ইউরি গ্যাগারিন: পৃথিবীতে ফিরে আসার পর যেমন ছিল প্রথম মহাকাশচারীর জীবন
১৯৬১ সালের আজকের দিনে প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণ করেন ইউরি গ্যাগারিন, রচনা করেন নতুন এক অধ্যায়ের।
ঐতিহাসিক ওই ভ্রমণের পর বরাবরই সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি।
এক অনুষ্ঠানে কয়েকজন ফাদার তাকে জিজ্ঞাসা করেন, "Yuri Alekseyevich, did you see Jesus Christ far up above the Earth?"
তিনি বলেন, "Holy Father, you'd know better than me whether I'd have seen him up there."
এরপর শুরু হয়ে যায় ইউরির এক অন্যধরনের জীবনে, যেখানে সে একজন সুপারহিরো। বিশ্বের নানা প্রান্তে যেতে হয়, মিশতে হয় হাজারো লোকের সাথে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতেও লাখো লাখো মানুষ তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু নিজের এই সুপারহিরো ইমেজ অসহ্য বোধ হচ্ছিল ইউরির কাছে, তার মতে সে খুব সাধারণ একজন মানুষ, ভুলচুক সবসময়ই হয়, দুর্বলতা আছে তারও, কিন্তু সবাই তার কাছে সবকিছুই খুব নিখুঁত দাবী করে। তাই মস্কোতে যখন এক মহিলা তার কেটে ফেলা গাল দেখে বলে উঠেছিল- 'দেখ দেখ, শেভ করতে যেয়ে সেও গাল কেটে ফেলে,' হেসে ফেলেছিল ইউরি। কানাডায় দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেলের সাথে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে একটা সেমিনারে মূল আকর্ষণ হিসেবে অংশ নেন তিনি। এর মাঝে ৮ আগস্ট তিতভ মহাকাশে গমন করে, সেই অবস্থাতেই টেলিগ্রাম পাঠান ইউরি। এর পরপর যান কিউবাতে, বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে দেখা করে বলেন – যে জাতি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন তাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।
বইটিতে এর পরে আসে সোভিয়েত স্পেস মিশনের বাকি অভিযানগুলোর কথা, বিশেষ করে মহাকাশে প্রেরণের জন্য প্রথম নারী বাছাইয়ের কথা। ক্রুশ্চেভের ব্যক্তিগত নির্দেশে কেবল শ্রমিক এবং কৃষক পরিবার থেকে আসা নারীদের বাছাই করা হয়েছিল, কারণ সোভিয়েতরা বহির্বিশ্বকে দেখাতে চাচ্ছিল যে তাদের দেশের সাধারণ একজন খেঁটে খাওয়া নারীও মহাশূন্যে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত, যুদ্ধে নিহত ট্রাক্টর চালক বাবা এবং সেলাই মিলে কর্মরত মায়ের কন্যা ২৫ বছর বয়স্ক ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা ১৯৬৩ এর ১৬ জুন মহাকাশে যান, রচনা করেন আরেক নতুন ইতিহাস।
এর মাঝেই ইউরি কর্নেল পদে প্রোমোশন পান। তিনি ব্যস্ত ছিলেন লাখো ধরনের কাজের বিশেষ করে মানুষ উপকারে, হাজার হাজার চিঠি আসত তার কাছে সারা বিশ্ব থেকে, সেখানে লেখা থাকত কারো ছেলেকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়ানোর আবেদন, কারো মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সুপারিশ, তার নামে ভদকা চালু করার অনুরোধ এমন সব বিষয়। সবাইকেই সাধ্যমত সাহায্য করতেন ইউরি, তার অনুরোধ ফেলার সাধ্য কারো ছিল না সেই দেশে, তাই হয়ত মানুষ তার কাছেই উপকার চাইত। শুধু একবার চুরি করে গাছ কাঁটার জন্য এক লোকের মুক্তির জন্য চিঠি উপেক্ষা করে উল্টো তার শাস্তির জন্য সুপারিশ করেছিলেন, কারণ তদন্তে দেখা গেছিল সে লোক আসলে কাঠের চোরাকারবারি, আর ইউরির কথা ছিল সবাই যদি গাছ এইভাবে কেঁটে শেষ করে ফেলে তাহলে বন টিকবে কিভাবে!
কামানিন ১৯৬১ এর ডিসেম্বরের গাগারিনের ভারত ভ্রমণ নিয়ে বলেছিলেন যীশু শত লোককে মাছ-রুটি খাইয়ে হয়ত মুগ্ধ করে ছিলেন, কিন্তু ইউরি লাখো মানুষকে কেবল হাসি দিয়ে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম এই প্রমাণ আমরা পেয়েই যাচ্ছি! ইউরির উষ্ণ হাসি এবং স্বভাবের প্রশংসা করে স্বয়ং করোলভ বলেছিলেন যুদ্ধ উত্তেজনা থামিয়ে দিতে পারে প্রাণখোলা ইউরি। কিন্তু এত কিছুর মাঝে ছোট্ট একটা ভুলের ফলে ইউরির ক্যারিয়ার অন্য দিকে মোড় নেয়, বন্ধুদের সাথে ক্রমিয়ার এক বন্দরের পারিবারিক ছুটি কাটাবার সময় বেশ মাতাল অবস্থায় সেখানে পরিচিত হওয়া এক তরুণী নার্সের ঘরে ঢুকে ইউরি; তার কয়েক মিনিটের মাঝেই সন্দেহবশত তার স্ত্রী একই ঘরে প্রবেশ করে, তার রোষ থেকে রক্ষা পেতে জানাল দিয়ে লাফ দিয়ে নিজেকে মারাত্নকভাবে আহত করে মহাকাশ ফেরত বীর! হাসপাতালে এক মাসের বেশী থাকতে হয়েছিল সেই চোট সারাতে এবং বেশ কিছু মিথ্যা কাহিনী রটানো হয়েছিল তার সেই ব্যর্থ অভিযানকে সামাল দেবার জন্য।
লেখকেরা অবশ্য নানা রেফারেন্স দিয়ে বলেছেন সেই সময়ে রমণীদের কাছে জনপ্রিয়তায় ইউরির সাথে পাল্লা দিতে কেবল মাত্র বিটলসএর চার ছোকরাই হয়ত পারত। সব দেশের নারীরাই তার সঙ্গের জন্য পাগল ছিল, সেই হিসেবে এত জনপ্রিয়তার মাঝে একজন স্টার যা করেন, তা ইউরির মাঝে দেখা যায়নি। কিন্তু সেই আহত হবার ঘটনা অনেকের গুড বুক থেকে তার নাম মুছে দেয়।
এর মাঝে সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানের উপরে আসে সবচেয়ে বড় আঘাত, ক্যান্সারে ভুগে করোলভ মাত্র ৫৯ বছর বয়সে মারা যান ১৯৬৬ এর প্রথম দিকে। এত বড় আঘাত সামাল দেওয়া আর সম্ভব হয় নি অত বড় রাষ্ট্রের পক্ষেও। জীবনের শেষ অপারেশনের মাত্র দুই দিনে আগে ইউরি এবং লিওনভ দেখা করতে গিয়েছিলেন গুরুর সাথে, তাদের কাছে জীবনে প্রথমবারের মত তার উপরে চলা নির্মম অত্যাচারের কথা বলেন করোলভ, বলেন পুলিশের পীড়নের কথা, সাইবেরিয়ার নির্বাসনের কথা, সেখান থেকে ফেরার পথে মুচিগিরি এবং মজুরি করে ট্রেন ভাড়া জোগাড়ের কথা। গুলাগের দিনগুলোর কথা আর কোথাও বলেননি সর্বকালের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানী।
প্রথমবারের মত নাড়া খায় ইউরির মন, বুঝতে পারেন যে, দেশের চলন ব্যবস্থার কোথাও বড় ধরনের গলদ আছে, তাছাড়া করোলভের মত একজন স্বীকৃত জাতীয় সম্পদকে কেন এতটা হেনস্থা স্বীকার করতে হল বিনা বিচারে। গুরুর মৃত্যুর পরে ইউরি বলেছিলেন করোলভের দেহভস্ম চাঁদে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। কসমোনাটরা যোগসাজশ করে উনার দেহভস্মের কয়েক মুঠো পরের মহাকাশযাত্রা অভিযানের সময় শূন্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলে বলে শোনা যায়।
এত জনপ্রিয়তার মাঝেও নিজের অজান্তেই পরম শক্তিশালী শত্রু তৈরি করে ফেলেছিলন সদাহাস্যরত ইউরি। নিকিতা ক্রুশ্চেভ তাকে যেমন তার আমলের সাফল্যের প্রতীক হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরত, ততই পরবর্তী সোভিয়েত প্রধান ব্রেজনেভের কাছে চক্ষুশুল হয়ে গেলেন তিনি। অথচ তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত কোন সমস্যা ছিল না। ব্রেজনেভ ক্ষমতায় আসার পরে ইউরির প্রভাব, সুযোগ সুবিধা প্রায় রাতারাতি উধাও হয়ে গেল। এই নিয়ে তিনি শুধু বলেছিলেন ব্রেজনেভকে আমি পছন্দই করতাম কিন্তু কোনদিন তার কাছে যেয়ে মনের কথা বলতে পারলাম না। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ ক্রুশ্চেভের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত হওয়ায় গ্যাগ্যারিনকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ব্রেজনেভ।
এর মধ্যে সয়ূজ দুর্ঘটনায় ভ্লাদিমির কোমারভ মারা যান, যেই মিশনে ব্যাকআপ হিসেবে ছিলেন ইউরি। এই ভয়াবহ ঘটনার পর সয়ূজের পরবর্তী যান ঠিক করতে ২ বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করে ইউরির আকাশে ওড়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। যদিও যুদ্ধ বিমান চালানোর অনুমতি আদায় করে ফেলেন তিনি পরবর্তীতে।
তার পরের ঘটনা যথেষ্ট রহস্যজনক। ১৯৬৮ এর ২৭ মার্চ মিগ বিমানের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় তার বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, ইউরিসহ অপর বৈমানিকের দেহ খণ্ড খণ্ড হয়ে পুরো এলাকার উপরে ঝরে পরে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ইউরি আমাদের ছেড়ে চলে যান চিরতরে, অথচ উনার স্বপ্ন ছিল চাঁদে যাবার। এখন পর্যন্ত তার মৃত্যুর কারণ চুলচেরা করে জানা সম্ভব হয় নি, তবে তার পরিবারের অনেকেই মনে করত স্বয়ং ব্রেজনেভের আদেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে। যদিও এই ধারণার পক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। হতে পারে কোন পাখির সাথে লেগে প্লেনটি দুর্ঘটনায় পড়েছিল, অথবা পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া কোন দ্রুত গতির বিমানে সুপার সনিক বীমের ফলে সৃষ্ট ওয়েভে স্পিন করে এই দুর্ঘটনা ঘটেছিলে। কেজিবি এই ঘটনার তদন্ত করেছিল একাধিকবার, এমনকি বছর কয়েক আগেও নতুন করে খতিয়ে দেখা হয়েছিল একমাত্র সোভিয়েত সুপারহিরো, আদতে মানবজাতির সুপারহিরোর মৃত্যুর কারণ।
আরও পড়ুন: আজই মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছিলেন প্রথম কোনো মানুষ, ইউরি গ্যাগারিন
ইউরির অকাল মৃত্যুর পরে তার সহকর্মী কসমোনাটরা গিয়েছিল গাগারিন পরিবারের সাথে দেখা করতে, সেখানে যেয়েই তিতভ ইউরি সম্পর্কে সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী সত্যটা অনুধাবন করতে পারেন- ইউরি গ্যাগারিন ছিলেন এমন একজন, যাকে মানুষ ভালবেসেছিল।