জম্পেশ আড্ডা আর পরীবাগের স্ট্রিট ফুড
দামি দামি অভিজাত রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে আমরা অনেকে স্ট্রিট ফুডের দিকে চেয়েও দেখি না। কিন্তু স্ট্রিট ফুডও অনেক সময় স্বাদে, ঝোলে-ঝালে দামি রেস্তোরাঁর অভিজাত ডিশগুলোকেও হার মানায়।
রাজধানীর পরীবাগের পুরাতন এলিফ্যান্ট রোডে বিটিসিএল ভবনের নিচে রাস্তায় গড়ে উঠেছে ছোটখাটো একটি স্ট্রিট ফুড জোন। মাত্র কয়েকটি দোকানের সমাহারে সেখানে এসে ভিড় করছে শয়ে শয়ে মানুষ।
ভাজাপোড়া, চিজ-বার্গার, ফ্রাই-পিৎজা, চা-কফি, জুস-চিপস, কাবাবের স্বাদে জিভকে শান্তি দিচ্ছে তারা। ইয়ার-দোস্তের দল হরেক রকমের চা খেতে খেতে আড্ডায় মেতে উঠছেন, কাবাবের ওপর সস ঢালতে ঢালতে দিনশেষে ঘরে ফেরা চাকরিজীবীরা সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলছেন। হরেক রকম স্ট্রয়ে ফলের জুস বা মিল্ক শেকে চুমুক দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট শিশুর দল।
পরীবাগের এই রাস্তায় সন্ধ্যার পর থেকেই ভিড় জমা শুরু হয়। গোটা পাঁচ-ছয়েক দোকানে হরেক রকম খাবার তৈরি করা হয়। পুরাতন এলিফ্যান্ট রোডের দুই পাড়েই খাবারের দোকানগুলো বসে।
কাবাবের জন্য সেরা আল-মুসলিম কাবাব, পিৎজা আইটেম তৈরি করে লাইভ পিৎজা, নানা রকম চা নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছে পবলু, চিজ বার্গারের বিভিন্ন আইটেম নিয়ে বসেছে ফুড ট্রিট। এদের কেউ কেউ ভাজাপোড়ার পাশাপাশি ফ্রুট কর্নারও খুলেছে। ফ্রেশ জুস বার অ্যান্ড কফি হাউস নামে একটি ফলের জুসের দোকানও দেখলাম সেখানে।
বিকাল থেকেই এসব দোকানে খাবার তৈরির কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করা শুরু হয়। মশলা, সবজি, মাছ-মাংস সব কেটেকুটে সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়ে যায় ভাজাভাজি।
একজন ম্যানেজার গোছের লোক খরিদ্দারদের কাছ থেকে অর্ডার নেন। অর্ডার কেটে তিনি শেফ বা বাবুর্চিকে সে অনুযায়ী খাবার প্রস্তুত করতে বলেন। কোনো কোনো দোকানে টোকেনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
আল-মুসলিম কাবাবের ম্যানেজার বাবু খাতা-কলম হাতে নিয়ে খরিদ্দারদের কাছ থেকে অর্ডার কেটে কর্মচারীদের সেইমতো খাবার তৈরি করতে বলছেন। কথায় কথায় বাবু জানান, তিনি এখানে পার্ট-টাইম কাজ করেন। তার মতো অধিকাংশই পার্ট-টাইম কাজ করেন এখানে।
তিন মাস আগে তাদের এ দোকানটি চালু করা হয়েছিল বেইলি রোডে। ভালো সাড়া না পাওয়ায় এখন এটি এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। ছয়-সাতজন কর্মচারী দিয়ে দোকানটি চলে।
আল-মুসলিম কাবাবের কাবাব আইটেমগুলো সবচেয়ে বেশি চলে। তাদের অনেক বাঁধা খরিদ্দার আছেন, যারা নিয়মিত তাদের কাছ থেকে খাবার খান। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসে পার্সেল করে খাবার পাঠানো হয় এখান থেকে।
জুনায়েদ আহমেদ নামে একজন বলেন, 'মুসলিম কাবাব টেলিযোগাযোগ ভবনের সামনে যেদিন থেকে চালু হয়েছে, আমি ও আমার বন্ধুরা নিয়মিত আসছি। অল্প দামে ভালো খাবার পাওয়া যায় এ দোকানগুলোয়।'
স্ত্রী ফারজানা করিমকে সঙ্গে নিয়ে খাবার খেতে এসেছিলেন পিয়াস করিম। তারা দুজনেই একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি করেন। পরীবাগের স্ট্রিট ফুডের দোকানগুলোর স্বাস্থ্যমান নিয়ে তারা বলেন, 'আমরা তো অনেকদিন ধরেই পরীবাগে কাবাব আর কফি খেতে আসি। এখন পর্যন্ত মনে হয়নি এখানকার খাবারের স্বাস্থ্যমান বা গুণগত মান খারাপ।'
খোলামেলা জায়গায় গড়ে ওঠা দোকানগুলো টং বা ঢাবা ধরনের। দোকানগুলো আশেপাশে প্লাস্টিকের চেয়ার, টুল সাজিয়ে খরিদ্দারদের বসার ব্যবস্থা করেছে। কাবাবের থালা বা জুস কিংবা চায়ের কাপ হাতে সেখানে বসে মুখরিত হয় নানা বয়েসী মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারুক, শিমুল ও নাবিল নিয়মিত পরীবাগে আসেন খাবার খেতে। তাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল তাদের কাছে পরীবাগের স্ট্রিট ফুডের বিশেষত্ব ঠিক কোন জায়গায়।
তারা বলেন, 'চার দেয়ালের ভেতরে নয়, উন্মুক্ত খোলা জায়গায় বসে রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে পারছি; বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে আড্ডা মারতে পারছি—এটাই পরীবাগের স্ট্রিট ফুডের বিশেষত্ব।'
আল-মুসলিম কাবাবের খাবারের আইটেমগুলো হলো চিকেন শিক কাবাব, হাড়িয়ালি কাবাব, গরুর শিক কাবাব, গরু ও মুরগির বটি কাবাব। হিন্দি 'হাড়িয়ালি' অর্থ সবুজাভ। সবুজ রঙের হয় বলে এই চিকেন আইটেমটির নাম চিকেন হাড়িয়ালি কাবাব।
বারবিকিউ আইটেমের মধ্যে আছে চিকেন বারবিকিউ, কোরাল, রূপচাঁদা ও তেলাপিয়ার বারবিকিউ। অন্যান্য ফ্রাই আইটেমের মধ্যে আছে মগজ ফ্রাই, কাঁকড়া ফ্রাই, চিকেন ও বিফ চাপ। এগুলোর সঙ্গে সমানতালে লুচি ভাজা হচ্ছে। সবকিছুর সাথে স্যুপ আর সস তো আছেই।
খাবার অর্ডার দিলে পরিমাণ ও অর্ডারকারীর নাম খাতায় লিখে রাখা হয়। ক্রমান্বয়ে সেগুলো প্রস্তুত করে খরিদ্দারকে পরিবেশন করা হয়। খাওয়া শেষ করে দাম মিটিয়ে খরিদ্দারেরা কেউ মিল্কশেক, চকলেট শেক অর্ডার করেন; কেউ যান চা কর্নারের দিকে।
আল-মুসলিম কাবাবের ফিশ বারবিকিউয়ের আইটেমগুলো নতুন হলেও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ডেন্টাল শিক্ষার্থী তানহা তার বন্ধুদের নিয়ে ফিশ বারবিকিউ খেতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, 'এখানকার ফিশ বারবিকিউ পোড়ানো দেখতে, সাথে খেতে আমি কক্সবাজারের একটা ফ্লেভার পাই। কোরালটা আমার বেশি প্রিয়।'
ম্যানেজার বাবু জানান, বারবিকিউ ও কাবাবের জন্য মাছ, মুরগি ও গরুর মাংস তারা আশপাশের কারওয়ান বাজার, গুলশান বাজার ও যাত্রাবাড়ি বাজার থেকে নিয়ে আসেন।
আল-মুসলিম কাবাব থেকে আশেপাশে খাবারের পার্সেল পাঠানো হয়। পার্সেল পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ চার্জ কাটা হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে খাবারের আইটেমের দামে খাবারের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ছাড় দেওয়া হয়।
করোনা লকডাউনে সালাউদ্দিন অনিক নামক একজন শিক্ষার্থী একটি স্টার্ট-আপ শুরু করেন। পরে অনিক তার দুজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে 'পবলু' নাম দিয়ে একটি চা-কফির কর্নার চালু করেন।
অনিক বলেন, 'পবলু নাম দিয়েছি কারণটা খুব বিশেষ কিছু নয়। এই ধরুন, হাবলুর ভাই পবলু বেকার বসে আছে, সে আর কিছু করতে না পেরে চায়ের দোকান খুলে বসল। আমরাও তা-ই করেছি "পবলু" নাম দিয়ে।'
ছোট্ট পবলুর কর্ণধার অনিক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। সারাদিন ক্লাস-পড়াশোনা শেষে বিকাল থেকে দোকানে সময় দেন। তার বন্ধু সাকিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি পবলু-তে চা বানানোর কাজ করেন। শোয়াইব নামক আরেকজন চীনে পড়াশোনা করলেও করোনার কারণে সেখানে যেতে পারছেন না। তিনি অনিকের সাথে পরিবেশনার কাজ করেন।
পবলুতে অল্প দামে ভালো ভালো চায়ের আইটেম পাওয়া যায়। পবলুর খরিদ্দারদের সিংহভাগ তরুণ। তাদের জন্য বাহারি রকমের ঢাকনাওয়ালা চায়ের কাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পবলুতে চা খেতে আসা সুপর্ণা বলেন, 'পবলুর চা খেতে যেমন ইউনিক ওদের সার্ভিং স্টাইলটাও ইউনিক। গুড়ের চা-টা আমার বেশি ভালো লাগে।'
অনিক জানান, অধিকাংশ খরিদ্দারদের কাছে তাদের স্পেশাল আইটেম গুড়ের চা ও ওড়িও চা। পবলু নিয়ে তিন তরুণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এর আইটেমের সংখ্যা ও ব্রাঞ্চ বাড়ানো।
চিজ, ফ্রাইজ ও বার্গারের আইটেম নিয়ে পসরা খুলেছে 'ফুড ট্রিট'। ফুড ট্রিটের শেফ নীরব একইসাথে সেখানকার আপাত-কর্ণধার। তিনি জানান, 'আমাদের বার্গার ,স্যান্ডউইচ, ফ্রাইয়ের আইটেমগুলো বেশি চলে। তবে, ইদানীং ফিশ বার্গারের চাহিদা বেড়েছে।'
ফুড ট্রিটে চিকেন চিজ, চিজ প্যাটি, বারবিকিউ ও স্মোকি বারবিকিউ, টুইন চিজ ও মিনি চিকেন বার্গার পাওয়া যায়। চিকেন সাব, চিজ সাব, বারবিকিউ সাব—এ তিন রকমের স্যান্ডউইচ পাওয়া যায় সেখানে। অল্প দামে চারপিস চিকেন উইংসও পাওয়া যায় ফুড ট্রিটে।
লাইভ পিৎজায় কাস্টমারের অর্ডার নিয়ে পিৎজা বানানো হয়। চার-পাঁচজন তরুণ পিৎজার অর্ডার নেওয়া থেকে পরিবেশনা পর্যন্ত যুক্ত থাকেন। লাইভ পিৎজায় পিৎজার দাম তুলনামূলক বেশি। ৯ ইঞ্চি ও ১০ ইঞ্চি দু-ভাগে পিৎজাগুলোকে ভাগ করা হয়েছে।
চিকেন, বিফ, বারবিকিউ, টুনা, হট অ্যান্ড স্পাইসি, চিকেন মিটবল পিৎজা—এগুলো নয় ইঞ্চি ক্যাটাগরির। চিকেন সুপ্রিম, চিকেন তন্দুরি, চিজ ব্লাস্ট, ফোর সিজন, ইটালিয়ান, বি স্পেশাল, মিট পিৎজা—এগুলো দশ ইঞ্চি ক্যাটাগরির। এগুলোর মূল্য নয় ইঞ্চির চেয়ে বেশি।
লাইভ পিৎজায় কাঠে পুড়িয়ে পিৎজা তৈরি করা হয় বলে এদের প্রসপেক্টাসের নিচে লেখা 'উড ফায়ারড পিৎজা'।
এখান থেকে অনেকে পিৎজা অর্ডার করে নিয়ে যান। তবে খরিদ্দারদের কেউ কেউ পিৎজার দাম ও পরিবেশনা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। সাইদুল ইসলাম নামক একজন বলেন, 'লাইভ পিৎজায় অর্ডার করলে পিৎজা রেডি করতে বেশি সময় নেয় ওরা।'
নিয়মিত পরীবাগে স্ট্রিট ফুড খেতে আসেন তাহমিনা মৌ। এই শিক্ষার্থীও লাইভ পিৎজার পরিবেশনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, 'পিৎজা বয়সহ যারা পিৎজা পরিবেশনা করে তাদের আচরণে অনেকসময় আন্তরিকতার অভাব দেখা যায়। পিৎজার মান আর স্বাদ ভালো, তবে দামটা একটু বেশি।'
পরীবাগের স্ট্রিট ফুডের দোকানগুলো মিলে গড়ে উঠেছে একটি স্ট্রিট ফুড জোন। দোকানগুলোতে মোটামুটি ২৫-৩০ জন মানুষ কাজ করেন, যাদের অধিকাংশই তরুণ। তাদের অনেকে এখানে পার্ট-টাইম চাকরি করেন।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছুটির দিনগুলোয় তাদের বেচাকেনা বেশি হয়। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে লোকজনের আনাগোনা বেশি থাকে। অন্যান্য ছুটির দিনের হালও একই। মাসের শেষের দিকে বিক্রির পরিমাণ কমে যায়। শুরুর দিকে আবার বেশি থাকে।
দোকান মালিকদের সবার দাবি, কেউ পৃষ্ঠপোষকতা না করুক, কোনোভাবেই যেন এই দোকানগুলো আর বন্ধ করা না হয়।