লেখার ভুল ঠিক করে দিয়ে তারা দুজন এখন বিলিয়নেয়ার!
ব্র্যাড হুভার চান, মানুষ যেন ত্রুটিমুক্ত, কুম্ভীলকবৃত্তিমুক্ত ইংরেজি লেখে। কারও ইংরেজি লেখায় যেন ব্যাকরণগত কোনো ভুল না থাকে।
পেশায় তিনি শিক্ষক বা রাজনীতিবিদ নন। ৪৩ বছর বয়সি হুভার ছিলেন ভেনচার ক্যাপিটালিস্ট (নতুন উদ্যোগে বিনিয়োগকারী)। বর্তমানে তিনি স্যান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক গ্রামারলি ইনকরপোরেটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। কোম্পানিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে লেখার মান বৃদ্ধি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে।
২০০৯ সালে গ্রামারলির পত্তন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীসংখ্যা এখন ৬০০-র বেশি। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এর দৈনিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩০ মিলিয়ন। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর ১৪ ট্রিলিয়ন শব্দ বিশ্লেষণ করে। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে ইংরেজি মূল ভাষা নয়, সেখানে গ্রামারলির বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ সবচেয়ে বেশি রয়েছে বলে জানান হুভার।
গত নভেম্বরে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেয়ে গ্রামারলি এখন ১৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কোম্পানি। এর সুবাদে গ্রামারলি এখন যেকোনো টেক স্টার্ট-আপ কোম্পানির জন্য স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান।
এর আগে ২০১৯ সালে গ্রামারলি ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি তহবিল সংগ্রহ করে। এর কয়েক মাস পরই শুরু হয় কোভিড মহামারি। তার জেরে বিশ্বজুড়ে ঘরবন্দি হয়ে যান লাখ লাখ অফিসকর্মী। বাড়িতে বসে কাজ করার সময় চাকরিজীবীদের নিয়মিত সহকর্মীদের কাছে ইমেইল পাঠাতে হয়।
হুভার বলেন, 'আমরা দেখলাম, ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু হওয়ার পর আমাদের ব্যবসার গতি বেড়ে গেছে। আগে লোকে নিজেদের ডিভাইস ব্যবহার করে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় বের করে ফেলত। তবে এখন এমন একটা সময় এসেছে যখন যোগাযোগের জন্য মানুষকে সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হয়।'
গ্রামারলির কল্যাণে অন্তত দুজন মানুষ বিলিয়নেয়ার বনে গেছেন—কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ম্যাক্স লিটভিন ও অ্যালেক্স শেভচেঙ্কো। তাদের প্রত্যেকেই এখন অন্তত ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির মালিক। আর যারা তহবিল সংগ্রহে সাহায্য করেছিলেন, তারা কোম্পানিটির ২৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক।
হুভার অবশ্য গ্রামারলির তৃতীয় সহপ্রতিষ্ঠাতা কি না, তা সংবাদমাধ্যমকে বলতে রাজি হননি।
খুব অল্প কয়েকটা প্রযুক্তি কোম্পানির শেকড়ই সাবেক সোভিয়েত ব্লকে প্রোথিত। এই মুষ্টিমেয় প্রযুক্তি কোম্পানির একটি গ্রামারলি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিশ্চান ইউনিভার্সিটি অভ কিয়েভে ব্যবসায় প্রশাসন নিয়ে পড়ার সময় ১৯৯০-এর দশকে বন্ধুত্ব হয় গ্রামারলির দুই প্রতিষ্ঠাতা শেভচেঙ্কো ও লিটভিনের মধ্যে। এরপর তারা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় চলে যান এ বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর পড়তে। কুম্ভীলকবৃত্তি, অর্থাৎ লেখা চুরি ঠেকাতে আগে একটি কোম্পানিকে সফটওয়্যার তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন এই দুজন। সেখান থেকেই তাদের মাথায় গ্রামারলির আইডিয়া আসে।
শেভচেঙ্কো বলেন, তারা গ্রামারলি প্রতিষ্ঠা করেন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মানুষকে সহজে যোগাযোগস্থাপনে সাহায্য করবার জন্য।
গ্রামারলি বড় আকারের সাফল্য পায় ২০১৪ সালে, কিছু বেসিক ফিচারসহ একটি ফ্রি প্ল্যান চালু করার পর। এর এক বছর পরই গ্রামারলি ফ্রি ব্রাউজার এক্সটেনশন ছাড়ে। এর সুবাদে প্রতিষ্ঠানটির একটি বিশ্বস্ত গ্রাহকভিত্তি গড়ে ওঠে। অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও নাম লেখায় তাদের গ্রাহকের তালিকায়।
ব্র্যাড হুভার এক দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন গ্রামারলিতে। ভেনচার-ক্যাপিটাল ফার্ম জেনারেল ক্যাটালিস্ট পার্টনারস থেকে ২০১১ সালে তিনি এখানে যোগ দেন। নিজের লেখার উন্নতির জন্য সাহায্য খুঁজছিলেন তিনি, তখনই এই সফটওয়্যারের খোঁজ পান।
হুভার বলেন, 'প্রোডাক্ট ও টিম আমার মন কেড়ে নিয়েছিল। আমাদের প্রতিষ্ঠা আমেরিকার বাইরে, এবং কোম্পানির বয়স আট বছর হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা কোনো টাকা পাইনি। আর আমরা যে লাভ করছি, এটা এক অনন্য ব্যাপার।'
আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী ধাপে বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে গ্রামারলি। একটা চ্যালেঞ্জ হলো, বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, গ্রামারলির সফটওয়্যার মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশের ধরনকে মৌলিকভাবে বদলে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের এই উদ্বেগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের অন্যান্য উদ্বেগেরই প্রতিফলন। গুগলের সাবেক নির্বাহী কাই ফু লি পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, ১৫ বছরের মধ্যে মানুষের ৪০ শতাংশ কাজের দখল নিতে পারে অটোমেশন।
দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর ইংরেজি ভাষার শিক্ষার্থীদের গ্রামারলির মতো সফটওয়্যারগুলো কতটা প্রভাবিত করেছে, তা নিয়ে গবেষণা করেছেন টেনেসির অস্টিন পি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যান্ড্রিয়া লি। তিনি বলেন, 'প্রকৃত যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা গ্রামারলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে অ্যাসাইনমেন্ট করার সময় তারা প্রয়োজনীয় পরিশ্রম না-ও করতে পারে।'
হুভার অবশ্য জানান যে, মানুষের অভিব্যক্তি বদলে যাওয়ার ব্যাপারে গ্রামারলি সচেতন। তাই তারা ব্যবহারকারীদের লেখা সম্পূর্ণ অটোমেট না করে 'শিক্ষণ মুহূর্ত' সংবলিত ফিডব্যাক দেন।
এছাড়া মাইক্রোসফট এডিটরসহ বেশ কিছু নতুন এআইচালিত লিখন-সহায়ককে মোকাবিলা করতে হবে গ্রামারলিকে। নতুন নতুন পণ্য নিয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে চেষ্টা করতে প্রতিষ্ঠানটি। ডেস্কটপ, ডেভেলপারদের জন্য আলাদাভাবে গ্রামারলি নিয়ে আসছে। এছাড়াও স্যামসাং কিবোর্ডের সঙ্গেও পার্টনারশিপে যাচ্ছে গ্রামারলি।
আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি অধ্যাপক জিম রানালি লেখার কোর্সের জন্য ১ হাজার ৫০০ গ্রামারলি প্রিমিয়াম লাইসেন্স কিনতে সাহায্য করেছেন শিক্ষার্থীদের। তিনি জানান, সাবজেক্ট-ভার্ব অ্যাগ্রিমেন্ট, ভুল প্রিপোজিশন ও বাদ পড়ে যাওয়া আর্টিকেল ঠিকঠাক করার জন্য গ্রামারলির ফিডব্যাক বেশি উপকারী।
রানালি বলেন, 'আমার লেখা ইমেইলে বরাবরই এটি এক-দুটো ভুল্ভাল খুঁজে বের করে।'
গ্রামারলি আশা করছে, তাদের সহায়তায় লেখা ত্রুটিমুক্ত ইমেইল বা চিঠি ব্যবসাজগতের ঝামেলা কমিয়ে দেবে। গত মাসে চালানো হ্যারিস পোল সমীক্ষা অনুসারে, মার্কিন কোম্পানিগুলো দুর্বল যোগাযোগের কারণে বছরে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হতে পারে।
হুভার বলেন, তাদের উদ্দেশ্য মানুষে মানুষে যোগাযোগ আরও ত্রুটিমুক্ত ও সহজতর করে দেওয়া, ভুল যোগাযোগের ফলে সৃষ্ট বিবাদ কমানো।
- সূত্র: এনডিটিভি