মুজতবা আলীর হাস্যরস
[আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা উপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা সৈয়দ মুজতবা আলী। ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে তার জন্ম। শিক্ষাজীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে শান্তিনিকেতনে। সেখানে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফারসি, হিন্দি, গুজরাতি, ফরাসি, জার্মানি, ইতালীয়সহ পনেরোটি ভাষা শেখেন। পড়াশোনা ও চাকরির জন্য—এবং নেহাত ঘোরার নেশায়—পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছেন মুজতবা আলী। রম্য রচনায় বাংলা সাহিত্যে তিনি অদ্বিতীয়। আজ এই সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবস। সে উপলক্ষে মুজতবা আলীর কিছু রম্য-রচনা রইল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকদের জন্য]
১.
গল্পে শুনিয়াছি, এক পাগলা মার্কিন নাকি পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, 'হস্তী' সম্বন্ধে যে সর্বোৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লিখিবে তাহাকে এক লক্ষ পৌন্ড পারিতোষিক দেওয়া হইবে।
...সে যাহাই হউক, খবর শুনিবামাত্র ইংরাজ তৎক্ষণাৎ কুকের আপিসে ছুট দিল। হরেক সাজসরঞ্জাম যোগাড় করিয়া পক্ষাধিককাল যাইতে না যাইতেই সে আমাদের বনে উপস্থিত হইল ও বৎসর শেষ হইবার পূর্বেই কেতাব লিখিল 'আসামের পার্বত্যাঞ্চলে হস্তী শিকার'।
ফরাসী খবর শুনিয়া ধীরে সুস্থে চিড়িয়াখানার দিকে রওনা হইল। হাতিঘর বা পিলখানার সম্মুখে একখানা চৌকি ভাড়া লইয়া আস্তে আস্তে শ্যাম্পেনে চুমুক দিতে লাগিল। আড়নয়নে হাতিগুলির দিকে তাকায় আর শার্টের কফে নোট টোকে। তিন মাস পর চটি বই লিখিল 'লামুর পারমি লেজেলেঁফা' অর্থাৎ 'হস্তীদের প্রেমরহস্য'।
জর্মন খবর পাইয়া না ছুটিল কুকের আপিসে, না গেল চিড়িয়াখানায়। লাইব্রেরীতে ঢুকিয়া বিস্তর পুস্তক একত্র করিয়া সাত বৎসর পর সাত ভলিউমের একখানা বিরাট কেতাব প্রকাশ করিল; নাম 'আইনে কুর্ৎসে আইনক্যুরুঙ ইন ডাস স্টুডিয়ম ডেস এলোফান্টেন', অর্থাৎ 'হস্তীবিদ্যার সংক্ষিপ্ত অবতরণিকা'।
গল্পটি প্রাক-সভিয়েট যুগের। তখনকার দিনে রুশরা কিঞ্চিৎ দার্শনিক ভাবালু গোছের ছিল। রুশ খবর পাইয়া না গেল হিন্দুস্তান না ছুটিল চিড়িয়াখানায়, না ঢুকিল লাইব্রেরীতে। এক বোতল ভদকা ও ত্রিশ বাণ্ডিল বিড়ি লইয়া ঘরে খিল দিল। এক সপ্তাহ পরে পুস্তক বাহির হইল, 'ভিয়েদিল লিলি ডি এলেফান্ট?' 'তুমি কি কখনও হস্তী দেখিয়াছ?' অর্থাৎ রুশ যুক্তি-তর্ক দ্বারা প্রমাণ করিয়া ছাড়িল যে হস্তী সম্বন্ধে যে সব বর্ণনা শোনা যায় তাহা এতই অবিশ্বাস্য যে তাহা হইতে এমন বিরাট পশুর কল্পনা পর্যন্ত করা যায় না। অর্থাৎ হস্তীর অস্তিত্ব প্রমাণাভাবে অস্বীকার করিতে হয়।
আমেরিকান এইসব পন্থার একটাও যুক্তিযুক্ত মনে করিল না। সে বাজারে গিয়া অনেকগুলি হাতি কিনিল ও বক্রার্থে নয়, সত্য সত্যই 'হাতি পুষিল'। কুড়ি বৎসর পরে তাহার পুস্তক বাহির হইল 'বিগার অ্যান্ড বেটার এলিফেন্টস—হাউ টু গ্রো দেম' অর্থাৎ 'আরো ভাল ও আরও বৃহৎ হাতি কি করিয়া গজানো যায়'। শুনিয়াছি আরও নানা জাতি প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে হস্তীর স্বদেশবাসী এক ভারতবাসীও নাকি ছিলেন। কিন্তু 'নেটিভ' 'কালা আদমী' বলিয়া তাঁহার পুস্তিকা বরখাস্ত-বাতিল-মকুব-নামঞ্জুর-ডিসমিস-অসিদ্ধ করা হয়। অবশ্য কাগজে-কলমে বলা হইল যে, যেহেতু ভারতবাসী হস্তীকে বাল্যাবস্থা হইতে চিনে, তাই তাঁহার প্রত্যক্ষ জ্ঞান তাহাকে পক্ষপাতদুষ্ট করিতে পারে।
গল্পটি শুনিয়া হস্তী সম্বন্ধে জ্ঞান বাড়ে না সত্য, কিন্তু ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও মার্কিন সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ ঘোলাটে ধারণা তবুও হয়।
২.
আড্ডাবাজরা বলতে চান, বাংলার বাইরে নাকি আড্ডা নেই। কথাটা ঠিকও, ভুলও। তুলনা দিয়ে নিবেদন করছি। সিন্ধুনদ উজিয়ে যে মাছ ধরা পড়ে, তার নাম 'পাল্লা'—অতি উপাদেয় মৎস্য। নর্মদা উজিয়ে ভরোচ শহরে যে মাছ ধরা পড়ে, তার নাম 'মাদার'—সেও উপাদেয় মৎস্য। আর গংগা উজিয়ে যে মাছ বাংগালীকে আকুল উতলা করে তোলে, তার নাম 'ইলিশ'—খোট্টা মুল্লুকে পৌঁছনর পর তার নাম হয় হিলসা।
উপর্যুক্ত সব মাছ একই বস্তু—দেশ ভেদে ভিন্ন নাম। তফাৎ মাত্র এইটুকু যে সরষে বাটা আর ফালি ফালি কাঁচা লংকা দিয়ে আমরা যে রকম ইলিশ দেবীর পূজা দি বাদবাকিরা ওরকম পারে না।
অর্থাৎ আড্ডা বহু দেশেই আছে, শুধু আমাদের মত তরিবৎ করে রসিয়ে রসিয়ে চাখতে তারা জানে না।
৩.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার খবর শুনে এক বুড়ো শিখ মেজর জিজ্ঞেস করলেন, ' কে কার বিরুদ্ধে লড়ছে?'
'ইংরেজ-ফরাসি জর্মনির বিরুদ্ধে।'
সর্দারজি আপসোস করে বললেন, 'ফরাসি হারলে দুনিয়া থেকে সৌন্দর্য চর্চা উঠে যাবে আর জর্মনি হারলেও বুরী বাৎ, কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান কলাকৌশল মারা যাবে।' কিন্তু ইংরেজরা হারা সম্বন্ধে সর্দারজী চুপ।
'আর যদি ইংরেজ হারে?'
সর্দারজী দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, 'তবে দুনিয়া থেকে বেইমানী লোপ পেয়ে যাবে।'
৪.
ফ্রান্সে এক বিচারক ছিলো, যিনি এজলাসে বসে সারাটা সময় শ্যাম্পেন-শেরি ঢেলে ঝিমাতেন, কোন উকিল কোন নথি উত্থাপন করলেই লাল লাল চোখ অর্ধেকটা খুলে জিজ্ঞেস করতেন, "শেরশে লে ফাম" (মেয়েটি কই?)।
বিচারক বিশ্বাস করতেন সব ঘটনার পেছনেই মেয়েমানুষ আছে, মেয়ে ছাড়া এ দুনিয়ায় কোন ঘটনা ঘটে না।
একদিন একটা কেস আসলো, এক গৃহনির্মাণ কর্মী ছয়তলা বাড়ির ওপরে কাজ করতে গিয়ে পড়ে মরে গেলো। কর্মীর মা আদালতে বললেন, গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে তাঁর ছেলে মারা গেছে।
তো ভিকটিমের পক্ষের উকিল কেস নিয়ে কথা বলতে যেতেই বিচারক ঠিক একইভাবে বললেন, "শেরশে লে ফাম" (মেয়েটি কই?)।
গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষের উকিল ছিলো খুব চালু। সেও বিশ্বাস করতো সকল ঘটনার পেছনেই মেয়েমানুষ আছে! সে বললো, 'মি লর্ড, আমাকে কয়দিন সময় দিন, আমি মেয়ের খবর আনছি।'
বিচারক তাঁকে দুই দিন সময় দিলেন।
উকিল চলে গেল সেই গৃহনির্মাণ স্থানে। একে জিজ্ঞেস করেন, ওকে জিজ্ঞেস করেন, তাকে চা খাওয়ান, ওকে বিয়ার খাওয়ান। এক দিন গেলো, দেড় দিনও পার হলো, উকিলের মাথা খারাপ, কোন সূত্র যদি না হাজির করতে পারেন, তবে তাঁর ক্লায়েন্ট হেরে যাবে। প্রচুর টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য!
বিকেল বেলা সেই ছয় তলায় উঠে চার পাশ দেখছেন তিনি মাইক্রোস্কোপ, টেলিস্কোপ দিয়ে, সূত্র কই? সূত্র কই?
এমন সময় এক চ্যাংড়া শ্রমিক আর একজন শ্রমিককে বলে উঠলো, ''দ্যাখ, নিকোল, সেই ফ্রলাইন আজও নিচের পথ দিয়ে যাচ্ছে।'
উকিলও নিচে তাকিয়ে দেখেন একটি উদ্ভিন্নযৌবনা সুন্দরী একটা মিনি স্কার্ট পরে গুট গুট করে হেটে যাচ্ছে নিচের রাস্তা দিয়ে।
উকিল চ্যাংড়াকে জিজ্ঞেস করলো, 'মেয়েটা কি রোজ এই সময় এই পথ দিয়ে হেঁটে যায়?'
চ্যাংড়া বলল, 'হ্যাঁ, হের লইয়ার! রোজই!'
উকিল জিজ্ঞেস করলো, 'যেদিন ফারদি, মানে ফারদিনান্দ পড়ে গিয়েছিল, সেদিনও মেয়েটি নিচের পথ দিয়ে গিয়েছিল?'
চ্যাংড়া বলল, 'হ্যাঁ হের লইয়ার! ফারদি তো ওকে দেখতে গিয়েই...!'
কোর্টে প্রমাণিত হয়ে গেল, নিহত শ্রমিক গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে মারা যায়নি, বরং নিজের কর্তব্যে অবহেলা করে অন্য দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করায় অসতর্ক হয়ে গিয়ে নিচে পড়ে মারা গেছে। গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষের কোন দোষ নেই। গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষ বেকসুর খালাস হয়ে গেলো!
তবে মানবিক কারণে গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষ যেন নিহত শ্রমিকের মাকে কিছু অর্থ সাহায্য করেন!
৫.
সেই সনাতন প্রশ্নে, কোন দেশের রমণী সবচেয়ে সুন্দরী হয়।
অবান্তর নয়, তাই নিবেদন করি, দেশ বিদেশ ঘুরেছি, অর্থাৎ ভ্যাগাবন্ড হিসাবে আমার ঈষৎ বদনাম আছে। কাজেই আমাকে কেউ শুধান, কোন দেশের রান্না সবচেয়ে ভাল, কেউ শুধান, তুলনাত্মক কাব্যচর্চার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশস্ততম, আর অধিকাংশ শুধান, কোন দেশের রমণী সবচেয়ে সুন্দরী?
জর্মন মেয়ে বিদেশীকে প্রচুর খাতির যত্ন করে, প্রেমে পড়ে ফরাসিনীর চেয়েও বেশি, কিন্তু তৎসত্ত্বেও আপনি চিরদিনই তার কাছে 'আউস্ল্যান্ডার' (আউটল্যান্ডার), বা 'বিদেশীই' থেকে যাবেন—কিন্তু ফরাসিনীর মনে অন্য ভাগাভাগি। তার কাছে পৃথিবীতে দুই রকম লোক আছে—কলচরড আর আনকলচরড। ফরাসী, বিদেশী এই দুই স্পৃশ্য অস্পৃশ্য বাদ-বিচার তার মনে কখনো ঢোকে না।
তবে এ-কথা অস্বীকার করার যো নেই, ফরাসি মেয়েরা আর পাঁচটা দেশের মেয়েদের তুলনায় বেশি বিদগ্ধ। গান বোঝে, সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করে, নাচতে জানে, ওয়াইনে বানচাল হয় না, অপ্রিয় সত্য এড়িয়ে চলে, পলিটিক্স নিয়ে মাথা ঘামায় কম এবং জান-ফাত, সাদা-কালো, দেশী-বিদেশী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সংস্কারবিবর্জিত। ভালো লেগেছে, তাই হামেশাই দেখতে পাবেন, দেবকন্যার মত সুন্দরী ফরাসিনী যমদূতের মত বিকট হাবশীর সংগে সগর্বে সদম্ভে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্যারিসের মেয়েরা সুন্দরী বটে। ইংরেজ মেয়ে বড্ড ব্যাটামুখো, জর্মন মেয়েরা ভোঁতা, ইতালিয়ান মেয়েরা ভারতবাসীর মত (তাদের জন্য ইয়োরোপে আসার কী প্রয়োজন?)। আর বলকান মেয়েদের প্রেমিকরা হরবকতই মারমুখো হয়ে আছে (প্রাণটা তো বাঁচিয়ে চলতে হবে)। তার উপর আরো একটা কারণ রয়েছে—ফরাসী মেয়ে সত্যি জামা-কাপড় পরার কায়দা জানে—অল্প পয়সায়—অর্থাৎ তাদের রুচি উত্তম।
৬.
শুনতে পাই প্যারিসে হরদম ফুর্তি, সেটা কি তবে ডাহা মিথ্যে?
নিশ্চয়ই নয়। প্যারিসে ফুর্তির কমতি নেই। কিন্তু সে ফুর্তিটা করে অ-ফরাসীরা। যৌন ব্যাপারে ইংরেজের ভন্ডামি সকলেই অবগত আছেন—লরেন্স সেটা বিশ্বসংসারের কাছে গোপন রাখেননি। তাই ইংরেজ মোকা পেলেই ছুটে যায় প্যারিসে। পাড়া-প্রতিবেশী তো আর সেখানে সঙ্গে যাবে না—বেশ যাচ্ছেতাই করা যাবে। শুধু ইংরেজ নয় আরও পাঁচটা জাত আসে, তবে তারা আসে খোলাখুলি সরাসরিভাবে—ইংরেজের মতো 'ফরাসী আর্ট' দেখার ভান করে না। কোনো জর্মনকে যদি বার্লিনে শুনতে পেতুম বলছে, 'ভাই হপ্তাখানেকের জন্যে প্যারিসে চললুম' তখন সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেতুম আর পাঁচজন মিতমিটিয়ে হাসছে—অবশ্য প্রথম জর্মনও সে হাসিতে যোগ দিতে কসুর করছে না।
৭.
সাধুবাবার এক চ্যালা ভদ্রলোককে দলে টানতে বলছেন, "জানেন মশায়, বাবা তিরিশ বছরের সাধনায় এখন হেঁটে নদী পার হতে পারেন!"
ভদ্রলোক তখন আশ্চর্য হয়ে বললেন, 'দুই টাকা দিয়েই তো খেয়াতে করে নদী পার হওয়া যায়, তার জন্য তিরিশ বছরের সাধনার দরকার কী?'