ব্যবহারকারী মারা যাবার পর তার ফেসবুকের বিপুল তথ্যভান্ডারের মালিকানা কার? এ তথ্যভান্ডারের কী হবে?
উত্তরাধিকার সূত্রে উরুগুয়ের বৃহত্তম ফিউনারেল হোমের একটির মালিকানা পান লুসিয়ানা ডিমারিয়া আর্তোলা। কয়েক মাস আগে তিনি একটি টুইটবার্তায় মৃত ফেসবুক ব্যবহারকারীদের পরিবারকে সাহায্যের প্রস্তাব দেন। বার্তাটিতে তিনি লিখেছিলেন: 'আপনার কোনো প্রিয়জন যদি মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে লিখুন। আমি একটি মেমোরিয়াল অ্যাকাউকন্ট তৈরি করতে বা তাদের প্রোফাইল ডিঅ্যাক্টিভেট করতে সাহায্য করব।'
পারিবারিক ঐতিহ্যের কল্যাণে আর্তোলা মৃত ব্যক্তিদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট মেমোরিয়ালে পরিণত করতে মানুষকে সাহায্য করেন।
আর্তোলার এই কাজের শুরু কয়েক বছর আগে, তার এক ফরাসি বন্ধুর ভাই মারা যাবার পর। ওই বন্ধু আর্তোলাকে জানান তার ভাই মারা যাবার পরও তার প্রোফাইল সক্রিয় থাকার অভিজ্ঞতা ভীষণ কষ্টকর।
কিছুদিন পরই আর্তোলা বুঝতে পারলেন, এই কাজও তার পারিবারিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবসার অংশ হতে পারে।
উদাহরণ দিতে গিয়ে আর্তোলা জানান, কিছুদিন আগে ২১ বছর বয়সি এক যুবক মারা যান। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দায়িত্ব পালন করে অন্য একটি ফিউনারেল হোম। তবে ওই প্রতিষ্ঠানটি মৃত যুবকের মাকে জানায় যে আর্তোলা মৃত ব্যক্তিদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে পারেন। তখন ওই মা এসে আর্তোলাকে অনুরোধ করেন তার ছেলের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে।
মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করার গুরুত্ব জানাতে গিয়ে আর্তোলা বলেন, 'সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো, অনেকেই ওই মানুষটার মারা যাওয়ার খবর জানেন না। তারা প্রায়ই মৃত ব্যক্তিকে বার্তা পাঠান: "কেমন আছে? অনেকদিন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই!"'
সম্প্রতি মেটা জানায় প্রথমবারের মতো ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে গেছে। একসময় এ কথা ভাবাও যেত না। কিন্তু টিকটকের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ও মেটাভার্সের ওপর মেটার অতিতিরক্ত মনোযোগের কারণে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—কয়েক দশক পরই ফেসবুকের জীবিত ব্যবহারকারীর চেয়ে মৃত ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। মৃতদের প্রোফাইল ও পোস্ট নিয়ে ফেসবুক পরিণত হবে বিশাল এক ডিজিটাল গোরস্তানে—বস্তুত মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গোরস্তানে।
সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্ল ওম্যান-এর ২০১৯ সালের বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের হিসাব অনুসারে, ৫০ বছরের মধ্যে ফেসবুকের মৃত ব্যবহারকারীর সংখ্যা জীবিত ব্যবহারকারীর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।
কমছে তরুণ ব্যবহারকারীর সংখ্যা
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামাজিক নেটওয়ার্ক মেটার মালিকানাধীন ফেসবুক। এর মাসিক ব্যবহারকারী ২০০ কোটি। দ্বিতীয় অবস্থানও মেটার মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রামের (ইউটিউবকে বাদ দিলে)।
গত অক্টোবরেই ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ স্বীকার করেছেন, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের গড় বয়স অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারকারীদের চেয়ে বেশি।
ওম্যান বলেন, এটি মধ্যমেয়াদি সমস্যা। এ কারণে লোকে এ সমস্যা নিয়ে খুব বেশি কথা বলছে না। আগামী পাঁচ বছর এ সমস্যা তেমন বড় হবে না। তবে এখন থেকে ২০-২৫ বছর পর কী হয়, তা বলা মুশকিল।
বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে একমাত্র মেটাই মৃতদের জন্য 'মেমোরিয়াল অ্যাকাউন্ট' তৈরি করেছে। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম দুই প্ল্যাটফর্মেই এ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কেউ মারা গেলে তার কোনো নিকটাত্মীয় বা লুসিয়ানা ডিমারিয়া আর্তোলার মতো কেউ মৃত্যুর প্রমাণ সমেত অনুরোধ পাঠালে ফেসবুক ওই মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট সেটিংস বদলে দেয়। মৃত ব্যক্তির দেয়া পোস্ট দেখা যাবে—অন্যরাও ওই ব্যক্তির স্মরণে তার ওয়ালে লিখতে পারেন—কিন্তু ফলোয়াররা আর জন্মদিনের অ্যালার্ট বা কার্যক্রমের নোটিফিকেশন পাবে না। টুইটা, ইউটিউব ও টিকটকে কেবল মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করা যায়।
নেই আইন
এই বিশাল ডিজিটাল গোরস্তান শুধু পরিবারের সদস্যদের সম্পর্ক ও মেটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। একুশ শতকের প্রথমার্ধের ইতিহাসের বড় একটা অংশ ধারণ করবে ফেসবুকের সার্ভার।
এসব তথ্যের মালিক কে? আমাদের প্রপৌত্র/প্রপৌত্রী ও ইতিহাসবিদেরা এসব তথ্যে কতটুকু প্রবেশাধিকার পাবে? আর মৃতদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি মেটা কীভাবে সম্মান দেখাবে?
ইউরোপিয়ান তথ্য সংরক্ষণ আইনের আওতায় মৃতরা আসেন না। স্পেনের ডাটা প্রটেকশন অ্যাক্ট-এ বলা হয়েছে, মৃত ব্যক্তিদের স্বজনেরা তাদের ব্যক্তিগত তথ্য পাওয়ার, সংশোধন করার কিংবা মুছে ফেলার অনুরোধ জানাতে পারে।
আইওয়ার ড্রেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাটালি লিনার বলেন, আইন না থাকার বিষয়টি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
'একজন ব্যবহারকারীর মৃত্যুর বিষয়ে কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়মনীতি তৈরি করতে পারে।'
পূর্বসূরিদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্ট ও মেসেজ পড়ে কী লাভ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
অধ্যাপক লিনার বলেন, ব্যবহারকারীরা তাদের প্রিয়জনদের ফেসবুক পেজ দেখতে চাচ্ছিলেন; তাদের দাবির ভিত্তিতেই ফেসবুক মেমোরিয়াল পেজ চালি করে।
গুগলের সাবেক কর্মী রিচার্ড হুইটের ধারণা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোম্পানিগুলোর লক্ষ্য থাকবে লাভ করা, ব্যবহারকারীদের সেবা দেওয়া নয়।
গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার ব্যাপারে এই কোম্পানিগুলোকে বিশ্বাস করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন হুইট। বলেন, 'আজ থেকে ৩০, ৪০, ৫০ বছর পরও যে এই কোম্পানিগুলো "ডিজিটাল গোরস্তান" সেবা দেওয়ার জন্য টিকে থাকবে, তার কী নিশ্চয়তা আছে?'
তবে মৃত ব্যবহাকারীদের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা জীবিতদের চেয়ে বেড়ে গেলে আরেকটা পথ খুলে যেতে পারে এই কোম্পানিগুলোর সামনে। দাদা-দাদিদের ফেসবুকের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে নাতি-নাতনিদের স্বভাব, আচার-আচরণ কেমন হবে, তা ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা করতে পারে তারা।
ওম্যান বলেন, 'জীবিত বংশধরদের তথ্য সংগ্রহের জন্য আপনি মৃতদের তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারেন। আমার কাছে আপনার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই, কিন্তু আপনার বাবা-মার ব্যাপারে সব জানি। তখন এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে [আপনার ব্যাপারে] একটা ভালো ধারণা পাব।'
আপনার অতীতের মালিকানা কার?
এই যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইগুলোর একটি হলো ব্যক্তিগত তথ্যের প্রবেশাধিকার-সংক্রান্ত লড়াই।
ওম্যান বলেন, 'যে অতীত নিয়ন্ত্রণ করে, সে বর্তমানও নিয়ন্ত্রণ করে। ফেসবুক ও গুগল যদি আমাদের ডিজিটাল অতীতের ওপর একচেটিয়া দখল কায়েম করে, তাহলে সমাজ হিসেবে আমরা নিজেরাই নিজেদের ঝুঁকিতে ফেলে দেব। এসব কোম্পানিতে কাজ করা মানুষগুলো খারাপ বলে যে ঝুঁকিতে পড়ব, ব্যাপারটা এমন নয়। ঝুঁকিতে পড়ার কারণ হলো কোনো প্রতিষ্ঠানেরই আমাদের অতীত-ইতিহাসের ওপর এতটা নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত নয়।'
বিতর্কের এখানেই শেষ নয়। ২০৭০ সালের কোনো ইতিহাসবিদ যদি 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' বা 'মি টু' আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করতে চান, তাহলে তার জন্য ফেসবুকের তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এসব তথ্য সংরক্ষিত থাকবে কোথায়? এবং এসব তথ্যের মালিকানা কার হবে?
ওম্যানের প্রস্তাব হচ্ছে, একটি ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লেবেল তৈরি করা—সাংস্কৃতিক জিনিসগুলোর জন্য ইউনেসকো যেভাবে তৈরি করে।
অনেকেই দাবি করেন, ইন্টারনেট স্রেফ একটা আবর্জনার ভাগাড়। ওম্যান তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, আমাদের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর জ্ঞানের বড় একটা অংশ আসে এই ভাগাড় থেকে।
'ওপেন অ্যাকসেস ডাটা' ছাড়াও আরেকটা উপায় আছে।
রিচার্ড হুইট বলেন, সবার সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমে—ব্যবসা মডেল ও ডাটা প্রযুক্তি এবং সরকারি নীতিমালার সাহায্যে—ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণ করা যায়।
ইমর্টাল নামের একটি ব্রিটিশ কোম্পানি ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে একটি ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করছে। এই আর্কাইভে পরিবারগুলোর ডিজিটাল তথ্য কিংবা উইল সংরক্ষণ করা হবে।
ইমর্টাল আপনাকে আপনার ডেস্কটপে একটা ফোল্ডার দেবে। সেখানে প্রত্যেক ব্যবহারকারী এমন সব তথ্য বা ছবি আপলোড করবেন, যেগুলো তারা উত্তরসূরিদের জন্য রেখে যেতে চান। এই পদ্ধতিতে ডিজিটাল ফাইল সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যাবে—তবে সেগুলোতে প্রবেশাধিকার পাবে কেবল ব্যবহারকারীর উত্তরসূরিরাই।
তবে বৈশ্বিকভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ কাজই হবে।
- সূত্র: এল পাইস ইংলিশ