দেশি খাবার? না, এসব খাবার এসেছে ভিন দেশ থেকে!
দেশি খাবার কার না ভালো লাগে। যতই বিদেশি খাবার খাওয়া হোক না কেন, দিনশেষে কিছুটা দেশি খাবার পেটে না পড়লে পেটের খিদে বুঝি মেটে না।
অনেকে বিদেশবিভুঁইয়ে গেলে প্রথম প্রথম খাবার নিয়ে খুব আতান্তরে পড়েন। তখন রাজ্যের নতুন-নতুন স্বাদের সব খাবার সামনে থাকলেও দেশের খাবারের জন্য পেট আর মন দুটোই যেন আনচান করে।
তবে দেশের খাবারগুলো যে শতভাগ 'বিশুদ্ধ' দেশজ, তা-ও আবার নয়। এমনকি বাংলাদেশের মানুষ যেসব খাবার তিনবেলা খান তার অনেকগুলোর জন্মই কিন্তু এখানে নয়। এগুলো এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল থেকে। তারপর সময়ের পরিবর্তনে বাংলার মানুষের পাতে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে খাবারগুলো।
এর একটা কারণ, ভারতবর্ষে বারবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বহিরাগত শাসক শাসন করে গেছেন। সুদূর ইরান-তুরান, পারস্য থেকে আগত এ শাসকেরা তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছেন নিজেদের কিছু সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ দখল করে ছিল তাদের খাবার। এই খাবারগুলোকে তারা এ অঞ্চলে পরিচিত করান, এরপর বাঙালির আটপৌরে জীবনের অংশ হয়ে যায় এগুলো।
মজার ব্যাপার হলো এ খাবারগুলো আমাদের সাথে এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছে যে এগুলোর উৎপত্তি এখানে নয় তা জানলে সেটা অবিশ্বাস্য শোনাবে অনেকের কাছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক এমন কিছু খাবারের কথা যেগুলো আপাদমস্তক দেশি হলেও এসেছিল অন্য দেশ থেকে।
সমুচা
সকালের নাস্তা কিংবা বিকেলের জলখাবারে সমুচার জুড়ি নেই। বেশি ভোজনরসিক অনেকে আবার দুপুরবেলাতেও সমুচা খুঁজতে দ্বিধা করেন না। ময়দার তৈরি মাংসের পুর দেওয়া এ খাবারও কিন্তু বাংলাদেশে তৈরি হওয়া কোনো খাবার নয়।
সমুচার জন্মের ইতিহাস প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো। মধ্যপ্রাচ্যে দশম শতাব্দীর আগে থেকেই সমুচা পাওয়া যেত। তখন এটাকে 'সামবোসা' নামে ডাকা হতো। আনুমানিক ১৪ শতকে মধ্য-এশিয়ার বণিকেরা ভারতবাসীর কাছে এ খাবার প্রথমবারের মতো পরিচিত করান।
গোলাপজাম
টকটকে লাল বা কালচে খয়েরি রং-এর সুস্বাদু গোলাপজাম কে না চেনে। বাড়িতে আগত অতিথি মিষ্টি আনলে তার ভেতরে একটা প্যাকেটে গোলাপজাম থাকবেই, এর অন্যথা কখনো হয় না।
বাড়িতে, দোকানের হাঁড়িতে, অতিথির হাতের বাক্সে শোভা পাওয়া এ গোলাপজাম কিন্তু জন্মসূত্রে বাংলাদেশি বা এমনকি ভারতীয়ও নয়। এটি এ আঞ্চলে এসেছে সেই সুদূর পারস্য থেকে।
ফারসি 'গোল' শব্দের অর্থ হচ্ছে 'ফুল', আর 'আব' মানে 'পানি'। ভারতীয় উচ্চারণে 'গোল' আর 'আব' মিলে গুলাব জামুন বাংলাদেশে এসে গোলাপজাম হয়ে গেছে। এখানে বলে রাখা ভালো, একই নামে বাংলাদেশে কিন্তু একটি ফলেরও দেখা মেলে।
পারস্যে অবশ্য গোলাপজাম 'লোকমাত আল কাদি' নামে পরিচিত ছিল। খোয়ার (শুকনো ক্ষীর) দলাকে মধুর সিরাপে ডুবিয়ে এরপর চিনি দিয়ে তৈরি করা হতো এ সুখাদ্য।
ডাল-ভাত
শেষ পর্যন্ত এ কথাও বিশ্বাস করতে হবে! ডাল-ভাত বাঙালির 'আপন' কোনো খাবার নয়। তবে বিদেশে জন্ম হলেও ডাল-ভাত আমাদের ঘরের কাছেরই জিনিস।
নেপাল থেকে ডাল-ভাত আমাদের এ অঞ্চলে আসে। এ কথা শুনে নিজেকে একটু প্রবোধ দিতে পারেন এই ভেবে যে, হাজার হোক নেপাল তো আমাদের খুব কাছের প্রতিবেশীই।
জিলাপি
জিলাপির যেমন রূপের বাহার, তেমনিভাবে এর নামেও বৈচিত্র্য যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। অমৃতি, আমিত্তি, জিলেবি, জিলেপি, কুণ্ডলিকা; এতসব 'মিষ্টি' নামে ডাকা যায় জিলাপিকে।
বাঙালির ছোটখাটো অনুষ্ঠানে জলখাবারে চাহিদা মেটানো এই জিলাপিও কিন্তু বাঙালিদের আবিষ্কার নয়। এটি মূলত প্রথম তৈরি হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে। তখনও একাধিক নামেই জনসমক্ষে পরিচিত হতো জিলাপি। আরবিতে এটিকে ডাকা হতো 'জালাবিয়া'। আর ফারসিতে জিলাপি তখন পরিচিত ছিল 'জালিবিয়া' হিসেবে।
নান
পুরান ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের যেকোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের রেস্তোরাঁতে নানরুটি এখন দারুণ জনপ্রিয় একটি খাবার।
পারসিকরা বোধহয় বাঙালিদের কাছ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। কারণ এ খাবারটিও আদিতে তৈরি হয়েছিল পারস্যে।
আজকাল আমরা বাটার নান, গার্লিক নান; যতরকমের নানরুটিতেই কামড় দিই না কেন, মূল নান রুটি প্রথমবারের মতো পারস্যের কোনো চুলাতেই তৈরি হয়েছিল।
বিরিয়ানি
বিরিয়ানি নিয়ে আর কীই-বা বলার বাকি আছে! একসময়ে রাজা-বাদশাহদের রাজসিক রসুইঘরের সমাদৃত খাবার বিরিয়ানি এখনও বাঙালিরা আয়োজন করে খান। অর্থাৎ বিরিয়ানির আবেদন বাঙালির কাছে কখনোই কমেনি।
আবারও সেই ইরান তথা পারস্যদেশকেই ধন্যবাদ জানাতে হবে বাঙালিদের মুখে বিরিয়ানির স্বাদ তুলে দেওয়ার জন্য। ভারতবর্ষে তাদের হাত ধরেই বিরিয়ানির প্রচলন ঘটে।
সে যা-ই হোক, এসব খাবারের জন্ম বিদেশে হলেও এগুলো এখন পুরোদস্তুর বাঙালি খাবারই। চিয়ায়ত বাঙালিয়ানার সাথে এগুলো এতটাই মিশে গেছে যে এখন আর এ খাবারগুলোকে আলাদা করে দেখবার জো নেই।
- সূত্র: ইন্ডিয়া টাইমস