কাজের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ: একটি দরকারি টুল না কি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আরেকটি আক্রমণ?
রাত ৮টা বেজে গেছে। অফিস টাইম শেষ। হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করছেন। এমন সময় অফিসের বস, কলিগ কিংবা ঠিকাদারের কাছ থেকে ম্যাসেজ পেলেন। কী করবেন এখন? কোনো জরুরি বার্তা এসেছে কি না তা জানার জন্য ম্যাসেজ খুলে পড়বেন? না কি রেখে দিবেন?
চাইলে আপনি পরদিনও সেই ম্যাসেজ চেক করতে পারেন। কিন্তু তারপরও দেখা যাবে হুট করে আসা এই কাজের আলাপ শুধু আপনার ব্যক্তিগত সময়েই ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না, পাশাপাশি একধরনের মানসিক চাপও সৃষ্টি করছে।
শুধু হোয়াটসঅ্যাপ নয়, অন্য কোনো টেক্সটিং অ্যাপ কিংবা ই-মেইলের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটতে পারে। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে বিষয়টি আরেকটু জটিল।
স্পেনের নিব্রিজা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সামাজিক গবেষণা বিশেষজ্ঞ জুয়ানা রুবিও রোমারো বলেন, "হোয়াটসঅ্যাপ একটি হাইব্রিড প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে ফোন এবং ইমেইল ব্যবহারের দুধরনের সুবিধাই পাওয়া যায়। এই অ্যাপের মাধ্যমে আপনি যেমন মেইলের মতো ফাইল পাঠাতে পারবেন, তেমনি চ্যাট অ্যাপের মতো তাৎক্ষণিক যোগাযোগ বা ফোনকলও করতে পারবেন।"
প্রায় সবাই হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন এবং কাজের ক্ষেত্রেও এটা বেশ সাধারণ একটি যোগাযোগ মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। সমস্যা হলো অ্যাপটি আপনার সেলফোনেই আছে এবং আপনি জানেন না যে কখন কোনো ম্যাসেজ আসবে।
ম্যাসেজ অ্যালার্ট পেয়ে হয়তো আপনি ফোন চেক করবেন। তখন ম্যাসেজটি বন্ধুর থেকেও হতে পারে আবার অফিস থেকেও আসতে পারে। অফিসের ম্যাসেজ হলে আপনার ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের ভারসাম্য অনেকটাই ব্যাহত হবে।
২০১৯ সালে পরিচালিত একটি গবেষণা অনুযায়ী রিটেইল, পরিষেবা ও বিনোদন খাতে বিশ্বের ৫৩ শতাংশ সম্মুখসারির কর্মীই ব্যক্তিগত অ্যাপ কাজের জন্য ব্যবহার করে থাকেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১,২৬১ জন ব্রিটিশ কর্মীর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় যে ৪১ শতাংশ কর্মীই কাজের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করছেন। মজার বিষয় হলো গবেষণাগুলো মহামারির আগের। মহামারি পরবর্তী সময়ে ঘরে বসে কাজ করার এই জটিলতা আরও বেড়েছে।
গবেষক জুয়ানা রুবিও রোমারোর মতে, সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ইনফরমাল পর্যায়ে যোগাযোগের একটি সঠিক ও নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সেটা মেনেই কাজের বাইরে যোগাযোগ করা উচিত।
হোয়াটসঅ্যাপের টার্মস অব সার্ভিস বা পরিষেবা শর্ত অনুসারে ব্যক্তিগত কাজের বাইরে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ। ইউরোপের অনেক দেশেই নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার বাইরে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ মাধ্যমে অফিসের কাজ নিয়ে কথা না বলার অধিকার বিষয়ক আইন রয়েছে। তবে আইন যাই বলুক না কেন, অধিকাংশ মানুষই কাজের সময়ের বাইরেও ব্যক্তিগত ফোনে অসংখ্য কাজ সংক্রান্ত বার্তা পেয়ে থাকেন।
একপাক্ষিক কোনো যোগাযোগ বা কোনো ডকুমেন্ট দ্রুত পাঠানোর ক্ষেত্রে হোয়াটস অ্যাপ কার্যকর ভূমিকা রাখে। ফোনকলের চেয়ে এধরনের বার্তা প্রদান অপেক্ষাকৃত কম তাড়া দিয়ে থাকে সে কথাও উল্লেখ করেন রুবিও রোমারো। কেননা এক্ষেত্রে গ্রহীতা ইচ্ছা করলে ম্যাসেজ চেক নাও করতে পারেন।
কিন্তু তাই বলে ফরমাল যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিংবা অপর ব্যক্তির শিডিউলের তোয়াক্কা না করেই হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো ঠিক নয়। এরসঙ্গে এক ধরনের মানসিক চাপেরও সৃষ্টি হয়। ম্যাসেজ পেলে আমরা তাড়াহুড়ো করে বার্তা চেক করা এবং রিপ্লাই পাঠানোর জন্য চাপ অনুভব করে থাকি।
গবেষক ইভা রিম্বাউ মনে করেন হোয়াটসঅ্যাপে কাজ সম্পর্কিত বার্তা পাঠানোর আগে ভেবে নেওয়া উচিত। কোন প্রশ্নগুলোর তাৎক্ষণিক উত্তর প্রয়োজন এবং কোনগুলোর উত্তর পরে পেলেও চলবে সেই পার্থক্য করতে শেখা উচিত।
তিনি আরও বলেন, এমন অনেক অ্যাপই আছে যেগুলো কাজের জন্য ব্যবহার উপযোগী। কাজের জন্য সেগুলোই ব্যবহার করা উচিত।
কর্মঘণ্টার বাইরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার অধিকার নিয়ে কাজ করেন ফ্রান্সিসকো ট্রুজিলো পন্স। তার মতে, হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস আনঅ্যাভেইলেবল রাখার পাশাপাশি এমন সেটিং রাখা উচিত যেন ম্যাসেজ সিন করার পর দুটি ব্লু মার্ক দেখা না যায়। এর ফলে হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাসিনক্রোনাস মাধ্যম থেকে সিনক্রোনাসে পরিণত হবে। ফলে তাৎক্ষণিক উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও থাকবে না।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও কাজের জন্য পৃথক ফোন বা নাম্বার ব্যবহার করা।
"অনেকেই বিষয়টি নিয়ে মাথা না ঘামালেও ব্যক্তিগত ফোন কাজের জন্য ব্যবহার করা একটি বিতর্কিত বিষয়," বলেন রিম্বাও। আর তাই কাউকে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার বাইরে কাজ সংক্রান্ত ম্যাসেজ পাঠানোর আগে অবশ্যই দ্বিতীয়বার বিবেচনা করা উচিত।
- সূত্র: এলপাইস