ড. ভাং সাহেবের কুকি: ‘সরকার অনুমোদিত ভাংয়ের দোকান’
যেদিকে চোখ যায় শুধু ধু ধু মরুভূমি। গ্রীষ্মের জলজ্যান্ত এক বিকেলে এই বালির সমুদ্র চষে বেড়াতে গিয়ে জান বেড়িয়ে যাচ্ছিল আমার। যথাসম্ভব দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এরপরও মনে হচ্ছিল, আগুন-গরম বালিতে আমার দুটি পা'ই পুড়ে যাবে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মরুভূমির এই বিশালত্বের মাঝে শুধু একটা জিনিসের শব্দই কানে আসছিল- নিজের হার্টবিট (হৃৎস্পন্দন)।
কোনো বাতাস নেই, পাতার কোলাহল নেই, পাখির কিচিরমিচির নেই, এমনকি কোনো পোকামাকড় পর্যন্ত নেই। জীবনে এরচেয়ে অস্বস্তিকর নীরবতার মুখোমুখি কখনো হইনি।
মরুভূমিটির নাম থর। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এই উপক্রান্তীয় মরুভূমির আয়তন দুই লাখ বর্গকিলোমিটারের চেয়েও বেশি।
থরের অভিজ্ঞতা নিতেই ভারতের এই অংশে আসা। মরুভূমির সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর জয়সলমীরে অবস্থান করছিলাম আমরা। শহরের এক হাভেলিতে রাত্রিযাপন করি আগের দিন। হাভেলি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী রাজস্থানী জমিদার বাড়ি। এই হাভেলিকে গেস্টহাউজে রূপান্তর করেছে স্থানীয়রা।
সকাল বেলায় একটি ছাদবিহীন ক্যাফেতে খেতে বসি আমি এবং আমার সঙ্গী। বসে উল্টো পাশের একটি দোকানে নজর যায় আমার। দোকানের সামনে লাল কালিতে বড় করে লেখা, "সরকার অনুমোদিত ভাংয়ের দোকান।"
ভাং নামের এই পানীয় বহু বছর ধরেই ভারতবর্ষে সমাদৃত। এটি মূলত গাঁজার মিশেলে তৈরি পানীয়। ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে বৈধভাবেই এটি বিক্রি করা হয়। কৌতূহল মেটাতে পা বাড়ালাম সরকার অনুমোদিত ভাংয়ের দোকানের দিকে।
দোকানের মালিকের নাম চন্দর প্রকাশ ব্যাস। বয়স ত্রিশের ঘরে হবে। তার দাবি, তিন প্রজন্ম ধরে এই ভাংয়ের ব্যবসা করছে তার পরিবার। তবে ব্যবসার কলেবর বদলেছে। এখন যেমন তার দোকানে মিল্কশেক, ফলের রস, কুকিজ এবং ব্রাউনিতে মিশ্রিত ভাংও রয়েছে।
দোকানে এসে বসার পর ব্যাস বললেন, "আমরা ৪৯ বছরেরও বেশি সময় ধরে চালাচ্ছি এই দোকান। আয়ুর্বেদিক জ্ঞান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে আমাদের পরিবারে। সেই জ্ঞানই আমাদের ব্যবসার মূল পঞ্জি।"
ভাংয়ের শরবতের মতো ভারতবর্ষে গাঁজা ব্যবহারের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। আয়ুর্বেদ হচ্ছে একটি প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি। আয়ুর্বেদ অনুযায়ী, গাঁজা হচ্ছে 'মহাখাদ্য'। এই উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রোগের জন্য উপকারী বলে মনে করা হয়। শরীর ঠান্ডা করা থেকে শুরু করে হৃদরোগ নিরাময়, হাড়ের জোড়ার সমস্যা ও কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে প্রশমিত করা, এমনকি উদ্বেগ, হতাশার মতো মানসিক সমস্যাকেও প্রশমিত করে গাঁজা- আধুনিক বিজ্ঞান ধীরে ধীরে যা জানতে পারছে, আয়ুর্বেদ যেন হাজার বছর ধরেই তা জানত।
তবে, গাঁজার সঙ্গে ভারতের আইন ব্যবস্থার সম্পর্ক একটু গোলমেলে। গত ২০০ বছরে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে গাঁজা সম্পর্কিত আইন। সর্বশেষ পরিবর্তিত হয়েছে ১৯৮৫ সালে। ভারতবর্ষের অনেক দেশেই নারকোটিক আইনে গাঁজার চারা (বা হ্যাশ) এবং গাছের ফুলের কুঁড়ি থেকে তৈরি গাঁজার ব্যবহার ও অধিকৃতি আইনত দণ্ডনীয়।
কিন্তু ভাংয়ের ব্যাপারে আলাদা করে কিছু বলা হয়নি ওসব আইনে। ভারতীয় আইনে উদ্ভিদের পাতা এবং বীজ নিষিদ্ধ করা হয়নি। আর এ দুটি দিয়েই মূলত তৈরি হয় ভাং।
তবে আইনে যাই থাকুক না কেন, হিন্দু সংস্কৃতির একটি বড় জায়গা নিয়ে আছে ভাং। হিন্দু দেবতা শিবের সঙ্গে ভাংয়ের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের মতো হিন্দু-অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে ভাং খুবই প্রচলিত পানীয়। এসব প্রদেশে ব্যাসের মতো সরকার-অনুমোদিত এরকম ভাংয়ের দোকানের অভাব নেই।
ব্যাসের দোকানের দেয়ালে তার সঙ্গে বিখ্যাত শেফ অ্যান্থনি বোরডেইনের একটি ছবি টাঙানো। সেই ছবির দিকে নজর যেতেই তিনি বলে উঠেন, "আমার এখানে প্রতি বছরই অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত লোকজন আসেন।"
ব্যাস জানান, ছোটবেলা থেকেই গাঁজা গাছ নিয়ে তার অনেক আগ্রহ। গাঁজার ইতিহাস এবং গাঁজা সম্বন্ধে হওয়া সকল বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন তিনি। তার মুখ থেকে এই জ্ঞানের ফুলঝুরি বেরোতে দেখে একদল পর্যটক তাকে 'ড. ভাং' বলে ডাকা শুরু করে। ইন্টারনেটেও দ্রুত ভাইরাল হয়ে পড়ে এই নাম।
"এর পর থেকেই এই নাম আমার," মুখে হালকা হাসি নিয়ে বলেন ব্যাস। বিশেষ এই ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে যে তিনি বেশ গর্বিত, সেটা চার চোখ-মুখেই ফুটে ওঠে।
ড. ভাংয়ের এই দোকান স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপক পর্যটক আকর্ষণ করে। কিন্তু ব্যাস জানান, পর্যটকদের কখনোই প্রাথমিক গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করেন না তিনি।
"ব্যবসা সচল রাখতে আমরা মূলত স্থানীয়দের উপরই নির্ভর করি। বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের উপর। তারা ধূমপান করেন না, মদ্যপানও করেন না। কিন্তু আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা এবং নিরাময়ের উদ্দেশ্যে ভাং খান," বলেন ব্যাস।
ব্যাসের দাবি মূলত এ কারণেই মহামারীর ধাক্কা সামলাতে পেরেছে তার দোকান। করোনাকালে এখানকার সকল ব্যবসাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে পর্যটকদের উপর নির্ভর করা ব্যবসাগুলো। কিন্তু হোলি এবং মহাশিবরাত্রির মতো হিন্দু উৎসবগুলোতে ভাং সরবরাহ করা ব্যাসের ব্যবসা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
ড. ভাং আমাকে মেন্যু দেখাতে বসলেন। চার রকমের ভাং আছে তার কাছে। মৃদু, স্ট্রং, সুপার স্ট্রং এবং সুপার-ডুপার স্ট্রং। শেষ ধরনটি পেটে গেলে "২৪ ঘণ্টা ঘোরের মধ্যে থাকবেন আপনি, টয়লেট-গোসল কিছুই করতে হবে না।"
মেন্যু থেকে অনেক বাছ-বিচার করে আমি দুটো কুকি অর্ডার করলাম।
এখানকার বেশিরভাগ দোকানই শুধু ভাং পেস্ট বিক্রি করে। কিন্তু পুষ্কর, বারানসি এবং জয়সলমীরের মতো জায়গায় বিগত বছরগুলোতে পর্যটনের উত্থান ঘটায় মেন্যু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শুরু করেছে বিক্রেতারা। ব্যাস জানান, তার চাচা প্রথম বিভিন্ন খাবারে ভাং মিশিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। এখন তার দোকান থেকে ভাং-মিশ্রিত চকোলেট বল, কুকিজ, মিল্কশেক, ফলের রস এবং দই কিনতে পারবেন আপনি। প্রতিটি আইটেমের দাম গড়ে ১৫০ রূপির মতো।
সুস্বাদু মেন্যুগুলো দেখাতে দেখাতে ব্যাস গাঁজা ব্যবহারের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান দিতে শুরু করেন আমাকে। আমিও প্রশ্ন করি টুকটাক। সেরকম একটি প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "মাঝে মাঝে এমন অনেক পর্যটক আসেন যারা আগে কখনো গাঁজা খাননি, কিন্তু সরাসরি আমাদের সুপার-ডুপার স্ট্রং মেনুটা চেখে দেখতে চান। তখন ঝামেলা হয়। দেখা যায়, শক্তিশালী ভাং খেয়ে তারা পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করেন, আশেপাশের সবাইকে বিরক্ত করতে শুরু করেন। অনেকে অ্যালকোহলের সঙ্গেও ভাং মেশান।"
কুকির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে ড. ভাং তার নিজস্ব কায়দায় বিদায় জানান আমাকে। হ্যাঁ, বিদায়বেলাতেও জ্ঞানের ফুলঝুরি বের হয় তার মুখ থেকে। নেশায় উচ্চমার্গে চলে গেলে নেমে আসার কৌশল বাতলে দিয়ে আমাকে বিদায় দেন তিনি। এই কৌশলের নাম 'জরুরী অবতরণ পদ্ধতি'।
"যদি আপনি বেশি হাই হয়ে যান, এবং নেশা কাটানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন, তাহলে এই কাজ করবেন। গরম পানিতে একটি লেবু চেপে নিবেন। এটা মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাই কেটে যাবে।"
কে জানত, এর কয়েক ঘণ্টার মাঝেই ভাং সাহেবের জরুরি অবতরণের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠব আমি। কিন্তু তখন জয়সলমীর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে আমি। আশেপাশে পানি লেবু পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
কুকি খেয়ে আমি এবং আমার সঙ্গী সিদ্ধান্ত নেই বাইকে করে মরুভূমি চষে বেড়াব। সেখানে যা হওয়ার হবে। কিন্তু কুকির উপাদানের সঙ্গে সঙ্গে আমার উপর ভর করতে শুরু করে প্যারানয়াও। মরুভূমির বিশাল শূন্যতা দেখে আমি ভয় পেতে শুরু করি। ভাবতে শুরু করি, বালি এবং কাটাঝোপের এই সমুদ্র ছেড়ে কখনো বের হতে পারব না আর। এখানেই চিরতরে হারিয়ে যাব। মাত্রাতিরিক্ত গরম আরও বাড়িয়ে দেয় প্যারানয়া।
যখন মনে হচ্ছিল এবার আসলেই পাগল হয়ে যাব আমি, তখনই সামনে এসে হাজির হয় এক উট। যার পিঠে ১০ বছর বয়সী এক ছেলে। সে আমাদেরকে নিয়ে যায় কাছের এক মরূদ্যানে।
বিশাল এক গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেই আমরা। সেখানে মাথা ঠান্ডা করতে করতে অসাধারণ এক দৃশ্য দেখি। দেখি, ধীরে ধীরে দিগন্তে অস্ত যাচ্ছে সূর্যটি, টিলার উপর থেকে যেন গলে পড়ছিল লাল বলটা।
সূর্যাস্তের এই দৃশ্য আমাকে অতীন্দ্রিয় এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। চাইলেও ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না কতটা অতীন্দ্রিয় ছিল সে অভিজ্ঞতা।
আমার মাথায় ঘুরতে থাকে ভাং সাহেবের একটি কথা, "প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলেছে আমাদের এই জ্ঞান।"
"এই গাছকে (গাঁজা) নিয়ে আমরা যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে, তা হয়তো আর কেউই চালায়নি। মানুষ দেখে দোকানগুলোর কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়, তারা দূর থেকে ভাবে, ভালোই তো ব্যবসা। কিন্তু এই ব্যবসার আড়ালে আছে এক মহান দায়িত্ববোধ, দুঃখজনক হলো তা সবার চোখ এড়িয়ে যায়।"
- সূত্র: ভাইস।
- অনুবাদ: কিরো আদনান আহমেদ।