ি পরার স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে এই নামটি। শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে শাড়ি বিক্রি করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না কখনোই।
শহুরে মানুষজন যখন দেশীয় তাঁতশিল্পের কদর ভুলতে বসে ঠিক তখনই হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছিল শিল্পের পুনরুত্থানে; এর মধ্যে প্রবর্তনা উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু করে ২০২২ সাল পর্যন্ত, ৩৩ বছরে প্রবর্তনায় অনেক কিছু বদলে গেলেও বদলায়নি তাদের দেশীয় তাঁতশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা।
আশির দশকের শেষ দিকে দেশে তাঁতশিল্পের দুরাবস্থা খতিয়ে দেখতে একটি গবেষণা চালায় এনজিও উবিনিগ। এর অংশ হিসেবে টাঙ্গাইলে গিয়ে তাঁতিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ও তাদের সাথে কথা বলে তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন তারা। সেই সময় তাঁতিরা তাদের প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রচার-প্রচারণার অভাবকেই দায়ী করেন। উবিনিগের কাছে 'মার্কেটিং' এর জন্য সাহায্য চান তারা।
সেসময়ই তাঁতের হারিয়ে যাওয়া গর্ব ও তাঁতিদের কর্মসংস্থান উদ্ধার করার লক্ষ্যে ফরিদা আক্তার ও তার সহকর্মীরা গড়ে তুলেছিলেন তাঁত প্রবর্তনা সমিতি। যা পরবর্তিতে শুধু প্রবর্তনা নামে ঢাকার শিক্ষিত রুচিশীল মধ্যবিত্তের দেশীয় শাড়ির জোগানদাতায় পরিণত হয়।
প্রবর্তনা শুরু থেকেই তাঁতের শাড়ির বাজার বৃদ্ধির চেষ্টা করার পাশাপাশি তাঁতশিল্প ও দেশের অর্থনীতিতে ভোক্তাদের অবদান সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছে। প্রবর্তনার প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্বাস করেন, "ক্রেতা ও ভোক্তা হিসেবে যে নাগরিক দেশে উৎপাদিত দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধিতে সক্রিয় সহায়তা করে না, দেশের সার্বভৌমত্ব ও অর্থনীতিকে বিদেশের পদানত করার দায় দায়িত্ব সেই নাগরিকের ওপরেও বর্তায়।"
তাই ভোক্তারাও যেন তাঁতশিল্প বাঁচিয়ে রাখতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তারা। সেজন্য তাঁতিদের নিয়ে বছরে কয়েকবার আয়োজন করা হতো তাঁত উৎসবের। যেখানে তাঁতের শাড়ি ছাড়াও থাকতো দেশীয় সংস্কৃতির নানা উপাদান। এতে ক্রেতাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগের ফলে তাদের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ হতো তাঁতিদের।
প্রবর্তনার সহপ্রতিষ্ঠাতা ফরিদা আক্তার বলেন, "সেসময় বাজারে নানা বিদেশি কাপড়ের ভিড়ে ক্রেতারা আলাদা করে তাঁতের কাপড় খুঁজে পেত না। আমরা যখন আলাদা করে টাঙ্গাইলের এক্সক্লুসিভ তাঁতের কাপড় বিক্রি করতে গেলাম তখন বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছিলাম।"
শুরুটা শুধু তাঁতের শাড়ি দিয়ে হলেও ক্রমেই দেশীয় ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য শাড়িও যোগ হয় প্রবর্তনায়। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, সিলেটি মণিপুরী শাড়ি আর ঢাকাই জামদানীর পাশাপাশি প্রাকৃতিক রঙে নিজেদের কারখানায় বানানো ভেজিটেবল ডাই, টাই-ডাইয়ের শাড়িও আছে এখানে। শাড়ির ধরণ যা-ই হোক, কাপড়ের কাঁচামালে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক সুতা না থাকলে তা প্রবর্তনায় ঠাঁই পায়না। সুতি হলে তা পুরোপুরি সুতি আর সিল্ক হলে তা পুরোপুরি প্রাকৃতিক রেশমের সুতা হতে হবে।
"সুতি বা হাতে বোনা কাপড়ের কথা আসলে প্রথমেই প্রবর্তনার নাম আসবে। খাদ্য যেমন নিরাপদ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কাপড়ও নিরাপদ হওয়া দরকার। সিনথেটিক কাপড় কিন্তু নিরাপদ নয়। তাই সিনথেটিক কোনো সুতার কাপড় প্রবর্তনায় থাকেনা," বলেন ফরিদা আক্তার।
গত প্রায় একযুগ ধরে ভেজিটেবল ডাইয়ের কাজ করছে প্রবর্তনা। গাজীপুরের কোনাবাড়িতে নিজেদের কারখানায় নানা প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে তৈরি করছেন শাড়ি আর নানা ডিজাইনের গজ কাপড়। প্রাকৃতিক রঙের উৎসের মধ্যে আছে হরিতকি, খয়ের, সুপারি, পেঁয়াজের খোসা ইত্যাদি। প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করে বানানো শাড়িগুলো বেশ নরম হয়। এগুলো দেখতে যেমন আভিজাত্যপূর্ণ, পরতেও তেমন আরামদায়ক।
শাড়ি ছাড়াও প্রবর্তনায় আছে নিজস্ব কারখানায় তৈরি গজ কাপড়, ওড়না, শাল, পাঞ্জাবী, ফতুয়া, কোটি ওয়ানপিস, সেলাই ছাড়া থ্রিপিস, কাপড়ের ব্যাগ, প্রাকৃতিক সাবান, দেশের নানা স্থানের ঐতিহ্যবাহী নকশীকাঁথা, শীতলপাটি, হাতপাখা প্রভৃতি। প্রবর্তনার পাঞ্জাবী ক্রেতাদের কাছে বিপুল জনপ্রিয় সামগ্রী। প্রতি ঈদে প্রবর্তনার পাঞ্জাবী কেনাটা অনেকেই রেওয়াজ হিসেবে পালন করেন। চাইলে প্রবর্তনার গজ কাপড় থেকে পছন্দ করে নিজের চাহিদামতো ডিজাইনে পাঞ্জাবী কাস্টমাইজ করে নেওয়ার সুবিধাও আছে এখানে।
শুরুর দিকে প্রবর্তনায় ক্রেতা হিসেবে মধ্যবয়সী মানুষজন আসলেও বর্তমানে তরুণদের আগ্রহ তুলনামূলক বেশী বলে জানান সেখানে কর্মরত আবদুল আলীম। তবে এই সময়ে তাঁতের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে সব বয়সী মানুষের মধ্যেই। কারণ দেশের শিক্ষিত রুচিশীল ক্রেতারা এখন অনেকটাই সচেতন।
আলীম বলেন, "এক ধরনের বিদেশী কাপড়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ সবসময় সমান থাকে না। কোনো একটা ডিজাইন খুব জনপ্রিয় হলেও কিছুদিন পর এর আবেদন কমে যায়৷ কিন্তু তাঁতের আবেদন বছরের পর বছর একইভাবে টিকে থাকে।"
"আমাদের অনেক ক্রেতাই আছে যারা তরুণ বয়স থেকে প্রবর্তনার শাড়ি-পাঞ্জাবী পরছে, এখন মধ্যবয়সেও প্রবর্তনা থেকে কেনাকাটা ছাড়েনি। কোনো পণ্য পছন্দ না হলে তারা আপত্তি করে, অভিযোগ করে, কিন্তু তাও ওরা এখান থেকে কিনবেই! এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয় যে এমন একটা জায়গা তৈরি করতে পেরেছি," ফরিদা আক্তার বলেন।
প্রবর্তনায় তাঁতের শাড়ি সর্বনিম্ন ১১৯৫ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়, ভেজিটেবল ডাইয়ের শাড়িগুলো পাওয়া যায় ২১৯৫ টাকা থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যে। মণিপুরী শাড়ির দাম ২৪৯৫ টাকা থেকে ৩২০০ টাকা পর্যন্ত আর জামদানী শাড়ি ৬০০০ টাকা থেকে ৯০০০ টাকা পর্যন্ত দাম হয়।
প্রবর্তনার নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি পাঞ্জাবীগুলো ১৪৯০ টাকা থেকে ১৮৫০ টাকা পর্যন্ত দামের হয়। নিজস্ব কারখানায় তৈরি গজ কাপড়গুলো ২৪০ টাকা থেকে ৩৯০ টাকা প্রতি গজে পাওয়া যায়।
এছাড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত লহরী কাঁথা পাওয়া যায় প্রবর্তনায়। একবছর ধরে তৈরি করা একটি লহরী কাঁথার দাম হয় ১৫০০০ টাকা পর্যন্ত।
ফরিদা আক্তার মনে করেন দেশের মানুষের অভ্যাস-আচার আচরণও তাঁতশিল্পের দুরাবস্থার একটা বড় কারণ। "মানুষ এখন উৎসব-পার্বণ ছাড়া শাড়ি পরা কমিয়ে দিয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের পোষাক থেকে উৎসব আয়োজনের পোষাকে পরিণত হওয়ায় শাড়ির চাহিদাতেও পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে অনেক। ফলে তাঁতিদের উৎপাদনও কমে গিয়েছে," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "দেশীয় পণ্য নিয়ে উদ্যোগ যত বাড়বে ততই মানুষের মধ্যে এসবের ব্যবহার জনপ্রিয় হবে। পণ্যের মান ও নীতি ঠিক রেখে নতুন উদ্যোক্তারা কাজ করে গেলে দেশের অনেক মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যা দূর হবে।"
দেশের তাঁতশিল্প নিয়ে প্রবর্তনার ধারাবাহিক কার্যক্রমকে 'তাঁত আন্দোলন' বললে মোটেও অত্যুক্তি করা হয়না। দেশের সংস্কৃতি, শিল্প আর শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টার নাম প্রবর্তনা।
প্রবর্তনা জড়িয়ে আছে অনেক বাঙালি নারীর প্রথম শাড়ি পরার স্মৃতি থেকে শুরু করে পরিণত বয়সের দৈনন্দিন রুটিনের সাথে।