করোনায় সর্বস্বান্ত পরিবার: ছেলেকে পড়াতে স্ট্রোক করেও হার মানেননি মা
সন্তানের জন্য মায়েদের সংগ্রামের গল্প বরাবরই হার মানায় দিগ্বিজয়ী সৈনিকের যুদ্ধের আখ্যানকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে দেখা হয়েছিল জীবন যুদ্ধে লড়তে থাকা তেমনি এক সাহসী মায়ের সঙ্গে।
পরনে বেশ পরিচ্ছন্ন জামা-জাপড়, চোখে চশমা, কথাবার্তায় মার্জিত সেই মা এসে বলছিলেন সংসার আর একমাত্র ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে গিয়ে তার সংগ্রামের কথা। করোনা মহামারির থাবায় যার জীবনে নেমে এসেছে যুদ্ধের দুর্ভোগ। ছেলের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে নিতে বাদাম-নাড়ু আর আচার ফেরি করতে শুরু করেছেন মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহিণী তানিয়া শারমিন।
সাজানো গোছানো আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই নির্বিঘ্নে চলছিল তানিয়ার সংসার৷ স্বামী-স্ত্রী আর এক ছেলে মিলে তাদের পরিবার। সাভারে এক গার্মেন্টেসের স্টোর ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত স্বামীর আয়ে ভালোভাবেই কেটে যেত দিন। ২০২০ সালে ছেলে দশম শ্রেণিতে ওঠার কিছুদিন পরই শুরু হলো বিশ্বজুড়ে মহামারি৷ কয়েক মাসের মধ্যেই দেশের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো তানিয়ার স্বামী শামিম যে গার্মেন্টেসে কাজ করতেন সেটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তির কর্মহীন হয়ে যাওয়ায় তানিয়াদের পরিবারে শুরু হয় ঘোর অনিশ্চয়তা।
বহুদিনের আগলে রাখা কিছু সঞ্চয় দিয়ে চলতে থাকে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা। এদিকে বকেয়া জমতে থাকে বাড়ি ভাড়া, এলাকার দোকানে জমতে থাকে বাকি আর ছেলের টিউশন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তানিয়া বলেন, "অনেক কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছি। চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায়ই কম দামে আটা কিনে রুটি খেয়ে থেকেছি সারাদিন। ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। এই বয়সে তাকে একটু পুষ্টিকর খাবার দিতে না পেরে আমার বুক ফেটে যায় কষ্টে।"
পরিচিত শিক্ষক বিনামূল্যে ছেলেকে পড়াতে রাজি হওয়ায় তা-ও কিছুদিনের জন্য স্বস্তি মেলে। কিন্তু সব ধরনের দুশ্চিন্তা সামলে উঠতে না পেরে কিছুদিন পরই স্ট্রোক করেন তানিয়া।
চিকিৎসার সময় আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতা পেয়ে সে যাত্রা মোটামুটি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন ঘরে৷ তানিয়ার স্বামী অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে। কিন্তু চল্লিশোর্ধ্ব বেকার মানুষের নতুন কাজের ব্যবস্থা হওয়া তো সহজ নয়। ব্যবসা করতে চাইলে দরকার পুঁজির, যেটা জোগাড় করা আরো অসাধ্য তাদের জন্য।
দেড় বছর এভাবে চলার পর ২০২১ সালের শেষের দিকে ছেলের এসএসসি পরীক্ষার পর এক হাজার টাকা পুঁজিতে শুরু করেন ঘরে তৈরি খাবারের ব্যবসা। বাদাম ভাজা, চালের নাড়ু, সেমাইয়ের নাড়ু, তেতুলের আচার বানিয়ে প্যাকেট করে বিক্রি শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে।
"এতদিনে জমানো সব টাকাও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ছেলে কলেজে ভর্তি হলে আরো বাড়তি খরচ যোগ হবে। তাই স্বামী-স্ত্রী মিলে কম খরচে এই ব্যবসার চিন্তা করি। দুজন মিলেই বাজার করা থেকে শুরু করে খাবার বানানো, প্যাকেট করার সব কাজ করি। এই ব্যবসায় আমাদের খাওয়া খরচটা চলে যায় কোনোরকমে," বলেন তানিয়া।
"খাবারের ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা আগে থেকেই ছিল আমার। নব্বইয়ের দশকে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর তিন বোন আর মায়ের সংসার দেখতে হতো আমাকেই। তখন মা আর বোনদের সাথে মিলে বাসায় খাবার বানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে এসে বিক্রি করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটাও তাই আগে থেকে চেনা ছিল।"
সাভার থেকে ঢাকা আসতে-যেতে পাঁচ-ছয় ঘন্টা নিয়মিত জার্নি করতে হয় তানিয়াকে। জীবিকার তাগিদে অসুস্থ শরীর নিয়েও কাজ চালিয়ে যেতে হয়। বাসার কাছেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থাকলেও সেখানে খাবার বিক্রি করতে যান না তিনি। কারণ সেখানে পরিচিত অনেক মানুষ আর আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা থাকে নিয়মিত। বিপদের সময় এই মানুষেরা সাহায্য না করলেও এই ব্যবসার কাজ দেখে কটু কথা শোনাতে ছাড়বেন না বলে ভয় পান তানিয়া৷
"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি কারণ ভার্সিটিতে পড়া ছেলেমেয়েদের কাছে আমার সমস্যার কথা বলতে চাইলে তারা শুনে। কেউ কেউ আমার গল্প শুনে সহানুভূতিতে জড়িয়ে ধরে৷ এরা যেরকম সম্মান দেখায় সেরকম আমি নিজের আত্মীয়স্বজনের কাছেও পাই না। ঘরে চাল না থাকলেও আত্মীয়স্বজনের কাছে বলার উপায় নেই। সমস্যার কথা বলতে গেলে উল্টা অনেক অপমানজনক কথা শুনিয়ে দেয় তারা," কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন তানিয়া।
প্রতিদিন সাভার থেকে ঢাবি ক্যাম্পাসে এসে খাবার বিক্রি করতে পারেন না তানিয়া। মাত্র দুজনে মিলে কাজ করায় একদিনে খুব বেশি খাবার বানানো সম্ভব হয় না। আবার বেশি খাবার বানানোর জন্য বাজার করার টাকাও থাকে না তার কাছে। একদিন সব খাবার বানিয়ে, রোদে দিয়ে প্যাকেট করে রাখেন আর তার পরদিন সেগুলো বিক্রি করতে যান। দিনে আচার-বাদাম-নাড়ু বিক্রি করে তিন-চারশো টাকা লাভ হয়। সেই টাকায় নিজেদের খাওয়া খরচ চালান। আর পুঁজির টাকায় আবার নতুন করে ব্যবসার কাঁচামাল কেনেন।
সাভার ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বয়েজ হাই স্কুল থেকে এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়ে তানিয়ার ছেলে অপেক্ষায় আছে কলেজে ভর্তি হওয়ার। এইচএসসিতে ভর্তি হওয়ার জন্য সরকারি কলেজে নাম আসেনি। ভর্তি হতে হবে বেসরকারি সাভার মডেল কলেজে। মোট ১৩ হাজার টাকা লাগবে ভর্তির সময়। স্বল্প আয়ে দিন কাটানো তানিয়ার পরিবারে এখন একবারে এত টাকার জোগাড় করা এক বড় চ্যালেঞ্জ।
"নুন আনতে পান্তা ফুরায়- অবস্থা এখন আমাদের। আজকে বাদাম-নাড়ু বিক্রি করতে আসলাম, কাল যদি অসুস্থতার কারণে কাজ করতে না পেরে বিছানায় পড়ে থাকি তাহলে পরেরদিন আবার খাবার জোগাড় করতে টানাটানি পড়বে। এই অবস্থায় ছেলের ভর্তির টাকা কোথায় পাব তা জানিনা," বলেন তানিয়া।
"আমার ছেলেটা দুই বছর যাবত অনেক কষ্ট সহ্য করছে, তাও কখনো মুখ ফুটে বলে নাই। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভালো থাকার ভান করছে সবসময়। অনলাইনে পড়ালেখার জন্য তার একটা ভালো মোবাইলের দরকার। বলেছিলাম এসএসসি-টা কোনোমতে পড়ালেখা করে ভালো রেজাল্ট করো। এরপর তোমাকে ভালো মোবাইল কিনে দিব। ছেলেটা জিপিএ ফাইভ পাওয়ার পরও তার চাহিদাটা পূরণ করতে পারলাম না। তবে যেকোনোভাবেই হোক আমি যতদিন বেঁচে থাকব ছেলের লেখাপড়া করায় যাব। আমার সন্তানকে শিক্ষিত করার এই সংগ্রামে আমি হার মানবো না।"
করোনাকালে দেশে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন লাখ-লাখ মানুষ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের মতে ২০২০ সালেই পোশাকখাতে চাকরি গেছে প্রায় তিন লাখের মতো মানুষের। হুট করে বেকার হয়ে যাওয়ায় অসংখ্য মানুষের পরিবারে নেমে এসেছে ভয়াবহ দুর্ভোগ। তানিয়ার গল্প মহামারিকালীন দেশের অসংখ্য মধ্যবিত্তের জীবনের প্রতিচ্ছবি। তানিয়ার মতোই হার না মানা মায়েদের সাহসের জোরে বেঁচে আছে এমন আরো অনেক পরিবার।