প্রত্যাশা বদলান, সফলতা আসবে!
একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর'। মানুষের এ বিশ্বাস, প্রত্যয় সবকিছুই মনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। মনই মানুষের সকল চিন্তা-চেতনার জন্ম দেয় এবং কর্মে প্রভাব বিস্তার করে।
মন বা মস্তিষ্ক মানুষের কাজকে যেমন প্রভাবিত করে তেমনি সেগুলোকে প্রভাবিত করে ব্যক্তির চারপাশের পৃথিবী।
যুক্তরাষ্ট্রের কানেটিক্যাট স্টেটের একজন মনস্তাত্ত্বিক রোজেন কাপানা হেজ বলেন, "স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, মস্তিষ্ক নামক অঙ্গটিকে ভালো-মন্দ যাই বোঝানো হবে সে তাই বিশ্বাস করে প্রতিক্রিয়া করবে।"
বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ লেখক এবং 'দ্য এক্সপেক্টেশন ইফেক্ট: হাউ ইওর মাইন্ডসেট ক্যান চেঞ্জ ইওর ওয়ার্ল্ড' বইটির রচয়িতা ডেভিড রবসন মনে করেন মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া দেখানোর এ ঘটনাটি প্রতিকূল সময়ে বিশেষভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
সিএনএন-এর চিফ মেডিকেল কো-রেসপন্ডেন্ট ডা. সঞ্জয় গুপ্তার 'চেসিং লাইফ' পডকাস্টে তিনি বলেন, "শরীর আর মনের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক অদৃশ্য বা রহস্যময় কোনো শক্তির প্রভাবে ঘটে না। এটি খুবই স্বাভাবিক ও তড়িৎ একটি প্রক্রিয়া। এর দ্বারাই আমাদের সাইকোলজিতে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে।"
তিনি আরও বলেন, "মনোবল দৃঢ় করে কোনোদিকে আগালে বাঁধা অতিক্রম করা সম্ভব। পাবলিক স্পিকিংয়ের সময় যাদের সমস্যা হয় তারা যদি মনে করে তারা কথা বলতে পারবেই তবে তাদের এ সমস্যা দূর হওয়া সম্ভব।"
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলছেন। প্রত্যাশাকে পরিবর্তন করার ফলে ব্যক্তির মধ্যে আত্ম-সচেতনতা, আত্ম-করুণা ও প্রাণোচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়। চলুন মানসিক উন্নতির দ্বারা সফলতায় পৌঁছানোর ৬টি টিপস জেনে নেওয়া যাক।
ঝেড়ে ফেলুন যত 'নেগেটিভিটি'
আমাদের আশা-প্রত্যাশার ভেতর নেতিবাচক কিছু থাকলে সেটি আমাদের মস্তিষ্ককে জটিল থেকে জটিলতর পরিস্থিতির ব্যাপারে আগে থেকে খানিকটা প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে। খুব সহজ বিষয়গুলোতেও তখন আমরা বেশি মনোযোগ দিয়ে ফেলি। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গ্রেটার গুড সায়েন্স সেন্টারের বৈজ্ঞানিক পরিচালক এমিলিয়ানা সিমোন-থমাস এ কথা বলেন।
নেতিবাচক বিষয়গুলো বিপদের ব্যাপারে আমাদের সচেতন করলেও সবসময় আমাদের চারপাশের পরিস্থিতির সাথে সেগুলো যায় না। বিপদ-আপদের ব্যাপারে একটু বেশি খুঁতখুঁতে মানসিকতা হিতে বিপরীতও হয় মাঝেমাঝে।
এমিলিয়ানা শেষে যোগ করেন, "নেগেটিভ চিন্তা-চেতনা সত্যিকার অর্থে আপনাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যায় যার ফলে আপনি নেতিবাচক ঘটনার আসল অভিজ্ঞতার চেয়েও ওই চিন্তার কারণে বেশি প্রভাবিত হবেন।"
নিজের সাথে কথা বলুন
ইতিবাচক আশা-প্রত্যাশার কথা মানুষের নিজের সাথে বলা উচিত।
এমিলিয়ানা বেসবল খেলোয়াড়দের উদাহরণ টেনে বলেন, খেলোয়াড়েরা মাঠে ঢুকতে ঢুকতে ম্যাচে বাজিমাত করার কথা ভাবেন। শুধু তারা নয়, পৃথিবীর সবারই এরকম ভাবা উচিত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে, অনেকসময়ই নেতিবাচক চিন্তা আমাদেরকে গ্রাস করে। সেরকম কিছু হলে প্রার্থনা, ধ্যান, বই ও পত্রিকা পড়া এবং কল্পনার জগতে ডুব দেওয়ার মাধ্যমে লক্ষ্যকে স্থির করার পরামর্শ দেন কাপানা। এর ফলে আমাদের চিন্তার পরিসর বাড়ে এবং তা নিয়ন্ত্রণও করা যায়।
চ্যালেঞ্জের দিকে ফোকাস করুন
সিমোন-থমাস বলেন, আমরা সাধারণত দুইভাবে আমাদের নিজেদের ক্ষমতা এবং বাধা-বিপত্তিকে ভাগ করে থাকি। অনেকসময় আমাদের নিজেদের ক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা থাকে; নাহলে আমাদের বাধা-বিপত্তিগুলো থাকে হুমকিস্বরূপ এবং চ্যালেঞ্জিং।
তিনি বলেন, বাধা-বিপত্তিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মোকাবিলা করার প্রবণতা হুমকি হিসেবে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতার চেয়ে বেশি সফলতা নিয়ে আসে। আমাদের ফোকাসকে সেভাবেই পরিবর্তিত করা উচিত।
সিমোন-থমাস আরও বলেন, "যেকোনো সমস্যাকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলে শারীরিক প্রতিক্রিয়াগুলো ব্যক্তিকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার শক্তি যোগায়। ঐ ব্যক্তি আরও সৃজনশীল ও সহনশীল হতে শেখে।"
মানসিকতার ব্যপ্তি প্রসারিত করুন
'নাইন্টি সেকেন্ডস টু আ লাইফ ইউ লাভ' বইয়ের লেখক এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ জোয়ান রোজেনবার্গ বলেন, সবসময় আশাবাদী মানসিকতা নিয়ে বসে থাকলেও কার্যসিদ্ধি হয় না।
তার পরিবর্তে রোজেনবার্গ নিজের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে যে প্রত্যাশাগুলো ইতিবাচক ফলাফলের দিকে ইঙ্গিত করে সেগুলোকে নিয়ে আগানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
নতুন ও চ্যালেঞ্জিং কিছু করার ব্যাপারে রোজেনবার্গ বলেন, "আমি সর্বদা আমার সবচেয়ে ভালোটা দেওয়ার চেষ্টা করব এবং দেখব আমি কত ব্যাপকভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারলাম।"
আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে সচেতন হোন
নতুন কিছু করতে গেলে বারবার চেষ্টা করেও অনেকসময় বিফল হতে হয়। দুঃখজনক হলেও এটি সত্য কথা। সে ধরনের কিছু করতে গেলে আমাদের অনুকূল বা ইতিবাচক মনোভাব রাখা উচিত। হার জিত যাই আসুক, হাসিমুখে তা মেনে নেওয়ার গুণটি থাকা জরুরী।
রোজেনবার্গ বলেন, সাধারণত এইসব ক্ষেত্রে মানুষ রেগে যায়, ভয় পায়, মুষড়ে পড়ে, দুঃখ পায়। শারীরিক কিছু প্রতিক্রিয়াও চোখে পড়ে এসময়। সেরকম প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আছে – চোখ-মুখ লাল হয়ে যাওয়া, হৃদকম্পন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
তিনি আরও বলেন, সৌভাগ্যক্রমে সমীক্ষা বলছে এ ধরনের অবস্থা ৯০ সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হয় না। নিজেকে ঠিকঠাক প্রস্তুত করা ব্যক্তি এ ধরনের অবস্থা থেকে অতি সহজেই বের হয়ে আসতে পারে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। পরিস্থিতি সামলে নিতে পারলে তার কাছে এসব কিছুই না।
হতাশা থেকে শিক্ষা নিন
রোজেনবার্গ আরও বলেন, খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময়ও অনেক কিছু শেখার থাকে, জানার থাকে। হারানোকে প্রাপ্তিতে বদলে দেওয়া যায়।
হতাশার ভেতর থেকেও তথ্য সংগ্রহ করার পরামর্শ দিয়েছেন রোজেনবার্গ। তিনি বলেন, কোনো ব্যাপারে আপনার খারাপ লাগার অর্থ হচ্ছে আপনি ব্যাপারটি নিয়ে আসলেই ভাবেন বা বিষয়টিকে কেয়ার করেন।
অনেক সময় এমনও হতে পারে, আপনার নতুন বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোতে কোনো আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন না আপনি।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আপনি এমন কোনো অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাবেন?
"এ ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি অনেক কিছুই শিখতে পারি, যা আমার পরবর্তী জীবনেও কাজে লাগবে," বলেন রোজেনবার্গ।
বাস্তববাদী মনোভাব থেকে চিন্তা করলে অনেক ক্ষেত্রেই জীবনের হতাশা ও না-পাওয়া বেদনাগুলোর সমাধান পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রস্তুতি নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে সমস্যার অনেকাংশেই সমাধান করা যায়।
- সূত্র: সিএনএন