টাঙ্গুয়ার কান্না
'হাওরের পানি নাইরে হেথায়, নাইরে তাজা মাছ/বিলের বুকে ডানা মেলা, নাইরে হিজল গাছ'—জন্মভূমি সিলেট ছেড়ে কলকাতায় থিতু হওয়ার আক্ষেপে এমন গান বেঁধেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস।
তবে এই সময়ে সিলেট অঞ্চলে এলে হয়তো একই আক্ষেপ করতে হতো এই শিল্পী সংগ্রামীকে। কারণ এখানকার হাওরের পানি, তাজা মাছ, ডানা মেলা হিজল গাছ—সবই এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান হাওর টাঙ্গুয়া। বলা হয়ে থাকে, সুনামগঞ্জের এই হাওরটিতে 'ছয় কুড়ি' বিল রয়েছে। যার একটি আলম দোয়ার।
১০-১৫ বছর আগেও টাঙ্গুয়ার আলম দোয়ার বিলে প্রচুর চিতল মাছ পাওয়া যেত জানিয়ে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, 'আগে তো এখানে নৌকার সাথে এসে চিতল মাছ ধাক্কা খেত। এখন জাল ফেলেও পাওয়া যায় না।'
কেবল মাছ নয়, দেশের অন্যতম বৃহৎ হাওর টাঙ্গুয়ায় দিনে দিনে কমেছে জলজ উদ্ভিদও। আর একসময়ের পাখির এই অভয়াশ্রমে এখন পাখির দেখাই মেলে না। হারিয়ে গেছে অনেক বিলও।
দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সঠিক উদ্যোগের অভাব, অবাধে গাছ কাটা, পাখি ও মাছ শিকারের ফলে দেশের অন্যতম সুন্দর এই হাওরটি সঙ্কটে পড়েছে বলে মনে করেন কাসমির রেজা।
টাঙ্গুয়ার হাওর
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় অবস্থান টাঙ্গুয়ার হাওরের। এর আয়তন ১২ হাজার ৫৬৬ হেক্টর। স্থানীয়দের কাছে 'নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল' হিসেবে এর পরিচিতি থাকলেও বর্তমানে এখানে ৭৪ বিল রয়েছে।
১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত টাঙ্গুয়ার হাওর ময়মনসিংহের গৌরীপুর জমিদারীর অধীনে ছিল। পরে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের মহানন্দ দাস এই হাওরটি জলমহাল হিসেবে সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নেন।
১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়া হাওরকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর আগ পর্যন্ত এই হাওরটি জলমহাল হিসেবে ইজারা দেয়া হতো। এই ঘোষণায় শেষ হয় ৫০ বছরের ইজারাপ্রথার। তবে দীর্ঘ ৫০ বছরে ইজারাদারদের অবাধ মৎস্য আহরণে হুমকিতে পড়ে টাঙ্গুয়ার জীববৈচিত্র্য।
২০০০ সালের জানুয়ারি মাসে এই হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রামসার কনভেনশনের আওতায় দেশের 'রামসার সাইট' হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
২০০১ সাল থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপরে ন্যস্ত হয়।
২০১৭ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং আইইউসিএন-এর যৌথ প্রকল্প শেষ হওয়ার পর থেকে হাওরের দায়িত্বে আছে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসন।
হাওরবাসীর দারিদ্র্যে ক্ষতিগ্রস্ত হাওর
জীবনমানের সব সূচকেই পিছিয়ে রয়েছে হাওরপাড়ের বাসিন্দারা। শিক্ষা, চিকিৎসার অপ্রতুলতার পাশপাশি এখানে রয়েছে কর্মসংস্থানের সঙ্কট। যোগাযোগব্যবস্থাও নাজুক। হাওর এলাকায় দেশের অন্যান্য স্থান থেকে দারিদ্র্যের হারও বেশি। তীরবর্তী বসিন্দাদের দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানহীনতাও সঙ্কটে ফেলেছে হাওরকে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের মূল সঙ্কটের শুরু আজ থেকে ২৫ বছর আগে। ১৯৯৬ সালে ক্রমাগত লোকসানের কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয় হাওর-লাগোয়া টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি। এই খনি ছিল এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র কর্মস্থল। হঠাৎ খনি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে যায় হাজারো শ্রমিক। তাদের জীবিকার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় টাঙ্গুয়া হাওরের সম্পদ। কেউ মাছ ধরে, কেউ পাথর তুলে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। হাওরের গাছ চুরি এবং পাখি শিকারও বেড়ে যায় তখন থেকে। অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসায় এই সমস্যা এখন আরও বেড়েছে, যা সঙ্কটে ফেলেছে হাওরকে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণাসিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, হাওরের মানুষজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। পর্যটকদের কেন্দ্র করে বাইরের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করলেও আমাদের হাওরের গরিব মানুষদের জন্য কিছু করছেন না। পুঁজি না থাকায় পর্যটকের কারণেও স্থানীয়রা উপকৃত হচ্ছে না।
প্রকল্পের পর প্রকল্প, হাওর আরও সঙ্কটাপন্ন
২০০১ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নেয়ার পর হাওরের উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন'-এর অর্থায়নে দীর্ঘমেয়াদী একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার।
২০০৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন ধাপে 'কমিউনিটি বেজড সাসটেইনেবল ম্যানেজমেন্ট অব টাঙ্গুয়া হাওর' নামক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)। যদিও বিভিন্ন কারণে ২০১৯-এর জুলাইয়ে এই কাজ শেষ হয়।
প্রায় আড়াই মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ২২ কোটি টাকা) অনুদানে বাস্তবায়িত এ প্রকল্প চলার সময়ই ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ৩.৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
এ প্রকল্পের অধীনে টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের ৮৮টি গ্রামে গঠন করা হয় সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি। টাঙ্গুয়ার হাওরের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে হাওরপাড়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও বলা হয়। তবে এসব প্রকল্পে হাওরের আর হাওরপাড়ের বাসিন্দাদের কোনো উন্নয়ন হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
প্রকল্প শেষে আইইউসিএনের তৈরি করা একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হাওরপাড়ের ৮৮টি গ্রামের ৮৭ হাজার মানুষ এখন আর টাঙ্গুয়ার হাওরের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল নয়, বরং তারা প্রত্যেকে এই প্রকল্পের মাধ্যমে নানাভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। এর ফলে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য প্রকল্প শুরুর আগের অবস্থা থেকে উন্নত হয়েছে।
তবে এমন তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সহ-ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আহমদ কবির জানান, যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল তা সফল হয়নি। হাওরের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। মানুষেরও অবস্থা বদলায়নি। তবে এটা সত্য, প্রকল্পের উদ্দেশ্য ভাল ছিল।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের করা মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও প্রকল্পের উদেশ্য বাস্তবায়িত না হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তাদের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে আইইউসিএন-এর উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হাওরবেষ্টিত এই এলাকার মানুষের মধ্যে শিক্ষার হার কম এবং চিকিৎসা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা খারাপ। দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের মধ্যে হাওর থেকে মাছ চুরির প্রবণতা বেশি এবং হাওরের প্রকৃতি রক্ষায় নিয়োজিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। আইইউসিএন ৭৪টি গ্রামে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে বলে দাবি করলেও বাস্তবে এর অধিকাংশ কমিটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। প্রকল্পকালে হাওরে ১ লাখ ৫৭ হাজার হিজল-করচ গাছ লাগানোর কথা জানালেও বাস্তবে এসব গাছের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে আইইউসিএনের সেই প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ওয়াহিদুজ্জামান সরকার বলেন, 'আমরা হাওর রক্ষায় যে প্রকল্পে কাজ করেছি, তা সফল হয়েছে। মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে কিছু প্রশাসনিক জটিলতাও ছিল। আমরা হাওরে প্রচুর হিজল-করচ গাছ লাগিয়েছি—বর্তমানে ৬০ শতাংশ টিকে আছে। আমরা একটা সিস্টেম দাঁড় করাতে পেরেছিলাম বলেই আজ মাছ ধরতেও পারমিশন লাগে।'
বৃক্ষশূন্য হাওর
হাওরের বুক জুড়ে ছিল সারি সারি হিজল-করচ গাছ। অর্ধেক ডুবে থাকা এসব গাছ দেখে মনে হতো হাওরের বুকে যেন ডানা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে তারা। গাছের ডালে বসত নানা জাতের পাখি। এসব দেখতেই টাঙ্গুয়ার হাওরে আসতেন পর্যটকরা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে হাওরের হিজল-করচ।
হাওরপাড়ের মানুষদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অতীতে হাওরাঞ্চলে সবুজের সমারোহ থাকলেও এখন তা বিরল। হাতেগোনা কয়েকটি স্থান ছাড়া হাওরে আর গাছ নেই। প্রতিনিয়ত বৃক্ষনিধনে গাছের সংখ্যা দিন দিন আরো কমে আসছে।
তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের দুমাল গ্রামের গোলাম কিবরিয়া বলেন, গত দুই দশক ধরে টাঙ্গুয়ার হাওরে গাছকাটা চলছে। মূলত জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার এবং মাছ চাষের সময় পানিতে দেয়ার জন্য হিজল-করচ গাছের চাহিদা থাকায় অবাধে বৃক্ষনিধন হয় টাঙ্গুয়ার হাওরে।
একই গ্রামের বজলু মিয়া বলেন, হাওরের হিজল-করচ ছাড়াও চাইল্যাবন, নলখাগড়া, বিন্নাছন, বউল্ল্যা বন, হেগরা বন আর আগের মতো পাওয়া যায় না। জ্বালানির চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে এসবও শেষ হয়ে গেছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের সর্বশেষ ইজারাদার, তাহিরপুরের বাদাঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত জয়নাল আবেদীন হাওরাঞ্চলে প্রচুর হিজল-করচ রোপণ করেছিলেন বলে স্থানীয়রা জানান। সেসব হিজল-করচ গাছই এখন কেবল টিকে আছে।
জয়নাল আবেদীনের মেয়ে ও সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্য সেলিনা বেগম বলেন, 'আমরা অনেক সময় শুনি কাগজে-কলমে হাওরের অনেক উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে হাওরের অবস্থা শেষ। আমার বাবা যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন হাওরে হিজল-করচসহ বিভিন্ন গাছ লাগিয়েছেন। এমনকি এই গাছগুলো লাগানোর পর যত্নও নিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর কেউ এখানে গাছ লাগায়নি। এখন আর কেউ যত্ন নেয় না, গাছ লাগায় না।'
এতদিনের প্রকল্পে হাওরের কোনো উন্নয়ন হয়নি, উল্টো হিজল-করচ কাটা হয়েছে, প্রাণ প্রকৃতি নষ্ট করা হয়েছে—এই অভিযোগ করে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজয় সেন রায় বলেন, 'আমরা অনেক আন্দোলন করেছি, অনেক ফোরামে কথা বলেছি, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। এই হাওরকে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে উল্টো ধ্বংস করা হয়েছে। সম্প্রতি আমরা প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।'
প্রকল্প চলাকালে হাওরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গাছ না লাগানো প্রসঙ্গে আইইউসিএনের প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, 'আমরা নির্ধারিত সংখ্যক গাছ রোপন করেছি। ৬০% গাছ এখনো টিকে আছে।'
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে গাছের অস্থিত্ব না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'তদন্তের সময় গাছ পানির নিচে ছিল, তাই তারা দেখতে পারেননি।'
অতিনিয়ন্ত্রিত পর্যটকই যখন সমস্যা
টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের অন্যতম নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অঞ্চল। বিস্তীর্ণ জলরাশি, জলের ওপর ভেসে বেড়ানো হিজল-করচ, পাখির ওড়াউড়ি; পাশেই খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়—সবমিলিয়ে এই হাওরে সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে টাঙ্গুয়ায় পর্যটক সমাগম আরও বেড়েছে।
২০১৫ সালে সুনামগঞ্জ সদরে সুরমা নদীর ওপর নির্মিত আব্দুজ জহুর সেতু চালুর পর তাহিরপুর উপজেলায় যোগাযোগ সহজ হয়। এরপর টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। যত সময় যাচ্ছে, হাওর পর্যটনের নামে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ততই বাড়ছে টাঙ্গুয়ার হাওরে।
একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের চাপ এবং বেশিরভাগ পর্যটকের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি উদাসীনতার কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে সংরক্ষিত এই জলাভূমির।
বর্ষাকালে সারা দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের নৌকা এসে ভিড় করে তাহিরপুর উপজেলা সদরে। পর্যটকরা তাহিরপুর উপজেলা থেকে নৌকা ভাড়া করে টাঙ্গুয়ার হাওর ও হাওরপাড়ের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণ করেন এবং রাতে নৌকাতেই রাত্রিযাপন করেন।
পর্যটকরা নৌকা ভাড়া করে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা টাঙ্গুয়ার হাওরের ভেতরে গিয়ে সাউন্ড বক্স দিয়ে গান-বাজনা করেন। খাবারের প্লাস্টিক প্যাকেট ফেলে দেন হাওরের পানিতে। পর্যটকবাহী ইঞ্জিন নৌকার কারণেও দূষিত হয় হাওরের পরিবেশ। পর্যটকদের চাপ বাড়ার কারণে কমেছে হাওরে পাখির সংখ্যা।
তাহিরপুর ট্রলার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির জানান, 'পর্যটকরা সবকিছুতেই প্লাস্টিক ব্যবহার করেন এবং আমাদের নিষেধ সত্ত্বেও তা পানিতে ফেলে দেন। একটি ১৫ জনের দল ভ্রমণ শেষে অন্তত ১ কেজি প্লাস্টিক-বর্জ্য হাওরে ফেলে আসেন। সে হিসেবে ভরা মৌসুমে দিনে অন্তত ১ টন প্লাস্টিক-বর্জ্য মিশছে হাওরের পানিতে।
স্থানীয়দের তথ্যানুসারে, বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন অন্তত ৫০০ ইঞ্জিন নৌকা হাওরে প্রবেশ করে। সুনামগঞ্জ ছাড়াও নেত্রকোনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকেও নৌকা আসে হাওরে। তবে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে হাওরে চলা নৌকার কোনো পরিসংখ্যান নেই।
অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক হাওরের নতুন হুমকি উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-এর (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, 'টাঙ্গুয়ার হাওরের আশেপাশের অনেক বিল ও হাওর হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে হাওরের উন্নতি নয়, দিনে দিনে ক্ষতি হয়েছে। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরের মেঘালয়ে যে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ হচ্ছে, তার প্রভাব পড়ছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। এখানে চলছে অনিয়ন্ত্রিত ট্যুরিজম। একটি রামসার সাইটে এভাবে যত্রতত্র শত শত ইঞ্জিনের নৌকা চলতে পারে না। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন হাজার কেজি প্লাস্টিক ফেলতে পারে না। শুধু নামমাত্র প্রকল্প দিয়ে হাওর রক্ষা করা যাবে না। দরকার সমন্বিত উদ্যোগ।'
হাওরে মাসে যাচ্ছে ৩ লাখ পিস প্লাস্টিক
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা জানান, পর্যটন মৌসুমে প্রতি মাসে কম করে হলেও ৩ লাখ পিস প্লাস্টিক যাচ্ছে হাওরে। একজন পর্যটক হাওরের একরাত ২ দিন থাকেন এতে ২টা পানির বোতল, ৫টা ওয়ানটাইম প্লেইট, চায়ের কাপ , চিপসসহ অনান্য কিছু মিলে ১০/১২ পিস প্লাস্টিক ব্যবহার করেন ।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যটন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সন্তোষ কুমার দেব জানান, 'হাওরে প্রবেশের সময়ই প্লাস্টিক আটকে দিতে হবে। বিকল্প হিসেবে হাওরের নৌকায় ভাসমান খাবারের দোকান থাকতে পারে, যেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও থাকবে। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুক্ত করতে হবে। পর্যটন এবং জীববৈচিত্র্য দুইটাই রক্ষা করতে হবে।'
মেঘালয় থেকে আসা ঢলেও ক্ষতিগ্রস্ত হাওর
পর্যটক ছাড়াও হাওরের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল। টাঙ্গুয়ার হাওরের পাশেই ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়। বর্ষা মৌসুমে এই পাহাড় বেয়ে ঢল নামে। ঢলের সাথে পাহাড় থেকে আসা বালু-পাথর-কয়লা ও চুনাপাথরে ভরাট হতে শুরু করেছে হাওর।
স্থানীয়রা জানান, ঢলের সাথে আসা বালু-পাথরে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি বয়ে আনা পাহাড়ি খাল নয়াছড়া। হাওরের পঁচাশোল বিলও ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে এবং প্রতি বছর নতুন নতুন এলাকা ভরাট হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি বালু-পাথরে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সদস্য ও হাওরতীরবর্তী রাজাই গ্রামের বাসিন্দা এন্ড্রু সলমার বলেন, 'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে কয়েকবার মেঘালয়ে গেছি, ততবারই সেখানে অপরিকল্পিতভাবে কয়লা ও চুনাপাথর উত্তোলন এবং পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের ফলে পাহাড়ধস হতে দেখেছি। যে কারণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাওরাঞ্চল। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ক্রমেই টাঙ্গুয়ার হাওরেরও বড় একটি অংশ ভরাট হয়ে যাবে। '
কমছে পাখি ও মাছ
ঢলের সাথে নেমে আসা বালু-পাথরে হাওরপাড়ের জাদুকাটা, মাহারাম ও পাটলাই নদী ইতিমধ্যে নাব্যতা হারিয়েছে। যার ফলে টাঙ্গুয়ার হাওরের পানি শীত মৌসুমেও নামছে না। ফলে ব্যাহত হচ্ছে হাওরের একমাত্র ফসল বোরো চাষ। পানি না কমায় শীতকালে পরিযায়ী পাখির আগমনও কমে গেছে বলে জানান স্থানীয়রা। আগে যেভাবে দলে দলে পাখির ঝাঁক উড়ে যেত, এখন সে সংখ্যা কমেছে এক-চতুর্থাংশ।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইনাম উল হক বলেন, 'হাওরের উপর থেকে মানুষের নির্ভরতা কমাতে হবে। এই হাওরের উপর খুব অত্যাচার হচ্ছে। পাখিদের খাবার কমে গেছে। হাওরের জলজ উদ্ভিদ গণহারে তুলে শুকিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। মাছের উৎপাদন কমেছে কয়েকগুণ।'
তিনি আরও জানান, 'টাঙ্গুয়ার পাশেই মাটিয়ার হাওরে আমি নিজে লাখখানেক পাখি গুনেছি। এখন সেখানে একটাও পাখি নাই। কারণ জলজ বন নষ্ট হয়ে গেছে।'
আইইউসিএন-এর মুখ্য গবেষক সীমান্ত দিপু জানান, হাওরের পানি নামে না সময়মতো। তাই জানুয়ারিতে পাখির খাবারের সংকট থাকে। যার কারণে তখন গড়ে ৫০ হাজার পাখি থাকে, কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে পানি নামার পর পাখি বেড়ে যায় তিনগুণ। তখন গড়ে দেড় লাখ পাখি আসে।
এ কারণে পাখি শুমারির তথ্যেও গরমিল থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, 'যে বছর জানুয়ারিতে শুমারি হয়, সে বছর কম পাখির দেখা মেলে। আবার ফেব্রুয়ারিতে হলে থাকে লাখের বেশি।'
তিনি আরো জানান, পশুয়ার হাওয়ে ১৫ বছর আগেও গড়ে ১ লাখ পাখির দেখা মিলত। কিন্তু এখন একটিও নেই। যা প্রমাণ করে খাবার না থাকলে পাখি থাকবে না ।
পাখি কমায় কমছে মাছের উৎপাদনও। তাহিরপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সারোয়ার হোসেন জানান, 'টাঙ্গুয়ার হাওরের মাছের উৎপাদন নিয়ে আলাদা কোনো ডাটা আমাদের হাতে নেই। তবে মাছ যে কমেছে, এটা খালি চোখেই বোঝা যায়। আগে সারা বছর মাছ মিললেও এখন আর তা নেই। বড় বড় মাছের দেখা মেলে না। ৪/৫টি মাছের অভয়াশ্রম ছিল, কিন্তু লোকবলের অভাবে এখন একটাও নাই। গত কয়েক বছর দ্রুত কমেছে মাছের উৎপাদন। বর্তমানে এখানে ৫৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাগুর, বাইম, তারা বাইম, গুলশা, গুতুম, টেংরা, তিতনা, গজার, গরিয়া, বেতি, কাকিয়া ইত্যাদি।'
দায়িত্বীশলরা যা বলছেন
বর্তমানে টাঙ্গুয়ার হাওরের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
হাওরেরর সার্বিক বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'অতিরিক্ত পর্যটকের চাপে টাঙ্গুয়ার হাওর তার জীববৈচিত্র্য হারাচ্ছে এবং এ কারণে আগামী পর্যটক মৌসুম থেকে হাওরের সংরক্ষিত এলাকায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পর্যটকদের নির্দিষ্ট একটি অংশে ইঞ্জিন নৌকায় থাকবেন আর হাওরের অভ্যন্তরে ভ্রমণের জন্য লগি-বৈঠার সাধারণ নৌকা ব্যবহার করতে পারবেন। এতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানও বাড়বে।'
তিনি বলেন, মেঘালয় থেকে আসা বালু-পাথর অপসারণের জন্য আপাতত নিলামের মাধ্যমে বিক্রির চিন্তাভাবনা হচ্ছে। সেজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড সমীক্ষাও শুরু করেছে। 'ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাসমূহের ডেপুটি কমিশনার ও ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্মেলনে বিষয়টির স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রস্তাব রাখব।'