প্রাণীরা কি মৃত্যু বোঝে?
মৃত্যু প্রাণীকুলকেও ব্যাকুল করে, শোকাকুল হওয়া কোনো কোনো প্রাণী কবরও দেয় মৃতদের। কেউ কেউ আবার কয়েকদিন ধরে বয়ে চলে শবদেহ। গবেষকরা তেমন সব আচরণের ব্যাখ্যা খুঁজেছেন।
বেশিরভাগ সময় মানুষ অন্য প্রাণীর প্রেম বা ভালোবাসার মতো মিষ্টি ভাব খেয়াল করে। কিন্তু মৃত্যু তো সবার জন্য চিরন্তন। সব প্রাণীই মৃত্যুর অধীন। অনেক দিন ধরেই মানুষ বোঝার চেষ্টা করছে, অন্য প্রাণী মৃত্যুতে কী ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখায়। মৃত্যুতে প্রাণীকুলের শোকগ্রস্ত হওয়া দেখে চার্লস ডারউইনও অবাক হয়েছিলেন। তাহলে প্রাণীরা কি বোঝে, মৃত্যুর অর্থ? স্বজন হারিয়ে মানুষ যেমনভাবে ব্যাকুল হয় তেমন ভাব কি প্রাণীকুলেরও হয়?
ওরা কি মরণ বোঝে
প্রাণীরা কি মৃত্যু বোঝে আর ব্যথাতুর হয়? উত্তর চাইলে বিশদ গবেষণার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বলছিলেন, সুসান মনসো। স্প্যানিশ ন্যাশনাল ডিস্টেন্স এডুকেশন ইউনিভার্সিটিতে তিনি একজন দার্শনিক এবং নীতিবাদী। তার লেখা বইয়ের নাম শ্রোয়েডিংগার অপোসাম। তাতে তিনি প্রকাশ করছেন কীভাবে প্রাণীকুল মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়া জানায়। কিছু বিজ্ঞানী যেমন ভাবেন, প্রাণীকুলের বিষণ্ণ হওয়ার পূর্বশর্ত মৃত্যুর অর্থ অনুধাবন করা। কিন্তু মনসো বলেন, নিঃসঙ্গতাই কি বিষণ্ণ বা দুঃখিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়? এই বিষণ্ণতা তখনো ঘটতে পারে যখন একজন অন্যজন থেকে বিচ্ছিন্ন মানে দূরে সরে যায়। যদি আমরা মৃত্যুর মানে বোঝাকে বিষণ্ণ হওয়ার পূর্বশর্ত ধরি তবে হয়তো প্রাণীকুলের শোকাকুল হওয়াকে ভুলভাবে ব্যখ্যা করে ফেলব।
উইপোকাদের ব্যাপারটা দেখুন
'আরেকটি জটিলতা হলো, প্রাণীরা তাদের কষ্টের কথা বলতে পারে না। তবে সুখের কথা হলো, দুঃখের অনুভূতি প্রকাশের আরো বেশ কিছু মাধ্যম রয়েছে যেমন দীর্ঘসময় মাথা নিচু করে রাখা বা গালে হাত দিয়ে রাখা বা শুয়ে পড়া ইত্যাদি', কথাগুলো বলছিলেন, জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইমেট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের শিম্পাঞ্জী গবেষক আন্দ্রে গনকালেভস।
'এছাড়া ক্ষুধামন্দা, নিদ্রাহীনতা, অস্থিরতা বৃদ্ধিও শোকাকুল হওয়ার লক্ষণ বিশেষত প্রাণীকুলের ক্ষেত্রে। তবে এসবের অল্প প্রকাশ বা স্বলকালীন স্থায়িত্ব অন্য কিছুরও ইংগিত দিতে পারে। খুব ভালো করে খেয়াল করলে শোকাকুল হওয়ার বিশেষ ধরনও দেখা যায়। উইপোকাদের ব্যাপারটা দেখুন, কোনো উইদল মৃতকে কবর দেয়, কোনোদল আবার খেয়ে ফেলে। এটা নির্ভর করে শহদেহের রাসায়নিক গঠনের ওপর।
পিঁপড়ার মধ্যেও কবর রচনার প্রয়াস দেখা যায় আর শবদেহ ঢাকে তারা অলিক এসিড নামের হলুদ, গন্ধহীন একধরণের চর্বি দিয়ে। কাকদের ক্ষেত্রে আপনারা হয়তো দেখে থাকবেন, শবদেহ দেখামাত্র তারা কা-কা করে বাড়ি মাথায় তোলে এবং অন্য কাকেরা এসে তার সঙ্গে যোগ দেয়। ফলে শবদেহ ঘিরে একটা বড়সড় সমাবেশ মতো হয়ে যায়। এটাকে অন্তেষ্ট্যিক্রিয়া বলা কি বাহুল্য হবে? তবে হয়তো এই সমাবেশকে শোকসভা বলা ঠিক হবে না। বরং অনেক বিশেষজ্ঞ এটাকে 'এলান' বলতে রাজি। মানে এখানে ঘোষণা হচ্ছে যে এলাকাটা নিরাপদ নয়। তখন সকলে মিলে এলাকা পরিত্যাগ করে।'
তাহলে শোকগ্রস্ত হয় কারা
মনসো আর গনকালেভস দুজনেই একমত যে যেসব প্রাণীর সামাজিক বন্ধন ভালো তাদের মধ্যে শোকাকুল হওয়ার চল দেখা যায়। তিনটি প্রাণীধারার কথা তারা বলছেন, তিমির মতো জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী, হাতি এবং নন-হিউম্যান প্রাইমেটস।
তিমি এবং শুশুক পরিষ্কারভাবেই মৃত স্বজনের প্রতি শোকজ্ঞাপন করে। কখনো কখনো বয়স্করা শবদেহ পিঠে করে ঘুরে বেড়ায় এমনকি কয়েকমাস। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মা তিমি তার মৃত বাচ্চাকে নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ঘুরে বেড়িয়েছে। বটলনোজ ডলফিনও একইরকম আচরণ করে।
এবার হাতির কথায় আসি। তাদের সামাজিক বন্ধন শক্ত। যখন কোনো একটি হাতি মারা যায় তখন অন্যরা বারবারই এসে তাকে স্পর্শ করে, শোকে বা বোঝার চেষ্টা করে ঘটনাটা কী। তারা কয়েক মাস বা বছর পরেও শবদেহের ধারে আসে, এমনকি হাড়গোড়েরও খেয়াল রাখে। এক গবেষণায় দেখা যায়, শবদেহ ঘিরে দাঁড়ানো হাতিদের চোখ বা কান থেকে কিছু তরল নিঃসৃত হয় যা তাদের শোকার্ত হওয়ার নিদর্শন।
নন-হিউম্যান প্রাইমেটদের (শিম্পাঞ্জী, গরিলা ইত্যাদি) ক্ষেত্রেও সন্তান কাঁধে করে ঘুরে বেড়ানোর নজির দেখা গেছে। তারা কখনো কখনো শবদেহকে এমনভাবে আঘাত করে যে মনে হয় বলছে, এই উঠে দাঁড়াও, কী হয়েছে তোমার। এছাড়া শবদেহকে অন্য শিকারী প্রাণীদের থেকে রক্ষা করার জন্য পাহারা দিতেও দেখা যায়।
শেষ কথা হলো ওরা মৃত্যু বোঝে না কিংবা বোঝে সে আলোচনায় যতি টানার সময় এখনো আসেনি। তবে প্রাণীকুলের অনেকেই যে মৃত্যুর প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
- সূত্র- ডিসকভার ম্যাগাজিন