কেন এখনও আকাশে এত ‘ভুতুড়ে ফ্লাইট’!
বিমান বা উড়োজাহাজ আবিষ্কারের পর থেকে এটি মানুষের কাছে সবচেয়ে আরামদায়ক ভ্রমণ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। স্বল্প সময় ও দ্রুত দেশ বিদেশের নানা গন্তব্যে পৌঁছে যেতে এর কোনো বিকল্প নেই। বিমানের যেমন সুবিধা রয়েছে তেমনি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ক্ষেত্রেও রয়েছে এর ভূমিকা।
একটি রুটে কোনো বিমান সংস্থার বিমানগুলো কিভাবে চলবে তার জন্য থাকে চুক্তিভিত্তিক শিডিউল। এই শিডিউল অনুযায়ী বিমান সংস্থাগুলো তাদের বিমান নিয়মিত পরিচালনা করে।
করোনা মহামারির শুরুর দিকে যখন বিমান পরিবহন থমকে দাঁড়ায় এবং আন্তর্জাতিক সীমানা বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন 'গোস্ট ফ্লাইট' বা 'ভূতুরে ফ্লাইট' একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠে।
'ভূতুরে ফ্লাইট' বলতে বুঝায় একেবারে নামমাত্র যাত্রী অথবা যাত্রী না থাকা সত্ত্বেও চুক্তিভিত্তিক বাধ্যবাধকতার কারণে বিমানগুলো শিডিউল অনুযায়ী আকাশপথ পাড়ি দেওয়া। শুধু চুক্তির কারণে চলা এই প্রায় যাত্রীশূণ্য ফ্লাইটগুলো থেকে অকারণে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়।
করোনার প্রায় দুইবছর হতে চললেও এই 'ভূতুরে ফ্লাইট' এখনো বায়ুমন্ডলকে দূষিত করে যাচ্ছে এবং বর্তমানে এটি একটি বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্রীনপিসের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই বছর শীতে ইউরোপের আকাশে দশ লাখেরও বেশি 'ভূতুরে ফ্লাইট' পাড়ি দেবে। এতে করে যে পরিমাণ পরিবেশ দূষণ ঘটবে, তা বছরে ১.৪ মিলিয়নের বেশি গাড়ির ধোঁয়ায় সৃষ্ট দূষণের সমান।
ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমান সংস্থা হলো লুফথানসা। গত ডিসেম্বরে লুফথানসার সিইও কার্সটেন স্পরের একটি সাক্ষাৎকার নেয় গ্রীনপিস যেখানে তিনি সতর্ক করে বলেন, ইউরোপের নিয়মের অধীনে লুফথানসার স্লটগুলোকে ধরে রাখার জন্য তাদেরকে অতিরিক্ত ১৮ হাজার অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে, লুফথানসা ইউরোপের ১৭ শতাংশ ফ্লাইট পরিচালনা করে। গ্রীনপিসের অনুমান অনুযায়ী, ইউরোপের 'ভূতুরে ফ্লাইট' ২.১ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করবে।
গ্রীণ পিসের এই সমীক্ষাটি পরিবেশবাদীদের মনে ক্ষোভের ঝড় তুলেছে। পরিবেশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ জোর দিয়ে বলেন, "ব্রাসেলস এয়ারলাইনস (যা লুফথানসা গ্রুপের অংশ) তাদের স্লটগুলো ধরে রাখার জন্য তিন হাজার অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইট চালায়।"
যুক্তরাজ্যে ইতোমধ্যেই একটি পিটিশন চালু করে অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইটগুলো বাতিলের আবেদন করা হয়েছে।
এরই মাঝে লুফথানসা জানিয়েছে, তাদের বিমানগুলো যাত্রী নিয়েই উড্ডয়নের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তারা। কিন্তু করোনার কারণে তা করতে ব্যর্থ হচ্ছে তারা।
তবে এই বিমান সংস্থার মুখপাত্র অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইটগুলোকে একেবারে খালি বা 'ভূতুরে ফ্লাইট' বলতে নারাজ। তিনি বলেন, ''এই ফ্লাইটগুলো হলো শিডিউলের ফ্লাইট। কিন্তু করোনা মহামরির কারণে এগুলো খুব কম বুক করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম চাহিদা থাকা সত্ত্বেও লুথফানসার বিমানগুলোকে হাবে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান বিমান বন্দরগুলোতে উড্ডয়ন ও অবতরনের অধিকার বজায় রাখার জন্য ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে।"
তিনি বলেন, "এই শীত মৌসুমে যেই পরিমাণ যাত্রী অনুমান করা হয়েছিলো তা করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট বাস্তবিক অর্থে অনেক কমিয়ে দিয়েছে।"
গত বছরের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা (আইএটিএ) এর বার্ষিক সভায় বিমান ইন্ডাস্ট্রিগুলো প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলে, ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো কার্বন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে তারা।
কিন্তু, হাব ভিত্তিক ক্যারিয়ার, কম-বাজেটের বিমান সংস্থা, নিয়ন্ত্রক ও পরিবেশবাদী গ্রুপগুলো অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইটের অযৌক্তিক অপচয়ের জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছে সংস্থাগুলো।
গ্রীনপিসের 'ইউরোপীয়ান মোবিলিটি ফর অল' ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র হেরউইং সাস্টার বলেন, "আমরা জলবায়ু সংকটের মধ্যে রয়েছি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবহন খাত সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গত করে। উদ্দেশ্যহীন, পরিবেশ দূষণকারী 'ভূতুরে ফ্লাইট'গুলোর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। রেল সংযোগ থাকার পরেও কম যাত্রী ধারণকারী ফ্লাইট এবং স্বল্প দূরত্বে পরিচালিত ফ্লাইটগুলোকে নিষেধাজ্ঞা না দেওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রকাশ।"
তাহলে পৃথিবীতে এখনও কেন এই ফ্লাইটগুলো চলছে?
বিমানের মূল্যবান সম্পদ, স্লট
বিমান সংস্থাগুলো তাদের ব্যয়বহুল ফ্লাইট পরিচালনার একমাত্র কারণ হলো এই ইন্ডাস্ট্রি স্লট গেইমের সাথে জড়িত।
স্লট বলতে একটি বিমান বন্দরে কোনো একটি বিমানের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাকে বুঝায় যেখানে একটি বিমান অবতরণ, জ্বালানী সংগ্রহ, নতুন যাত্রীদের উঠানো ও উড্ডয়ন করে থাকে।
এমনকি যাত্রী না থাকলেও বিমানগুলোকে তাদের স্লট ধরে রাখতে হয়। এ কারণেই শিডিউল অনুযায়ী বিমান চালনা করতে হয় তাদের।
বিশ্বে বর্তমানে দুইশোরও অধিক ব্যস্ততম হাব রয়েছে যেখানে ফ্লাইটের চাহিদা রানওয়ে ও টার্মিনালের মোট ধারণক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এই ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার জন্য যানজটপূর্ণ বিমানবন্দরে স্লটের ব্যবস্থা করা হয়।
যাত্রাপথে বিমানগুলোকে বেশ কয়েকটি রুট পাড়ি দিতে হয়, এই রুটগুলোতেও চলে শতশত বিমান। কোনো রুটে কোন বিমানটি কখন চলবে তার জন্য রয়েছে একটি কার্যকরী শিডিউল।
আবার সম্বয়কারী ফ্লাইটগুলোকে সময়বিন্যাস করতে হয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। একটি স্লট দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিমান সংস্থার কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। একটি বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নে দেরি হলে পরের বিমানবন্দরে অবতরণে হয়ে যেতে পারে বিশাল সমস্যা।
স্লটগুলো বছরে দুইবার বরাদ্দ দেওয়া হয়- গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন।
আবার স্লট বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়াও কঠিন। কোনো বিমান সংস্থা যদি শতকরা ৮০ ভাগ সময় তার জন্য বরাদ্দকৃত স্লট ব্যবহার করতে পারে তাহলে পরবর্তী মৌসুমে সেই স্লট ব্যবহারের অনুমতি পাবে ওই সংস্থা।
ফলে যাত্রী না থাকা সত্ত্বেও একটি বিমান সংস্থাকে তার ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে সেই স্লট ব্যবহার করতে হয়।
কিভাবে ক্ষতিপূরণ করা যায়?
ইউরোপের সবচেয়ে বৃহত্তম কম-খরচের বিমান সংস্থা রায়ানায়ারের মতে, ভূতুরে ফ্লাইট সমস্যার সমাধান সোজাসাপ্টা হওয়া উচিত।
রায়ানায়ারের মালিক মিখাইল ও লেরি বলেন, "যদি লুফথানসাকে সত্যিই তাদের ভূতুরে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়, তাহলে তাদের উচিত বিমানের টিকিটের দাম কমানো।
ও লেরির যুক্তি দিয়ে বলেন, "লুফথানসা ও এর সহযোগী বিমানসংস্থাগুলো (ব্রাসেলস, সুইস ও অস্ট্রিয়ান বিমান সংস্থ) বহুবার রাষ্ট্রীয় সাহায্য থেকে উপকৃত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এখন তাদের উচিত এই খালি বিমানগুলো পরিচালনার বদলে স্বল্পমূল্যে সিটগুলো বিক্রি করে কোভিড সংকটে বিলিয়ন ইউরো ভূর্তকি দেওয়া জার্মান ও ইউরোপীয় করদাতাদের সম্মান করা।"
তবে, লুফথানসার মুখপাত্র এই এর বিপক্ষে বলেন, একটি বিশাল বিমান সংস্থার জন্য এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি। তিনি বলেন, "লুফথানসার মতো নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলো বিমানবন্দরের স্লটের উপর নির্ভশীল এবং এরা মূলত দূরপাল্লার ফ্লাইট পরিচালনা করে। আর স্বল্প খরচের বিমান সংস্থাগুলো মূলত কম-দূরত্বের ফ্লাইট পরিচালনা করেন যেখানে সাধারণত স্লটের কোনো অভাব থাকে না।"
এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য লুফথানসা চাচ্ছে, ইউই সদস্য দেশগুলো যাতে এই শীতকালীন মৌসুমে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরনে ব্যতিক্রম নিয়ম ধার্য করে। সেইসাথে যাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো হয়, সেটিও চান তারা।
- সূত্র: সিএনএন