ডা. রিদওয়ানুর রহমান: স্বাস্থ্য খাতের এক নক্ষত্রের বিদায়
অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান, বাংলাদেশে মেডিসিন বিভাগের একজন কিংবদন্তি শিক্ষক ও দেশবরেণ্য চিকিৎসক। পাশপাশি ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ে অসংখ্য গবেষণা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানকে।
১৯৮৩ সালে বিসিএস পঞ্চম ব্যাচের মাধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন রিদওয়ানুর রহমান। ২০১৭ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেলেও মানুষের সেবা করা থেমে থাকেনি। গবেষণা করেছেন, রোগী দেখেছেন, কোভিড-১৯ মহামারিসহ বিভিন্ন দুর্যোগে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজর ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন ডা. রিদওয়ানুর রহমান। তার দুই ব্যাচ জুনিয়র, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রথমত তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ডাক্তাররা সাধারণত মেধাবী হন, কিন্তু তিনি এক্সট্রাঅর্ডিনারি জিনিয়াস ছিলেন। খুবই ভালো চিকিৎসক, অর্থাৎ ক্লিনিশিয়ান। ভালো ক্লিনিশিয়ানরা সাধারণত ভালো শিক্ষক হন না, কিন্তু তিনি ভালো শিক্ষক ছিলেন। আবার শিক্ষক ও ক্লিনিশিয়ান যারা ভালো হন, তারা ভালো গবেষক হন না, কিন্তু তিনি ভালো গবেষকও ছিলেন।'
'এর পাশাপাশি তিনি খুবই ভালো মানুষ, নির্লোভ ও বন্ধুবৎসল ছিলেন। নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে ছিলেন নিট-অ্যান্ড ক্লিন,' বলেন ডা. সায়েদুর রহমান।
ডা. রিদওয়ানুর রহমানের পড়ানোর বিষয়ে তার শিক্ষার্থী ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. আসিফ উর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, 'ডা. রিদওয়ানুর রহমান স্যার যা পড়াতেন, তার বেশিরভাগই ওনার নিজের ব্রেনে ফিল্টার করে সাজানো থাকতো, উনি ১০০ বইয়ের রেফারেন্স একসাথে কম্পাইল করতে পারতেন, কী নিখুঁত। আমি তখন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এফসিপিএস পার্ট ১ করে মেডিসিন ট্রেনি করছি। অ্যাডমিশন ডে-তে এক রোগীর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন রোগীর ডান দিকে ফুসফুসের সমস্যার কথা। পরে এক্সরে করে দেখা গেল ওই রোগীর ফুসফুসের ডানপাশ পুরো সাদা।
'পরের দিন রাউন্ডে এসে বললেন—আসো বাচ্চারা! আজ তোমাদের Decubitus পড়াব, কোন রোগী কোন পজিশানে থাকলে কী কী রোগ মাথায় আনবা। আহা ক্লাস! আহা, রোগ নির্ণয়। আহা, পড়ানোর স্টাইল, আহা কনফিডেন্স!'
ডা মোবাসসির হাসান লিমন নামের তার আরেক ছাত্র ফেসবুকে লিখেছেন, 'সারাজীবন ফাঁকিবাজ হলেও স্যারের লেকচার, রাউন্ড শোনার জন্য আগ্রহী ছিলাম সবসময়। পড়াশোনাকে কত সহজ মনে হতো স্যারের আন্ডারে থাকাকালীন। পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করার মতো আগ্রহ যখন পেতাম না, তখন স্যারের একটা কথা বারবার মাথায় আসতো—"when you prescribe medicine for every single complain, পেশেন্ট কথা বললেই ওষুধ, then you are nothing but a trained quack".'
ডা. রিদওয়ানুর রহমানের গবেষণা চিকিৎসাবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তার ১৬৭টি পাবলিকেশন ও ৫ হাজার ২৮৪টি সাইটেশন রয়েছে। সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর ডা. রিদওয়ানুর রহমান ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজের গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ডা. রিদওয়ানুর রহমানের সঙ্গে বেশ কিছু গবেষণা করেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
ডা. টিবিএসকে হেলাল বলেন, 'ডা. রিদওয়ানুর রহমান শুধু খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ছিলেন না, তিনি একজন গবেষকও ছিলেন। সর্প দংশন, ম্যালেরিয়া ও অসংক্রামক রোগ নিয়ে রেকর্ডসংখ্যক গবেষণা করেছেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে তার মতো সেকেন্ড ম্যান আর তৈরি হবে না।'
ডা. রিদওয়ানুর রহমান ছিলেন বন্ধুবৎসল মানুষ। চট্টগ্রামের আমিলাইষ কাঞ্চনা বঙ্গ চন্দ্র ঘোষ ইনষ্টিটিউট স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তিনি। সেই স্কুলে তার সঙ্গে প্রথম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা আব্দুল মালেক।
আব্দুল মালেক টিবিএসকে বলেন, 'প্রতি বছর রমজান মাসে রিদওয়ানের বাড়িতে আমাদের স্কুলের সব বন্ধুদের নিয়ে ইফতার পার্টি হয়। স্কুলের সব বন্ধুর সাথে তার যোগাযোগ ছিল। প্রতি বছর ঈদের সময় বাড়িতে এসে স্থানীয় হাটে এক চিকিৎসকের চেম্বারে বিনামূল্যে রোগী দেখত ও। কিন্তু সিরিয়াল ভেঙে কখনো রোগী দেখেনি। ও বলতো, সিরিয়াল ভেঙে কাউকে আগে দেখলে রোগীরা মনে মনে আমার বাবা-মাকে গালি দেবে। আমাদের এলাকার যে-কারো মেডিসিনের কোনো সমস্যা হলে আমরা ওর সাথে যোগাযোগ করতাম।'
কোভিড-১৯ মহামারির সময় ডা. রিদওয়ানুর রহমান সরকারকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন।
২০২০ সালের শুরুতে কোভিড মহামারির সময় থেকে ডা. রিদওয়ানুর রহমান স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয়। করোনা থেকে মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, সাধারণ মানুষের কী ধরনের সাবধনতা মেনে চলা প্রয়োজন, তা নিয়ে নানা ধরনের পরামর্শ দিতেন তিনি। দিন-রাত যেকোনো সময় স্যারকে ফোন করলে, সবসময় একবারেই ফোন রিসিভ করতেন, শত ব্যস্ততার মধ্যেও কমেন্ট দিতেন। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে যাওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা হতো স্যারের সঙ্গে। এখন দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব চলছে। ডেঙ্গু বিষয়ক বিভিন্ন সংবাদের জন্য স্যারের সঙ্গে নিয়মিত কথা হতো।
৬৫ বছর বয়সে মহান এই সেবক বুধবার সকালে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। তার এই আকস্মিক মৃত্যুর ক্ষতি দেশের জন্য অপূরণীয়।