হাতের নাগালেই সৈকতের উন্মুক্ত লাইব্রেরি
লাইব্রেরির কথা বললে আমাদের মাথায় সর্বপ্রথম কোন ছবিটা আসে? সারি সারি বইয়ের তাকে সাজানো অজস্র বই। বইপ্রেমী মাত্রই লাইব্রেরির স্নিগ্ধ পরিবেশের কথা স্বীকার করবেন। চার দেয়ালে আবদ্ধ সেসব লাইব্রেরিতে রয়েছে পিনপতন নিরবতা। তবে রাজধানী ঢাকায় রাস্তার পাশে কখনো উন্মুক্ত লাইব্রেরি দেখেছেন? তা-ও আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মতো ব্যস্ততম স্থানে! এরকম জনবহুল এলাকায় উন্মুক্ত লাইব্রেরির কথা কল্পনা করেছিল কেউ?
এমন একটি অভাবনীয় কাজই করে দেখিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র তানভীর হাসান সৈকত। ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন কেন্দ্র (টিএসসি) সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৩ নম্বর গেইটের সামনে প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যেগেই তৈরি করেছেন 'উন্মুক্ত লাইব্রেরি'।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান গেইটে পৌঁছাতেই লাইব্রেরিটি চোখে পড়বে। কালো কাঠের পাটাতনের ওপর তিন তাকওয়ালা কাঠের একটি রঙিন বুকশেলফ। সদ্য প্রতিষ্ঠিত উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন লেখকের বই। লাইব্রেরির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে রাখা হয়েছে বাহারি গাছ। এছাড়া, উদ্যানের সীমানা প্রাচীরের সাথে সাঁটানো হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত কিছু ছবি। এগুলোর মধ্যে ৭ মার্চের ভাষণের ছবি, জাতির পিতার জন্মদিন পালন এবং বিভিন্ন স্থানে ভাষণের ছবি উল্লেখযোগ্য। বুক শেলফের ডান পাশে রাখা বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর প্রতীকী ছবিটি যেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অম্লান স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়া, লাইব্রেরির একাংশে রাখা বোর্ডে অঙ্কিত কারুকাজ উন্মুক্ত লাইব্রেরির নান্দনিকতাকে আরেক ধাপে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
শুরুর গল্প
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে এমন রুচিশীল একটি উদ্যোগের শুরু সম্পর্কে জানতে চাইলাম তার কাছে। সৈকত কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্মৃতিচারণ করলেন। জানালেন তার পিতা মো. হাবিবুল্লাহ স্থানীয় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ছেলেমেয়েদের পড়ানোর পাশাপাশি নিজেও পড়াশোনা করতেন। শিক্ষানুরাগী মো. হাবিবুল্লাহ নিজ বাসাতেই গড়ে তোলেন একটি লাইব্রেরি। অবসরে সেখানে বসে বই পড়তেন তিনি। সৈকতের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ সেখান থেকেই জন্মেছে। একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে গিয়ে অন্যান্য বই পড়ার অনুপ্রেরণা যেন পেয়েছেন শিক্ষক বাবার কাছ থেকেই।
এরপর জানালেন আরেক অনুপ্রেরণার কথা। খুব ছোটবেলায় এক চাচার কাছ থেকে জেনেছিলেন রাস্তার পাশে যাত্রী ছাউনীতে থাকা বইয়ের সম্পর্কে। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘকাল। শৈশবে শোনা একটি গল্প যেন যৌবনে এসে পূর্ণতা পেল। সৈকত বললেন, 'আমি তখন থেকেই এমন একটি কার্যক্রমের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম। অবশ্য বয়স এবং অভিজ্ঞতা কম থাকায় তা করা হয়ে ওঠেনি। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর যেন সেই স্বপ্ন পূরণের একটি উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম পাওয়া গেছে।'
আড্ডার ছলে সৈকত বিশ্ববিদ্যালয় এবং লাইব্রেরি নিয়ে তার ভাবনার কথা জানালেন। তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের মুক্ত চর্চার কেন্দ্রস্থল। এটি এমন একটি স্থান যেখানে একজন শিক্ষার্থী তার জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটাতে পারবেন অভূতপূর্বভাবে। এজন্য বই পড়ার চর্চা থাকাটা খুবই জরুরি। কেননা বই পড়ার মাধ্যমে মানুষের মেধা ও মননের অপূর্ব এক বিকাশ সাধিত হয়। সৈকত বলেন, 'বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নত রাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখতে পারি, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে এরকম কোনো চিত্র দেখাটাই দুষ্কর। আমাদের যুব সমাজ যেন বই পড়া থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই টিএসসিতে এসে আড্ডা দেন। উদ্যানের গেটে এসে সময় কাটান। তারা যেন কিছুটা কোয়ালিটি টাইম কাটাতে পারেন সে চিন্তা থেকে আমি এখানেই উন্মুক্ত লাইব্রেরি করার সিদ্ধান্তটি নিয়েছি। একজন মানুষ যদি উন্মুক্ত লাইব্রেরি থেকে এক পৃষ্ঠা পড়েও উপকৃত হয়, আমার সার্থকতা সেখানেই।'
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই তিন নম্বর গেইটের আগের অবস্থার কথা উল্লেখ করে সৈকত বলেন, 'পূর্বে আমরা যখন এসেছি তখন এখানে বিভিন্ন হোটেল, চায়ের দোকান আর ময়লার ভাগাড় ছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃক এখান থেকে হোটেল উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এরপর থেকে জায়গাটি ফাঁকা পড়ে ছিল। আমি এবং আমার বন্ধুরা মিলে এখান থেকে ময়লা পরিষ্কার করি। এরপর জায়গাটির সদ্ব্যবহার করার লক্ষ্যে এখানে একটি উন্মুক্ত লাইব্রেরি করার কথা কর্তৃপক্ষকে জানাই। কর্তৃপক্ষ এবং সবার আন্তরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্মুক্ত লাইব্রেরিকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছি।'
লাইব্রেরির একাংশের ছবি তুলে সৈকত তার ফেসবুকে শেয়ার করলে তা মুহূর্তেই সবার নজরে আসে। উদ্যান গেট সংলগ্ন স্থানে এমন একটি উদ্যোগের সাধুবাদ জানিয়েছেন সৈকতের শুভাকাঙ্ক্ষীসহ অনেকেই। সৈকত তার লাইব্রেরির অনুদান সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বললেন। বাবার কাছ থেকে পাওয়া কিছু টাকা দিয়েই এখন পর্যন্ত তিনি লাইব্রেরির নানা কাজ করেছেন।
সবার উদ্দেশ্যে সৈকত ফেসবুকে লিখেছিলেন, তার আর্থিক কোনো সহায়তার দরকার নেই। তবে, কেউ চাইলে উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে বই দিতে পারবেন। বইগুলো নির্দিষ্ট তাকে সাজিয়ে রাখা হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা ঢাবির টিএসসিতে আড্ডা দিতে আসা লোকেরা, এমনকি রিক্সাওয়ালা বা পথচারীরাও এখান থেকে বই নিয়ে পড়তে পারবেন। লাগবে না কোনো টাকা কিংবা কারোর অনুমতি। তবে শেলফে রাখা বই কেউ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবেন না। লাইব্রেরির একাংশে একটি 'বুক ডোনেট বক্স' রাখার কথা জানালেন সৈকত। এই বাক্সেও যে-কেউ বই দান করতে পারবেন। এবং এখান থেকে কেউ চাইলে তার প্রয়োজনমতো বই নিয়েও যেতে পারবেন।
তানভীর হাসান সৈকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাবেক এই ডাকসু নেতা কিছুটা ক্ষোভের সুরেই সোহরাওয়ার্দি উদ্যান গেইটের বর্তমান অবস্থার কথা জানালেন।
তিনি বলেন, 'ইতিহাসকে ধারণ করার কথা শুধু বইতে লেখা থাকে। কার্যত ধারণ করলে উদ্যান গেইটের এমন দুরবস্থা থাকত না।'
মহান মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করে তিনি বলেন, 'স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এই উদ্যানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকেই তো বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। এরকম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ময়লার ভাগাড় থাকা খুবই দুঃখজনক।'
তার মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী রাজনীতি করবেন, বহুমুখী চিন্তার সংস্পর্শে আসবেন, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে অকাট্য যুক্তি তুলে ধরবেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সুস্থ বিতর্ক করবেন। এই উন্মুক্ত লাইব্রেরিটি সবার জন্য এরকম ভিন্ন ধারার জ্ঞান চর্চার জন্য উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন তানভীর হাসান সৈকত।
বর্তমানে সৈকত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে উপ-সমাজসেবা সম্পাদক পদে আছে তিনি। নিজের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সমাজের উন্নয়নমূলক এমন যেকোন কাজই আমার রাজনৈতিক কাজেরও অন্তর্ভুক্ত। বই পড়ার মাধ্যমে মানুষ সভ্য এবং সহনশীল হতে শেখে। সম্প্রতি সারা বিশ্বে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা উগ্রবাদ মোকাবিলা করা সম্ভব প্রকৃত জ্ঞানার্জনের দ্বারাই। এসব দিক বিবেচনা করে মনে করি উন্মুক্ত লাইব্রেরির মাধ্যমে আমি আমার সমাজসেবার কাজ কিছুটা হলেও এগিয়ে নিতে পারব।'
লাইব্রেরির একপাশে রাখা বোর্ডে অঙ্কিত আলপনাটি আমাদের লোকসংস্কৃতিতে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই আলপনাটির ডিজাইন করেছেন সৈকত নিজেই। এছাড়া লাইব্রেরির নামফলক এবং লাইটের ওপরে 'মাথাল' (কৃষকদের ব্যবহৃত একধরনের টুপি) রাখা হয়েছে। লাইব্রেরিতে আসা ব্যক্তিদের কাছে বাংলার সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াসে এই উদ্যেগ নেয়া হয়েছে। এখানে চাইলে কবিতা-গানের আসর, পথ নাটক ইত্যাদি করা যাবে।
উন্মুক্ত লাইব্রেরি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সৈকতের চিন্তা জানতে চাইলাম। উন্মুক্ত লাইব্রেরিকে তিনি একটি সামাজিক আন্দোলনের সাথে তুলনা করলেন। তার কাছে এটি কোনো সামাজিক আন্দোলনের চেয়ে কম কিছু না। কারণ বই পড়ার মাধ্যমেই তো প্রকৃত উন্নয়ন ঘটে। এতে করেই সমাজ ও দেশ এগিয়ে যায় উন্নতির শিখরে। তানভীর হাসান সৈকতের এখন ভাবনা ও কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে যেন এই উন্মুক্ত লাইব্রেরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরো কয়েকটি স্থানে উন্মুক্ত লাইব্রেরি গঠন করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এছাড়া, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এই সামাজিক আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।